এক:
শেষ যাত্রী হিসেবে বিমানে ওঠার মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। এর আগ পর্যন্ত যা হচ্ছিলো তাতে যাত্রা ক্যানসেল করার চিন্তাটাই প্রথম পছন্দ হয়ে যাচ্ছিলো বারবার।
প্রযুক্তি পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সেই কবেই, কিন্তু হাতের মুঠোয় আসার জ্বালাটা আজ টের পাওয়া গেলো বেশ! গুগল ম্যাপের কল্যাণে ইস্টার্ন বাইপাসে ব্যাপক যানজটের আঁচ পেয়ে উবার ড্রাইভার থার্ড অ্যাভিনিউ ধরে মাইল তিনেক যাওয়ার পর দেখা গেলো আঠারো চাকার এক লরি রাস্তার মাঝ বরাবর আড়াআড়িভাবে উল্টে পুরো রাস্তা ব্লক করে ফেলেছে.... ঘড়ির কাটা এদিকে আটটা ছুঁই ছুঁই। সর্বনাশ, নির্ঘাত ফ্লাইট মিস হবে!
তারপর থেকেই সায়ান ছুটছে।
ওই লরির কারণে, নাকি অন্য কোনো কারণে বোঝা গেলো না, বিমানবন্দরে লাগেজ স্ক্যানিং, ড্রপিং, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি চেকিং, সব জায়গাতেই অতিরিক্ত ভীড়। শেষ পর্যন্ত যখন সব শেষ করতে পারলো, তখন বিমানবন্দরের সাউন্ড সিস্টেমে সায়ান এর নামে ফাইনাল অ্যানাউনন্সমেন্ট চলছে যে, আর দুই মিনিটের মধ্যে রিপোর্ট না করলে সামবারিয়া এয়ারলাইনস এর ফ্লাইট নম্বর এসপিটি ১১৫ সায়ানকে রেখেই গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করবে....
এ রকম সময়ে বোর্ডিং ব্রিজ পার হয়ে বিমানের দরজায় পা রাখতেই এক মিষ্টি কন্ঠে আটকে গেলো সায়ান-
‘গুড মর্নিং স্যার’
ওয়াও! এ তো শুধু শব্দমালা নয়, যেনো উচ্ছল সংগীত। সায়ান একটু থমকে গেলো।
সামনে তাকিয়ে সায়ান দেখলো প্রায় তারই কাঁধ সমান লম্বা এক সদ্য তরুণী বিমানবালার বনলতা মুখ, যে মুখ দেখলেই বুকের ভেতরটা বাতাসশূন্য হয়ে যায়। সব কিছুই নতুন করে শুরু করতে ইচ্ছে হয়।
সুন্দর-সুশ্রী-আকর্ষণীয় হওয়া এবং সুন্দর করে কথা বলতে পারাটা বিমানবালাদের প্রাথমিক যোগ্যতা। এই যোগ্যতা পার হলে তাকে বোধহয় ধৈর্য্যধারণ, বিপদে স্থির থাকা, গলা না চড়ানো, পরিশিলিতভাবে প্রতিবাদ এবং সবসময় মুখে হাসি ধরে রাখা শেখানো হয়, বিমানবালাদের মুখে সবসময় হাসিই দেখি সাধারণত।
কিন্তু এই মেয়েটির মুখটা এমন বিষণ্ন কেনো? অবশ্য এ কারণেই মেয়েটিকে বেশিরকম মায়াবতি মনে হচ্ছে। হয়তো হাসলে তার এই মায়া আর থাকবে না।
সায়ান নিজের সিট ১৭এফ-এ বসেও ওই উচ্ছল সংগীত শুনতেই থাকলো, যেন কোনোদিনও থামবে না এই সম্ভাষণ বাণী।
দুই ঘন্টার বিমানযাত্রায় বিমানবালা বেশ কয়েকবারই করিডোর ধরে এদিক-ওদিক গেলো। প্রায় প্রতিবারই সায়ান নেমপ্লেটে তার নামটা দেখার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু নেমপ্লেটটা এমন যায়গায় গাঁথা থাকে যে বেশিক্ষণ ওখানে তাকানো যায় না, অশোভনীয় হয়ে যায়। তার উপর কয়েকবারই চোখাচোখিও হয়ে গেলো সায়ানের।
কিন্তু ও চোখে কোনো ভাষা ছিলো না। না প্রশ্রয়, না বিরক্তি। সায়ান একটু ভয়ই পেয়ে গেলো। বিমানবালার নামটা আর দেখা হলো না।
সায়ান জানালা দিয়ে মেঘের ভেলার দিকে মন দিলো। কানে হেডফোন।
বিমান ল্যান্ড করার আগ মুহুর্তে সায়ান আবছাভাবে আবার সেই কন্ঠ শুনলো- এক্সকিউজ মি স্যার...
