বছর বারো-তেরো আগে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের এক পুনর্মিলনী আয়োজনের সাথে কিঞ্চিত সম্পর্কিত ছিলাম। ওই পুনর্মিলনীর স্যুভেনিরে ফাহাম আব্দুস সালাম নামে কুমিল্লা ক্যাডেটের এক প্রাক্তনের একটা লেখা প্রকাশিত হয়; যার শিরোনাম ছিলো 'এবার কিছু অপ্রিয় কথা হোক...'।
ব্যক্তি ফাহাম আব্দুস সালামকে না চিনলেও তাঁর লেখার সাথে আমি এর আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম তৎকালীন সাপ্তাহিক যায়যায়দিন'র কল্যাণে। তাঁর লেখা আমি পছন্দ করতাম। স্যুভেনিরে তাঁর লেখা দেখে জানলাম, তিনি কুমিল্লা ক্যাডেটের প্রাক্তন। ফাহাম এ দেশের ক্যাডেট কলেজের শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্যদ্যুতির কাছে ম্লান হয়ে যাওয়া ব্যর্থতা সম্পর্কে গতানুগতিক কথার বাইরে কিছু কথা বলেছেন। আমার কাছে ভালো লেগেছিলো বেশ।
সে হিসেবে এই লেখার ধারণাটি চুরি করা। সাহিত্যে যেটাকে প্লেইঝ'রিজম বলে। উপরন্তু, ব্লগডে'র মত আনন্দমূখর মুহূর্তে এ রকম অপ্রিয় কথা না বলাটাই দুরস্ত। তবুও আমার মনে হয় অপ্রিয় কথাগুলো শোনার সময় এখন হয়েছে, যেহেতু সামহোয়্যারইন ব্লগ ইতোমধ্যেই বাল্যকাল পেরিয়ে এসেছে।
সামহোয়্যারইন ব্লগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো এর ব্লগারদের ধরে রাখতে না পারা। বাংলাদেশে সামহোয়্যারইন ব্লগের শুরুটা একটা বিপ্লবের মতই ছিলো। ছাপা মাধ্যমে সম্পাদনার কঠিন নিগঢ়ে আটকে সে সময় অমিত প্রতিশ্রুতিশীল অসংখ্য লেখকের ঝরে পড়ার দৃষ্টান্ত বিরল ছিলো না। এ রকম এক সময়ে সামহোয়্যারইন ব্লগ একটা সম্ভাবনার জানালা খুলে দেয়, যেখানে যে কেউ চাইলেই উঁকি দিতে পারতো। সুনীল আকাশ দেখতে পারতো এবং যার যার সক্ষমতা অনুযায়ী আকাশে উড়তেও পারতো। ব্লগে প্রথম দিকের অসংখ্য শক্তিমান সৃষ্টিশীল লেখকের সমাবেশ সে বিপ্লবকে প্রায় সফল করে ফেলেছিলো। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই, সে সকল শক্তিমান লেখকদের সম্পৃক্ততা ধরে রাখার জন্য সামহোয়্যারইনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। এ জন্যই 'ব্লগটা আগের মতো নেই' বলে প্রায়শ ব্লগে হাহাকার শোনা যায়। অথচ বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিয়ে এইসব গুণী ব্লগারদের সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখতে পারলে এই ব্লগটা হতে পারতো এ দেশের সৃষ্টিশীল জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী একটা মাধ্যম।
