রাইটার’স ব্লক কাটানোর জন্য ভ্রমণ ব্লগ লেখা সবচেয়ে উপযোগী বলে আমার মনে হয়। কিন্তু সবাইতো আর সরাফত রাজ, আখেনআটেন, রিম সাবরিনা জাহান বা জুন না, যে দিন দুয়েক পরপর ট্যুরে যাবো আর সেটা লিখে ফেলবো! আমাদেরকে তাই অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী ট্যুরের জন্য; যেটা নিয়ে লিখে এই ব্লকেজ থেকে বের হতে পারি।
আমিও সেভাবেই অপেক্ষায় ছিলাম গেল সপ্তাহের কক্সবাজার ট্যুরের জন্য। এবার নিয়ে বোধহয় পনেরোবারের মত গেলাম। বিষয়টা এমন না যে সমুদ্র আমার খুব ভালো লাগে, আসলে আমার খুব কাছের বন্ধু রুপনের জন্যই ঘুরে ঘুরে কেবল কক্সবাজার যাই। কক্সবাজারে রুপনের মালিকানায় কয়েকটা হোটেল আছে, সেন্ট মার্টিনসে যাওয়ার শিপে ওদের মালিকানা আছে, এমনকি সেন্ট মার্টিনসে কাঠ দিয়ে বানানো ওর একটা কটেজও আছে। ফলে ঠেলে গুতায়ে কোনোভাবে কক্সবাজার বিচে গিয়ে পড়তে পারলেই খালাস! এর পর সব দায়িত্ব রুপনের।
কিন্তু এবার সেই রুপনের জন্যই ভ্রমণ ব্লগ না হয়ে লেখাটা হয়ে গেলো সাফল্যের পেছনে হারিয়ে যাওয়া কিছু কষ্টগাঁথা।
চট্টগ্রামের এক ধনী পরিবারের ছেলে রুপন আমার রুমমেট ছিলো যখন আমি ঢাকার একটা মাদ্রাসার হোস্টেলে থেকে আলিমে (ইন্টার) পড়তাম। তারপর আলিম শেষ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়লাম ওদিকে রুপন নিজ শহরে ফিরে গিয়ে স্থানীয় একটা কলেজে অ্যাডমিশন নিলো এবং বছর দুয়েক না যেতেই কক্সবাজারে হোটেল ব্যবসা শুরু করলো।
এ পর্যন্ত পড়ে খুব মসৃণ মনে হলেও বিষয়টা সহজ ছিলো না একদমই। প্রায় কুড়ি বছর আগে রুপন যখন কক্সবাজারে কাজ শুরু করে তখনকার কক্সবাজার এখনকার মত ঝাঁ চককচে-আলো ঝলমলে ছিলো না, পর্যটকদের পদচারণাও ছিলো নগণ্য। অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধার পাশাপাশি প্রশাসন এবং স্থানীয়দের অসহযোগিতার মুখে এ ধরণের ব্যবসা শুরু করা যথেষ্ঠই কঠিন ছিলো, বিশেষত রুপন যখন দেখতে আগাগোড়াই ছোটখাটো এবং খুবই হালকা গড়নের।
সে সময়ে এখনকার মত যোগাযোগসুবিধা না থাকলেও রুপনের সাথে আমার যোগাযোগটা থেকে গিয়েছিলো শুরু থেকেই। রুপন যখনই ঢাকা আসতো, নিকটাত্মীয়ের বাসায় না উঠে ও মুহসীন হলে আমার রুমে চলে আসতো। ক্যাম্পাসে আড্ডা দিতো আমাদের সাথে। এভাবে ক্যাম্পাসে আমার বন্ধুদের সাথেও একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো রুপন। একবার আমি বলাতে পহেলা বৈশাখের উৎসবে যোগ দিতেই ও ঢাকায় চলে এসেছিলো। তখন এগুলো খুব স্বাভাবিক মনে হতো। হ্যাঁ, একটা ছেলেতো চাইলে আসতেই পারে। কক্সবাজার থেকে ঢাকা আর কতই বা দুর!
আমার কিছুটা গর্ব ছিলো যে আমার একজন বন্ধু আস্ত একটা হোটেলের মালিক, যেখানে আমরা তখন মাসকাবারি মাত্র তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ করি। কিন্তু কখনওই মনে হয়নি যে রুপনের আমাদের কাছে চলে আসার পেছনে অন্য কোনো গল্পও থাকতে পারে। এখন বুঝতে পারি, আসলে ক্যাম্পাসে আমাদের উচ্ছল জীবনের কিছুটা ভাগ নিতেই রুপন আমাদের কাছে আসতো, যে সুযোগটা ও হারিয়ে ফেলেছিলো কৈশোর পার হওয়ার পরপরই কর্মক্ষেত্রে ঢুকে যাওয়াতে। আমরা ভাবতাম, বাপরে! এই বয়সেই এতবড় ব্যবসা, বিমানে যাওয়া-আসা.. .. আর রুপন ভাবতো, আহা, এদের কত আনন্দ, কত্ত স্বাধীনতা। ও তৃষিত চোখে দেখতো আমাদের উচ্ছলতা, বাধা বন্ধনহীন জীবন!