সায়ান এদিকে ঘুরেই দেখে সেই বিমানবালা দাড়িয়ে আছে, নামটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, রুমিয়ান। এখন মুখটা হাস্যোজ্জ্বল।
সায়ান ভুল ভেবেছিলো। এই মেয়ের বিষণ্নমুখ যদি সৌন্দর্যের স্কেলে একশ’তে ৭৫ পায়, তাহলে হাসিমুখ নিশ্চিতভাবে একশ’ই পাবে। সায়ানের কানে তখন জেমস গেয়ে চলেছেন-
সুন্দরীতমা আমার,
তুমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে
বলতে পারো
এই আকাশ আমার...
নীলাকাশ রবে নিরুত্তর
মানুষ আমি চেয়ে দেখ
নীলাকাশ রবে নিরুত্তর
যদি তুমি বল আমি
একান্ত তোমার....
মেয়েটা সম্ভবত তাঁকে কিছু একটা বলছে। সায়ান হেডফোন সরালো।
মেয়েটি বললো- এই ফ্ল্যাইটটির মাধ্যমে আমাদের এয়ারলাইনস ১ লক্ষতম ফ্ল্যাইট পরিচালনা সম্পন্ন করলো। এ উপলক্ষে আমরা সব যাত্রীর জন্য একটা উপহার রেখেছি, প্লিজ এটা নিন।
সায়ান গিফট প্যাকটা হাতে নিলো। ঠিক ওই মুহুর্তে রুমিয়ানের চোখে চোখ পড়ে গেলো এবং মনে হলো যেনো ওর চোখ কিছু একটা বললো।
বললো কি? না কি অবসেশন...
রুমিয়ান ফিরে যাচ্ছে ককপিটের দিকে, পেছন থেকে ওর যাওয়া দেখছে সায়ান। কিছুদুর যাওয়ার পর হঠাৎই ঘুরে দাঁড়ালো রুমিয়ান এবং সরাসরি সায়ানের দিকে তাকালো। পরক্ষণেই আবার চলতে শুরু করলো। কিন্তু ওই এক মুহুর্তেই যেনো অনেক কিছু বলে ফেললো।
সায়ান দ্রুত প্যাকেটটা খুললো। ছোট ছোট কয়েকটা স্যুভেনিরের সাথে একটা গ্রিটিং কার্ড রয়েছে। কার্ডের এক কোণায় গোটাগোটা হাতে লেখা [email protected]।
সায়ান ঝট করে মাথা তুললো, কিন্তু রুমিয়ানকে কোথাও দেখলো না। ওর মনে তখন রবীঠাকুর হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছেন-
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে
সে দিন ভরা সাঁঝে,
যেতে যেতে দুয়ার হতে
কী ভেবে ফিরালে মুখখানি
কী কথা ছিল যে মনে ॥
এরপর সায়ান ভুলেই গিয়েছিলো সব।
বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন বাসার কম্পিউটারে বসতে গিয়ে সামবারিয়া এয়ারলাইনসের গ্রিটিং কার্ডটার উপর চোখ পড়ে সায়ানের। কি মনে করে একটা সম্ভাষণ মেইল লিখে সেন্ড করে [email protected] বরাবর। প্রায় সংগে সংগে পোস্টমাস্টার রিপ্লাই পাঠালো "Your message to [email protected] couldn't be delivered. 'rumian' wasn't found at sambaria.aro'।
সুতরাং, গল্পটাও এখানেই থেমে গেলো। অবশ্য এভাবে না থামলেও অন্য কোনোভাবেও এখানেই থামাতে হতো। কারণ আমার একজন নিবিষ্ট পাঠক আছেন, যিনি আমার সব লেখাকেই সত্যি এবং আমারই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে বিশ্বাস করে ফেলেন।
দুই:
আমি ফ্রিকোয়েন্ট ফ্ল্যাইয়ার নই। তবুও গত দশদিনে আমাকে তিনবার বিমানযাত্রা করতে হয়েছে। তিনটা ভিন্ন ভিন্ন এয়ারলাইনসে। ভারতবর্ষের এমাথা-ওমাথা।
এমনকি বিমানে উঠলে আমার একটু ভয় ভয় করে। উইন্ডো সিট পড়লেও তাই আমি বাইরে তাকাই না। সবসময় বিমানের ভেতরের সবকিছু দেখার চেষ্টা করি। লম্বা জার্নি হলে সেখানে অবশ্য দেখার বিষয়গুলো খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। শুধু বিমানবালাদের যাওয়া আসা চোখে পড়ে।