সামহোয়্যারইন ব্লগ একদিকে যেমন ছাপা জগতের মত একমুখী রূঢ় যোগাযোগমাধ্যম নয়, অন্যদিকে ফেসবুকের মত ওজনহীন চটকদার বহুমুখী যোগাযোগমাধ্যমও নয়, বরং এ দুটোর মধ্যবর্তী ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে এই ব্লগ। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো ছাঁপা মাধ্যমের দীর্ঘযুগের ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয়তা ও আসক্তির পাশাপাশি স্বল্পতম সময়ে ফেসবুকও ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং আসক্তি তৈরী করেছে। কিন্তু মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা এই ব্লগের প্রতি ব্লগারদের আসক্তিও রয়ে গেছে সেই মধ্যবর্তী পর্যায়েরই। এ কারণে ব্লগাররা ব্লগ ছেড়ে যায় আবার যায় না। ফিরে ফিরে এসে উপস্থিতি জানান দিয়ে যায়, ন্যূনতম অফলাইনে থেকে অন্যের লেখাগুলো দেখে। এই ব্লগের অ্যাডমিনদের একজন ব্লগার 'কাল্পনিক_ভালোবাসা' একটা লেখায় বলেছিলেন 'ব্লগের প্রতিটা ব্যাচ মোটামুটিভাবে দুই বছর অ্যাকটিভ থাকে।’ কিন্তু কেন এমন হয়, সামহোয়্যারইনের এ যায়গাটায় মনোযোগ দেওয়া দরকার।
একইভাবে, এই ব্লগ পারতো সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতিশীল ব্লগারদের প্রতি আলাদা করে যত্ন নিতে। বৃশ্চিক নামে একজন ব্লগারের কথা এই মূহুর্তে আমার মনে পড়ছে। অসাধারণ গদ্যলেখক। ভাষার গাঁথুনী অনবদ্য। এ সময়ের কাউসার চৌধুরী অথবা নান্দনিক নন্দিনীর কথাও বলা যায়। অথবা রিফাত হাসান নামের জনৈক ব্লগার, যিনি সমসাময়িক বিষয়ে খুবই ভালো প্রবন্ধ লিখতেন। সেগুলো এ দেশের প্রথম সারির দৈনিকে উপসম্পাদকীয় হিসেবে অনায়াসেই যায়গা পেতে পারতো। হয়তো পাচ্ছেও। কিন্তু সেখানে সামহোয়্যারইনের উপস্থিতি থাকছে না। আমি জানিনা এ ধরনের আরো অসংখ্য ব্লগার কি স্বনামধন্য লেখক হিসেবেই ব্লগে এসেছিলেন, না কি সামহোয়্যারইন-ই তাঁদেরকে ভালো লেখক বানিয়েছে। যেটাই হোক, নিবিড় যোগাযোগ আর যত্নের মাধ্যমে এ রকম লেখকদেরকে সামহোয়্যারইন আলাদা এক্সপোজার দিলে তাঁরা সামহোয়্যারইনের সম্পদ হিসেবে থাকতে পারতো। অথচ এটা হয়নি।
যে সব মহাত্মনদের হাত ধরে সামহোয়্যারইন ব্লগ শুরু হয়েছিলো, তারা সবাই মোটামুটিভাবে টেকগুরু ছিলেন। এমনকি ওমর আল জাবির মিশোর মত বিশ্বসেরা টেকপিপলও ছিলো যদ্দুর জানি। একটা নতুন আইডিয়া হিসেবে শুরুতে সামহোয়্যারইন ব্লগ টেকনিক্যালি নিশ্ছিদ্রই ছিলো। কিন্তু আজ প্রায় ১৫ বছর পরও সামহোয়্যারইনে যে সব প্রযুক্তিগত খামতি রয়ে গেছে তা অমার্জনীয়। বিষয়ভিত্তিক ব্লগ কোটায় যে শিরোনামগুলো ঝুলছে, আদৌ কি ওগুলো রিলেভেন্ট এখন? 'নেপাল ভূমিকম্প, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ফেরি ট্রাজেডি, ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হাইতি, বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৪ (২০১৮ নয়)' বা এই ধরনের টপিকগুলো বহু আগেই অবসোলেট হয়ে গেলেও কার প্রেমে (অবহেলায়) ওগুলো এখনও ওখানে ঝুলছে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন ভালো জানেন। এটার পেছনে প্রাযুক্তিক সমস্যার চেয়ে অমনযোগিতায় হয়তো বেশি দায়ী, কিন্তু টেকনিক্যাল জটিলতা কিছু রয়েই গেছে অদ্যাবধি।