আমরা কখনওই ওর সফলতার পেছনের এই না পাওয়াগুলোকে দেখতে পাইনি অথবা দেখতে চাইনি। পেছনের এই অস্পষ্ট দৃশ্যগুলো দেখার চোখ তখন আমাদের ছিলোই না!
তারপর একদা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমরা যদ্দিনে কর্মজীবনের দরজায় দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলাম, তদ্দিনে রুপনের পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের ছোট্ট হোটেল দুই শতাধিক স্যুইটের বিশাল পাঁচ তারকা হোটেলে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামে তৈরী হয়েছে নিজেদের আবাসন ব্যবসা। সফলতার ঝলকে রুপনের জগত এখন কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ঢাকা ছাড়িয়ে গুয়াংজু-ব্যাংকক, কেএল-সিঙ্গাপুর, নিউই্য়র্ক-টরোন্টো বা লন্ডন-আমসটার্ডাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ব্যবসায়িক ব্যস্ততা রুপনকে আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বনাগরিক বানিয়ে দিয়েছে।
ক্যাম্পাসজীবন থেকে যখনই কক্সবাজার সেন্ট মার্টিনস গিয়েছি, বাধ্যতামূলকভাবে রুপনকে আমাদের সাথে লটকে নিয়েছি। রুপনও আগ্রহের সাথেই থেকেছে। একা বা ফ্যামিলিসহ। দলীয় আনন্দময়তার ভেতরে রুপনের অসম্ভব ব্যস্ততা বুঝে উঠতে পারিনি; বরং আমরা রুপনের উপস্থিতিতে নির্ভার থেকেছি সব দায়িত্ব বিনা দ্বিধায় ওর উপর বর্তিয়ে দিয়ে। এখন মনে হয়, আমাদের সাথে কাটানো সময়গুলো ওর জন্যও ছিলো কিছুটা সতেজতার, নিজেকে ছুটি দেওয়ার।
আগে যখন একাকি গিয়েছি, তখন রুপনের সাথে ওর স্যুইটেই থেকেছি, ওর ব্যস্ততা কম ছিলো তাই একসাথে ঘুরেছি, বিচে গেয়ে বসে থেকেছি। মাঝে দীর্ঘদিন দল ধরে যাওয়ায় ওভাবে আর একসাথে সময় কাটানো হয়নি। এবার দলছুটভাবে গিয়ে রুপনকে একা পাওয়া গেলো। এক রাতে গল্প করতে করতে শুনলাম ওর সংগ্রামের কথাগুলো। রুপন বলে চলেছে কি ভাবে সে দিনের পর দিন প্রায় একা এই ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের একটা একটা করে ইট গেঁথেছে, কি পরিমাণ প্রতিকুলতার মোকাবেলা ওকে করতে হয়েছে... ..
রাত বাড়ছে, রুপনের কথায় ক্লান্তি চলে আসছে। আমি অনুভব করি, সে ক্লান্তি শুধু সারাদিনের পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি নয়, বরং কিছুটা অসহায়ত্বেরও। এই অসাহয়ত্ব সফলতার চক্রের কাছে। যে চক্রে একবার ঢুকে পড়লে আর বের হওয়ার উপায় থাকে না। একটা বৃত্ত শেষ করেই অন্য আরেকটা বৃত্তে আটকা পড়তে হয়। আর সফলতার সেই চমকের কাছে ম্লান হতে হতে হারিয়ে যেতে থাকে সহজাত অনেক চাওয়া পাওয়া।
আমি আপনি যারা সফল হতে চাই তারা চাইলেই সবকিছু থেকে ছুটি নিতে পারি দুয়েক দিনের জন্য। আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুদের নিয়ে চলে যেতে পারি দুরে কোথাও, চাইলেই অঢেল সময় নিয়ে ব্লগ লিখতে পারি, চাইলে কিছু না করে চুপচাপ বসেই কাটিয়ে দিতে পারি অনেকটা সময়। কিন্তু রুপনের মত যারা সফল, তাদের কাছে সেই সুযোগ নেই। বিস্তর টাকা পয়সা, গাড়ি বাড়ির মালিক হয়েও আধো আধো বুলিতে বাবা বলতে পারা মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখার সময়টা থাকে না, কথাটাই বলতে হয় হোয়াটসআপ-এ, অনলাইনে ভিডিও কলে।
রুপনের ক্লান্তিজড়ানো গলায় বলা কথাগুলো তাই আমার ভ্রমণব্লগকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেলো অজানা কোনো এক সুদুরে।
কক্সবাজার নিয়ে ব্লগার সামিয়ার লেখা এখানে পড়তে পারেন, আমার মতে এটাই কক্সবাজার নিয়ে ব্লগের সেরা লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৯