নানা হলেন বাগানবিলাসী। জীবেন নাকি অনেক কাজ করেছেন, তাই এখন আর মিনতি করেও কাজ করানো যায়না। কাজের কথা বললে হাতে ধরে বলেন, পায়ে জবর ব্যথা। কিছু করার জন্য মিনতি করলে মাথায় ধরে বলেন, ইস! আজ কোমরে এত ব্যথা হচ্ছে কেন?
তাই ব্যথার ভয়ে নানি এখন আর কাজ করার জন্য নানাকে মিনতি করেননা।
বাড়িতে আজ কেউ নেই। বিকালে নাতনী আসবে। নানী ওর পছন্দের কিছু রান্না করতে চাইছেন। কিন্তু বাজারে যাবে কে? এই চিন্তায় চিন্তিত হয়ে চিন্তার সাগরে নানি ঝাঁপ দিলেন। আচকা চিন্তার সাগরে ঝপাৎ শব্দ হলে নানা চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কি হল, আজ এত চিন্তিত কেন?’
‘না তেমন কিছু না। গত কাল কে যেন বলেছিল আজ নাকি নতুন ফুলের চারা নিয়ে ফুলওয়ালা বাজারে আসবে। তাই ধেয়ান চিন্তা করছি নতুন চারাটা দেখি কেমন করে?’ বলে নানী আড়চোখে নানার পানে তাকালেন।
নানা লাফ দিয়ে উঠে হাটতে শুরু করে ব্যস্তসুরে বলল, ‘আমি বাজারে যাচ্ছি, তোমার জন্য কিছু আনব?’
‘না তেমন কিছু লাগবেনা। আজ সুপ্তি আসবেতো, ওর জন্য কিছু আনলেই হবে।’ নানী ভয়ে ভয়ে বলে অস্থীরতা শুরু করে মনে মনে বললেন, ‘আজ ঘর থেকে বার করেই দেবেন। কেন যে আজগুবি কথা বললাম! পাঁচ হায়ন পর এমন আজগুবি চিন্তা আজ আমার মাথায় আসল কেমন করেগো? হায়র হায়! বাজার থেকে এসেই হম্বিতম্বি শুরু করবেন। পিঠে আজ খোল বাঁধতে হবে, নতুবা হাড়জল হবে।’
নানি যখন চিন্তার সাগরে সাঁতার কাটছিলেন নানা তখন বাজারে এসে ঘুরে ঘুরে দেখছেন। আরে! সত্যিইতো ফুলওয়ালা আজ নতুন চারা নিয়ে এসেছে।
ফুলওয়ালার কাছে এসে নানা সাধারণ সুরে বললেন, ‘আমাকে কয়েকটা নতুন চারা দাও।’
ফুলওয়ালা খুশি হয়ে একটা বক্সে চারাগুলো ভরে নানার হাতে দিল। বাক্স হাতে লয়ে নানা মিষ্টির দোকানে যেয়ে মিঠাই মণ্ডা কিনে বাড়ি এসে সমান স্থানে নানিকে বসে থাকতে দেখে হাসতে হাসতে বললেন, ‘সুপ্তি কখন আসবে? এই নাও, ওর পছন্দের মিঠাই মণ্ডা এনেছি।’
‘ফুলপরির দোহাই দিচ্ছি! আমাকে মারবেননা?’ বলে নানি চমকে উঠলেন।
নানা কপাল কুঁচকে বললেন, ‘মায়! আমি তোমাকে মারব কেন, ভূতে ভর করেছে নাকি?’
‘নতুন চারার কথা আমি আন্দাজি বলেছিলাম। সুপ্তি আজ আসবেতো। বাড়িতে কেউ নেই। আপনার আমার জন্যতো মিঠাই মণ্ডা হারাম। তাই বলে সুপ্তিও আমাদের মত গালে হাত দিয়ে বসে থাকবে নাকি? ওর কথা ভেবে অপারগ হয়ে জীবনের পয়লা মিথ্যা কথা বলেছিলামগো। শেষবারের মত ক্ষমা করে দিন। জীবনেও আর এমন ডাহা মিথ্যা কথা বলবনা।’ নানি ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন।
‘ঠিক আছে। শুন, মাঝে মধ্যে আচকা কদাচিৎ এমন করে মিথা বলার অনুমতি দিলাম। সুপ্তি আসার আগে চারা গুলো রোয়ে রাখলে ভালো হবে, নতুবা ওর সাথে ব্যস্ত হয়ে যাব এবং চারাগুলো মরে যাবে।’ বলে নানা বাগানে ঘুরে ঘুরে পছন্দ মত জায়গা পেয়ে কাজে লেগে গেলেন।
বিকেলে মা বাবার সাথে সুপ্তি এসেছে। গাড়ি থেকে নেমেই দিল ছুট। বাগানে এসে নানাকে কাজ করতে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি?’