দীর্ঘদিন থেকে আমার ব্লগ খুললেই নামের পাশে একটা সংখ্যা দেখাচ্ছে, তার মানে আমার ব্লগ রিলেটেড কোনো নোটিফিকেশন আছে। সংখ্যাটি বাড়ে-কমে। কিন্তু ওখানে ক্লিক করলে বলে কোনো নোটিফিকেশন নেই। আমার মত অন্যদেরও নিশ্চয় প্রায়শই এ রকম হয়। আবার আমার লেখা কে কে পছন্দ করলো, সেটা আমি দেখতে পারি কিন্তু কে আমার লেখা প্রিয়তে রাখলো, সেটা দেখতে পারি না। এ রকম ছোটখাটো বিষয় যেগুলো অতিব দরকারী নয়, কিন্তু সামহোয়্যারইনের মত টেকগুরুদের তৈরী করা ব্লগে এ ধরনের অসামাঞ্জস্যগুলো থাকাও উচিৎ নয়।
সামহোয়্যারইন ব্লগে ব্লগারদের নাম নিয়ে একটা গুমোট ব্যাপার রয়েছে। ব্লগে রেজিস্ট্রেশন করার সময়ে সঠিক পদ্ধতি না জানা বা অন্যান্য অসংখ্য কারণে ব্লগারদের বিচিত্র বিচিত্র নাম দেখা যায়। পরবর্তীতে অনেকে নিজের নাম পরিবর্তন করতে চাইলেও প্রক্রিয়াগত জটিলতায় আর নাম পরিবর্তন করতে পারেন না। ব্রাত্য রাইসু ছদ্মনাম অলাদের অফ রাখতে চাই শিরোনামে একটা পোস্টও দিয়েছিলেন একবার। আমি যদিও তাঁর সাথে একমত নই, কিন্তু রেজিস্ট্রেশনের সময়ে ছদ্মনাম নিলেও অনেকে পরবর্তীতে স্বনামে আবির্ভূত হতে চায়। সে ক্ষেত্রে নতুন নামে আবির্ভূত হলে তাঁকে পুরোনো পাঠকরা কিভাবে চিনবে, সে বিষয়ে একটা সংশয় থেকে যায়। ফলে অনেকে চাইলেও আর নাম পরিবর্তন করতে পারেন না।
শাহাদাৎ হোসাইন (সত্যের ছায়া) নামে একজন ব্লগার আছেন; আমার ধারণা উনি এই সমস্যায় পড়েছেন। যদিও কোনোদিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তবুও মনে হয়, এই ব্লগারের আগের নাম ছিলো 'সত্যের ছায়া'। যে কারণে স্বনামে আসার পরও পূর্ব পরিচয় পরিস্কার করার স্বার্থে নামের শেষে 'সত্যের ছায়া' শব্দটিও ব্রাকেটবন্দী হয়ে রয়েই গেছে।
ভালোবাসার যায়গাতেই মানুষের যত আব্দার, যত অভিযোগ বা অনুযোগ, যত চাওয়া, সব সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। এটার একটা কারণ হয়তো মানুষ নিজের ভালোবাসাকে নিরেট, নিস্কলুষ দেখতে চায়। সামহোয়্যারইন ব্লগ আমার ভালোবাসার একটা যায়গা। সে যায়গা থেকেই আমিও চাই আমার এই ভালোবাসা বেঁচে থাকুক যুগ থেকে যুগান্তরে। সে যাত্রা মসৃণ হওয়ার জন্যই এই চাওয়া, এই অপ্রিয় উচ্চারণ। যদিও মোটাদাগে বলা আমার এই কথাগুলো শেষ বা শুরু নয়।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘মে-দিনের কবিতা’য় বলেছেন-
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
এটা মে মাস নয়, বরং বিজয়ের ডিসেম্বর। ফুল খেলবার দিনই এটা। তাই অপ্রিয় কথাগুলো সংক্ষিপ্ত করাই শ্রেয়। ব্লগ দিবস সফল হোক। শুভ ব্লগিং।
পাদটিকা:
যেহেতু এই লেখাটা ব্লগদিবসের প্রকাশনায় এসেছে সেহেতু এটা পোস্ট করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু হাবিব স্যারের ব্লগদিবসের স্যুভেনির পাঠ পতিক্রিয়ায় যে সব মন্তব্য এসেছে এবং ব্লগার সোহানীর যুগপুর্তির পোস্টে একই কনটেক্সটের লেখা দেখে মনে হলো লেখাটা দিই। যারা আগেই পড়েছেন তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:২৭