দীর্ঘ কষ্টকর এবং ক্লান্তিকর বাস যাত্রা শেষে যখন যশোরের এক নিরব নিভৃত পল্লীতে পৌঁছুলাম, মনে হলো যেন অন্য কোন গ্রহে এসে পৌঁছেছি। এ যেন এই পৃথিবীই নয়। চারিদিকে অসহ্য নিরবতা। মাঝে মাঝে নৈশব্দও কানে তালা লাগিয়ে দিতে পারে। দুরের কোন এক বাশঝাঁড়ে এই ভর দুপুরে থেমে থেমে একটা ঘুঘু ডেকে চলেছে। এবং তারপরেই নৈশব্দ আরো বাড়ছে।
এবছরে মধ্য আষাঢ়েও আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভরভর নেই। বরং সূর্যের উম্মত্ততা সবকিছুকে ঝলসে দিচ্ছে। এই নিরব পল্লীর মাটির রাস্তাও নিরবচ্ছিন্নভাবে আগুন ছড়াচ্ছে।
তবু এই কঠিনের মধ্যেও কোন এক ভয়ংকর সৌন্দর্য মনকে আর্দ্র করে দেয়। গ্রামের দক্ষিণে বিশাল যে জলাধারকে আমরা বাওড় বলি, সেখান থেকে দমকা হাওয়া এসে আগুন-রোদকে তাড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষণিকের জন্যে। ঢাকার সীসামেলানো বাতাস পেরিয়ে আমাদের দৃষ্টিসীমা নীলাকাশ অব্দি যেতে পারেনা। কিন্তু এখন গাঁয়ের এই ঝকঝকে নীল আকাশ দেখে প্রথমেই মনে পড়ল- আহা, কি সুন্দর!
এ রকম আকাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই হয়ত ক্যান্সারাক্রান্ত হুমায়ূন লিখছিলেন নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ।
প্রতিবছর মনে মনে ভাবি, ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরব না। দিনকে দিন এই যাত্রার সময় বাড়ছেই। ইদানিং স্বাভাবিক অবস্থাতেই দশ ঘন্টা লেগে যায়। আর যদি ফেরিঘাটের পরিস্থিতি খারাপ থাকে, তাহলে একমাত্র উপরওয়ালার একান্ত রহমত ছাড়া ঈদের আগে বাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারে। অথচ এই শতকের শুরুর দিকেও মাত্র সাড়ে চার ঘন্টায় যশোর থেকে ঢাকা পৌঁছানো খুব একটা অবাক ব্যাপার ছিল না।
তবুও আসতে হয়। এই নিশুথ গ্রামেই তো আমার মায়ের আবাস, আমার আবাস। মায়ের কাছে ফেরার আনন্দের কাছে সব কষ্টই তুচ্ছতর। ওই যে, হেমন্তের গান নিয়ে গ্রামীণ ফোনের টিভি কমার্শিয়ালটা মনে আছে না,
পথের ক্লন্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব
মাগো, বলো কবে শীতল হবো
কত দূর আর কত দূর
বল মা?
বাড়ি ফেরার পর থেকেই তাই ছুটি শেষে ঢাকা ফেরার বিষাদ মনে ভর করতে থাকে। একেকটা দিন পার হয় আর বাড়তে থাকে সে বিষাদ।
আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর আগে যখন বাসা ছেড়ে ঢাকা এসেছিলাম, তখন ঢাকা ছিল রহস্য ঘেরা রোমাঞ্চপোন্যাস। সেই রোমাঞ্চ রেখে বাড়ি ফেরার তাগাদা থাকতো না কোন। কিন্তু আজ সে সব রহস্য অবগুন্ঠনমুক্ত হয়ে আবার আমাকে নিয়ে এসেছে সেই মায়ের আচলেই। একদা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আমার মায়ের এখনকার চোখের নিরব ভাষায় থাকে আমাকে কাছে পাবার প্রবল আকুতি। আমি আবারও বিষাদাক্রান্ত হয়ে পড়ি। ঢাকা ফেরার ইচ্ছেটা আরো ফিকে হতে থাকে। জানিনা, এ রকম বিষাদ-জর্জর মনে মহাদেব সাহা লিখেছিলেন কি না-
বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুল করে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!
কবির সাথে আমিও তাকিয়ে থাকি শূন্যতার দিকে, সহস্র সহস্র বর্ষ ধরে। অগত্যা ঢাকা আমাকে ডাক দেয়। অমোঘ ডাক। রাজধানী থেকে দূরবর্তী এক গাঁয়ের স্নিগ্ধতা থেকে ফের চলে আসি শহরের উঞ্চতম দিনে। আবার শুরু হয় মন খারাপের একেকটা দিন....
(ছবিটি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৬