‘তোর নানি আজ ডাহা মিথ্যা বলেছিলতো, তাই আমাকে কাজ করতে হচ্ছে। কখন এলি?’ বলে নানা হাতে হাত ঝেড়ে দাড়ালেন।
‘এইমাত্র গাড়ি থেকে নেমেছি। কিছু খেয়েছেন?’ বলে সুপ্তি নানার মুখের পানে তাকাল।
‘তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। চল, তোর সাথে আমিও আজ ঠাণ্ডা মিঠা মিঠাই মণ্ডা খাব। জানিস! আজ আমি বাজারে গিয়েছিলাম।’ বলে নানা একটা রক্তজবা ছিঁড়ে সুপ্তির কানে গুঁজে দিলেন।
‘নানাজান, আপনিত দিনরাত ফুলবাগিছায় বসে থাকেন, কখনো ফুলপরি দেখেছেন?’ সুপ্তি আগ্রহের সাথে বলল।
‘ফুলপরিতো আমার সাথে কথা বলছে।’ বলে নানা গাল ভরে হাসলেন।
‘ওরে বাসরে! কোথায়? আমি ফুলপরিকে দেখতে চাই।’ অবাককণ্ঠে বলে সুপ্তি ডানে বাঁয়ে তাকাল।
‘আমিতো তোর সাথে কথা বলছি। এই ফুলবাগিচার একমাত্র ফুলপরি হলে তুই। তুই হাত না বুলালে একটা কলিও ফোটেনা। সবগুলো তোর অপেক্ষায় বসে থাকে। ঔ দেখ, তোর কণ্ঠসুর শুনার জন্য কলিরা আড়িপেতেছে।’
আশ্চর্যজনক হলেও সুপ্তির হাতের পরশ পবার জন্য কলিরা অধীর হচ্ছিল। সুপ্তি যখন হাত বুলাচ্ছিল কলিরা তখন ফুল হয়ে ফোটছিল।
অলী মধুচুর উড়াউড়ি করছিল। কোকিলার কুহু শুনে সুপ্তি ডানে বাঁয়ে তাকাচ্ছিল। তখন ডালি হাতে পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়ে সাজি এসেছে। ওকে দেখে সুপ্তি স্মৃতিকাননে পথ হারাল। সুপ্তি যখন সাজির মত ছিল, তখন সকাল বিকাল ফুলবাগিচায় এসে ফুলতোলত। বাগিছাচায় কত জাতের ফুল ফোটত। জাসমিনের লতা দিয়ে নানা ওকে মালা বানিয়ে দিতেন। গোলাপ জবা শিউলি বকুল আর পলাশ দিয়ে মুকুট বানিয়ে ওরা মাথায় পরিয়ে ফুলপরি ডাকতেন। দিনমান ফুলবাগিচায় বসে নানা নানীর সাথে ফুল নিয়ে খেলত।
বছর কয়েক কেটে গেল, যৌবনোদয়ে সুপ্তি এখন ডানাকাটা পরি। বিমনা হয়ে বাগানে হাঁটলে অলী কলিরা গায়েপড়ে ভাব মজাতে চায়। এক বিকেলে ফুলতোলে ছায়াবিতানে বসে ফোলডোরে মালা গাঁথছিল।
ফুলবাড়ির পাশ দিয়ে এক পথিক যাচ্ছিল। পুস্পসুবাসে উদাস বিমনা হয়ে ফুলবাগিচায় প্রবেশ করে, তার প্রিয় সব ফুল দেখে বিস্ময় বিমোহিত।
ফুলে ফুলে মধু জমেছে,
মধুচুরিত মধুচুর এসেছে।
বরণ করার জন্য মালা গেঁথেছে,
অনিতদূরে কে যেন বসে আছে।
তার কবিতা শুনে মৃদু হেসে সুপ্তি বলল, ‘অপেক্ষার অন্ত আজ হয়েছে।’
পথিক চমকে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে সুপ্তির মুখে দৃষ্টি স্থির করে অবাককণ্ঠে বলল, ‘ফুলপরি!’