হ্যাঁ, বিমানবালা। আমার একটা বিষয় মাথায় আসলো। আচ্ছা, এই যে আমার বিমানে উঠলে ভয় করে, আরো অনেক যাত্রীরও নিশ্চয় তেমনই ভয় করে। বিমানবালাদেরও একই অনুভূতি হয়। ওদেরতো আর সপ্তাহে তিনটা জার্নিই শেষ নয়, চলতেই থাকে জীবনজুড়ে। ওরা তাই ভয় চেপে মুখে একটা হাসি ধরে রাখে। আর ভয় চেপে রাখার জন্যইতো ওরা বেশ ভালো মাইনে পায়।
কিন্তু শুধু কি মাইনে? হ্যাঁ শুধু মাইনেই। আজ পর্যন্ত আপনি নিশ্চয় এ রকম অসংখ্য সংবাদ শুনেছেন, দেখেছেন যে ‘পাইলটের দক্ষতায় যাত্রীসহ ১৫০ জনের জীবন রক্ষা’ অথবা ‘বিমান দুর্ঘটনায় পাইলটসহ ৭০জন নিহত’। কোনোদিন কি দেখেছেন এ সব ক্ষেত্রে বিমানবালা বা কেবিনক্রুদের কথা বিশেষভাবে লেখা হয়েছে? এই যে ইউএস বাংলার বিমানটার কথায় ধরুন, পাইলট আবিদ সুলতান এবং কো-পাইলট পৃথুলা রশিদের নাম সবার মুখে মুখে। অথচ ওই একই ফ্লাইটে চারজন কেবিন ক্রু ছিলেন, তাঁদের নাম কি কেউ জানেন? দুর্ঘটনাকালীন সময়ে নিশ্চয় তাঁদের মনের উপরও একই পরিমাণ চাপ ছিলো পাইলটদ্বয়ের মতই।
ইতিহাস অবশ্য একজন বিমানবালাকে অমর করেছে। আন্তদেশীয় সম্মান তিনি পেয়েছেন। তার পেছনে অন্য কারণ ছিলো। নীরজা ভানোত নামের এই ভারতীয় তরুণী প্যানঅ্যামের বিমানবালা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৬ এর ৫ সেপ্টেম্বর প্যানআমের নিউইয়র্কগামী ফ্ল্যাইট নম্বর ৭৩ করাচি বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতীকালীন সময়ে আবু নিদাল গ্রুপের সন্ত্রাসীদের দ্বারা হাইজ্যাকড হয়। এ সময় ১৭ বছরের নীরজা অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন।
প্রথমেই তিনি সন্ত্রাসীদের অগোচওে তিনজন ক্রুকে বিমান থেকে নামিয়ে দেন, ফলে বিমান করাচি বিমানবন্দর থেকে আর উড্ডয়ন করতে পারেনি। এরপর তিনি একইভাবে যাত্রীদের পাসপোর্ট সরিয়ে ফেলতে থাকেন যেন সন্ত্রাসীরা যাত্রীদের জাতীয়তা বুঝতে না পারে। সম্ভবত তারা আমেরিকান ও ইজরাইলিদের খুঁজছিলো। সবশেষে তিনি এমার্জেন্সি এক্সিট ওপেন করে দিয়ে যাত্রীদের পালাতে সাহায্য করেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান এবং সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
নীরজা পাকিস্তানের ‘তামঘা-ই-পাকিস্তান’ এবং ভারতের ‘অশোকচক্র’র মত উচ্চ পর্যায়ের সম্মাননা পদকসহ যুক্তরাষ্ট্র ও এবং পাকিস্তানের আরো কিছু সম্মাননা পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁর সম্মানে একটা স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছিলো। এছাড়াও ভারতে নীরজা ভানোত-প্যানঅ্যাম ট্রাস্টের পক্ষ থেকে নীরজা ভানোত অ্যাওয়ার্ডও দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে ভারতে নীরজার এই ঘটনাকে উপজীব্য করে একটা মুভিও রিলিজ হয়েছিলো।
এই ছাড়া আর কোনো বিমানবালা/কেবিন ক্রুকে কি ইতিহাস মনে রেখেছে? আমার জানা নেই।
গত সপ্তাহের লাগাতার বিমানযাত্রায় বিভিন্ন এয়ারলইনস এর কেবিন ক্রুদের দেখে আমার ওই গল্পের মত বিষণœই মনে হয়েছে। হ্যাঁ, প্রশিক্ষনের অংশ হিসেবে মুখে একটা হাসিও ঝুলে থাকে। কিন্তু সে হাসি যেনো কৃত্রিম, নিস্প্রাণ। ওই হাসির পেছনে হয়তো অন্য কোনো গল্প থাকে। যে গল্পে কিছুটা ভয়ের সাথে সাথে আবিদ-পৃথুলার পাশাপাশি নাম না আসার মত বেদনা, বঞ্চণার অধ্যায়ও থাকে হয়তো।
তবু সেই হাসি দেখেই আমরা ভরসা পাই, আপ্লুত হই।
প্রথম ছবিসূত্র
দ্বিতীয় ছবিসূত্র
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:৫৯