‘আমি ফুলপরি নয়। আমার নাম সুপ্তি। পথ হারিয়ে আসা হয়েছে নাকি?’ সুপ্তি মৃদু হেসে বলল।
পথিক হাসার চেষ্টা করে বলল,
ভিরু চোখে চকিত চাহনি, গোলাবী ঠোঁটে দুষ্টু হাসি,
ফুলপরি, এক জোড়া ডানা ধার দাও বাতাসে ভাসি।
‘ফুল নেবার জন্য এসেছেন নাকি?’ সুপ্তি মৃদু হেসে বলল।
পথিক অঞ্জলি পেতে বলল, ‘তেষ্টায় অতিষ্ট মনভোমরা। এক আঁজলা মধু দাও, পান করে তুষ্ট হবে।’
সুপ্তি কপাল কুঁচকে বলল, ‘শুনেছিলাম ভোমরা গুনগুনি করে। আপনার মনভোমরা তেষ্টায় অতিষ্ট হল কেমন করে?’
পথিক বেজার হয়ে বলল,
ফুলে মধু থাকে জানি মধুমাসে মধুচুররা মধুচুরি করে,
বেচারা মনভোমরা, চুরিত গেলে হাতেনাতে ধরা পড়ে।
‘চিন্তার বিষয়।’ বলে সুপ্তি দোলনায় বসে দোল খেতে লাগল।
সুপ্তির রূপজেল্লায় ফুল কলিরা ঝলমল করছিল। মহুয়াগাছে হেলান দিয়ে বসে পথিক মন্ত্রমুগ্ধের মত বলল, ‘ফুলপরি, দোহাই এক জোড়া ডানা ধার দাও। তোমার সাথে আমিও উড়তে চাই?’
পথিকের ভাবভঙ্গিতে সুপ্তি কিছুটা চিন্তিত হয়ে দোলনা থেকে নেমে, ধীরে ধীরে হেটে ফোয়ার পাড়ে এসে; উঁকি দিয়ে স্বচ্চ জলে নিজের প্রতিচ্ছবিতে ডানা দেখে, অবাক হয়ে মুখের কাছে হাত এনে পথিকের পানে তাকিয়ে বলল, ‘বিম্ব হচ্ছে প্রতিবিম্ব, আমি এখন হতভম্ব।’
পথিক দু হাত প্রসারিত করে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
ফুলপরি, দোহাই দিচ্ছি যেওনা উড়ে,
কুঞ্জে উড়তে চাই তোমার হাত ধরে।
‘কথা দিলে হাত ধরব, নতুবা আড়াল হব ডনায় ভর করে।’ বলে সুপ্তি দুষ্টুহাসে হেসে ডান বাঁয়ে ডানার পানে তাকিয়ে ঝাঁপটাতে শুরু করল।
‘ফুলপরি, দু হাত প্রসারিত করলাম। বরণ করে হাত ধর, তোমার সাথে সব পেয়েছির দেশে যাবার ইচ্ছা অন্তরে।’ দু হাত প্রসারিত করে পথিক বলল।
‘ফুলপরি, ফুলপরি; আমি ফুলপরি।’ বলে সুপ্তি দু চোখ বন্ধ করে আকাশ মুখী হলে বাতাসে ভাসতে শুরু করল।
পরে আরো লম্বা এবং অনেক রদবদল করব।
পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
ফুলপরি, আপনাকেতো ধন্যবাদ দেওয়া যাবেনা, আপনাকে একটা রক্তজবা দিলাম।
ভুল বানান চোখে পড়লে মন্তব্যে লেখবেন দয়াকরে।
বকুল শিউলী কুড়ানো দিন আমার!
Click This Link
বাবুনি সুপ্তিদির লেখাটা পড়ে অনুপ্রেরিত হয়ে এই ছোট গল্পটি লেখাম। উনার পোস্ট পড়লেই বুঝতে পারবেন। গল্পে উনার নাম ব্যবহার করার অনুমতি উনি দিয়েছেন।
স্বত্ব মোহাম্মাদ আব্দুলহাক
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪১