মানুষের চিত্ত-সন্ততি তার সহজাত প্রবৃত্তি। আমাদের সকল গুণ পূর্বজন্ম থেকে আসে এবং ভবিষ্যতের জন্মগুলিতে চলতে থাকে। চিত্ত মানে মন অথবা হৃদয় আর সন্ততি বলতে বুঝায় সন্তান, বংশাবলী। আমরা কোন গোত্রে জন্মাবো তার কর্মই আমাদেরকে নির্ধারণ করে দেয়। ব্যক্তির কর্ম এবং তাদের দ্বারা বিকশিত প্রবৃত্তির আধারে মানুষের পুনর্জন্ম অনেক প্রকার হয়ে থাকে। ক্রমাগত পুনর্জন্মগুলিতে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রাপ্ত সুখ অথবা দুঃখ কোনও ধরণের পুরস্কার অথবা শাস্তি নয়, বরং আচরণগত হেতু এবং নিয়মানুযায়ী সেই ব্যক্তির পূর্ব কর্ম সৃষ্ট-ফল।
আরণ্যক বসুর মতো আর যা কিছু হই বা না হই, পরের জন্মে তিতাস হবো, দোল মঞ্চের আবীর হবো, শিউলিতলার দুর্বো হবো। শরৎকালের আকাশ দেখার__অনন্তনীল সকাল হবো; এসব কিছু হই বা না হই, তোমার প্রথম পুরুষ হবো। মনে থাকবে?
রিইনকারনেশন অথবা পুনর্জন্মকে প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়জ্ঞানের মাধ্যমে প্রমাণ করা খুবই কঠিন। তবে এমন অনেক মানুষের উদাহরণ পাওয়া যায়, যারা নিজের পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করে থাকে আর তারা পূর্বজন্মের নিজের জিনিসপত্র অথবা পুরোনো পরিচিতদের চিনতে পারে। আমরা এর আধারে পুনর্জন্মের অস্তিত্বকে অনুমান করতে পারি, কিন্তু হতে পারে কিছু মানুষ এই অনুমানকে সন্দেহের চোখে দেখে, কেউ এটাকে কোনো কৌশল মনে করে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ মুভি নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়। পুনর্জন্মের ব্যাপারে আরও ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। জাতিস্মর ২০১৪ সালের সিনেমা, খুব বিখ্যাত হয়েছিলো তাই আশাকরি সবাই দেখেছেন। রিলায়েন্স এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজিত চলচ্চিত্রটি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি নামের উনিশ শতকের একজন পর্তুগিজ কবিয়ালের ওপর নির্মিত। এতে ঊনিশ শতক ও বর্তমান সময়ের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। স্পষ্টত দেখানো হয়েছে পূর্বজন্মের সৃতিগুলো একজন মানুষের উপর কীভাবে কাজ করে। লাইব্রেরীয়ান কুশল হাজরা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) একজন অদ্ভুত মানুষ। যিনি নিজেকে অ্যান্টনির পুনর্জন্মকারী বলে দাবি করেন। কুশল বিলাপ করে বলে যে আগের জন্মের দৃশ্য তাকে হামেশাই তাড়া করে বেড়ায় এবং ধীরে ধীরে বর্তমান জীবনের স্মৃতি কেড়ে নিচ্ছে। রোহিত (যীশু সেনগুপ্ত) প্রতিজ্ঞা করে তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে এবং তার বদলে কুশলকে আগের জীবনের ইতিহাস বলতে হবে। চলচ্চিত্রটি কবীর সুমনের "জাতিস্মর" গান দিয়ে শেষ হয়।
পুনর্জন্ম না থাকাটা প্রমাণ করতে চাইলে বৈজ্ঞানিকগণকে তার অস্তিত্ব না থাকার সত্যকে খুঁজতে হবে। শুধু এটা বলে দিলেই পুনর্জন্মের অস্তিত্ব না থাকা প্রমাণ হয়ে যায় না। পুনর্জন্ম নেই কারণ আমি নিজের চোখে দেখতে পাই না, এমন অনেক জিনিসের অস্তিত্ব নেই যেগুলো আমরা নিজের চোখে দেখতে পাই না কিন্তু সেগুলোর তীব্রতা অনুভব করা যায়। পুনর্জন্ম এমনই একটি বিষয় যা উপলব্ধ করার ব্যাপার।
পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদ বলতে জীবের মৃত্যুর পর পুনরায় কোনো দেহে জন্ম হওয়াকে বোঝায়। এটি একটি ধর্মীয় মতবাদ যা প্রধানত হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম সহ অনেক ধর্মের মানুষ এটি বিশ্বাস করে। এছাড়া ইহুদি ধর্মেও আত্মার পুনর্জন্ম নামে একটি বিশ্বাস রয়েছে। মোক্ষ বা মুক্তি বা ঈশ্বরের সাক্ষাত অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত পুনর্জন্মের এই ধারা চলতে থাকে এবং মোক্ষ প্রাপ্তির মাধ্যমে এই জন্মান্তরের সমাপ্তি ঘটে। জন্মান্তরবাদ বিশ্বাসের আরেকটি দিক হচ্ছে, এই বিশ্বাস অনুযায়ী প্রতিটি জীবন একই সাথে একটি পরকাল এবং পূর্বকাল। এই বিশ্বাস মতে, বর্তমান জীবন হল পূর্বজন্ম বা কর্মের ফল অনুযায়ী আত্মার কখনো সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না। আত্মাকে একটি নিত্য সত্তা হিসাবে দেখা হয়।
বিভিন্ন সময়ে নানা দার্শনিক এবং গবেষকগণ গবেষণা করলেও বৈজ্ঞানিকভাবে পুনর্জন্ম এর কোনো প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে সারা পৃথিবীতে যুগযুগ ধরে পুনর্জন্মের নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। রসিক্রুশিয়ানগণ মৃত্যু-পূর্ব অভিজ্ঞতা-প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মতই লাইফ রিভিউ পর্যায়ের কথা বলেন, যা মৃত্যুর ঠিক পরপরই কিন্তু নতুন জীবন শুরু এবং স্বর্গীয় বিচারের পূর্বে ঘটে। এই ঘটনাটি অনেকটা জীবনের চূড়ান্ত পর্যালোচনা বা চূড়ান্ত রিপোর্ট এর মত।
পুনর্জন্মের শেষ পর্ব কবে? প্রাচীনকালের অনেক সভ্যতাতেই জন্মান্তর স্বীকৃত ছিল। এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে আত্মার গমন এক জটিল বিষয়। তাকে বৌদ্ধ ধর্ম যেভাবে ব্যাখ্যা করে, তা এক বিরাট যুক্তি পরম্পরা। কারও যদি কোনও ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়, মৃত্যুর পরে সে প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়। এবং পরবর্তী জন্মের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'দেবযান' এই 'অপেক্ষা'রই কাহিন। জন্ম থেকে জন্মান্তরে পরিভ্রমণ করতে করতে আত্মা অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকে। প্রাথমিক জাতকগুলিতে সে পার্থিব সুখগুলিকে গুরুত্ব দেয়। পরবর্তী জন্মগুলিতে তার মধ্যে আধ্যাত্মচেতনার উন্মেষ ঘটে। আমাদের সত্ ও অসত্ কর্মগুলি আমাদের শরীরেই নিহিত থাকে। মৃত্যুর পরে তা আত্মার সঙ্গে সঙ্গে সেই সব কর্মের স্মৃতি যুক্ত হয়। এই স্মৃতিগুলির সঞ্চয়ই আত্মাকে জ্ঞানী করে তোলে এবং মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।
অনেকেই মনে করেন সৃষ্টির আদি-লগ্ন থেকেই মহাজগতের যাবতীয় স্মৃতি আমাদের দেহে সঞ্চিত রয়েছে। একে উপলব্ধি করতে পারাটাই 'আত্মোপলব্ধি'। এই উপলব্ধিই নির্বাণ বা মোক্ষের দিকে নিয়ে যায়। কেবলমাত্র মানুষেরই মোক্ষলাভ সম্ভব। মানবজন্মে পৌঁছতে গেলে আত্মাকে লক্ষ যোনি পরিভ্রমণ করতে হয়। যদিও মানবজন্মই সর্বশ্রেষ্ঠ। এখান থেকেই আত্মার পূর্ণ মুক্তি সম্ভব। আমাদের বুঝতে হবে, মানসিক ক্রিয়াকলাপের কোনো কিছু সহজাত থাকে না। বিভিন্ন অভ্যাস যা আমাদের বাধ্যতামূলক আচরণ গড়ে তোলে, ভবিষ্যতের জন্মে আমরা এমন শরীর ধারণ করব যা সেই অভ্যাসগুলি সম্পাদন করার জন্য উপযুক্ত আধার হিসাবে কাজ করবে।
পৃথিবীতে মানুষের কি পুনর্জন্ম হয়? কুরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলাম পুনর্জন্ম নিয়ে কি বলে? মানুষের পুনর্জন্ম হওয়ার আক্বিদা হিন্দুদের মূল প্রথা ছিল। এটি কোন মুসলমানদের আক্বিদা নয়। যারা এই আক্বিদা পোষণ করবে তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। কারণ এর দ্বারা কিয়ামত, কবর, হাশর, পুলসিরাত, জান্নাত ও জাহান্নামকে অস্বীকার করা হয়ে থাকে। যদি পুনর্জন্ম হওয়ার দ্বারাই বান্দার শাস্তি ও পুরস্কার নিহিত হয়, তাহলে কিয়ামতের কোন প্রয়োজন নেই। বরং পৃথিবী টিকে থেকেই পাপ পুণ্যের ফলাফল প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে।
পুনর্জন্ম আকিদাপন্থীদের মতে ভাল কাজ করলে মৃত্যুর পর সে ভাল পরিবারে ভাল অবস্থায় জন্ম নিবে। আর খারাপ করলে পরজন্মে খারাপ প্রাণী হয়ে জন্ম নিবে। এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ ইসলাম ধর্মের মতে পৃথিবী ধ্বংসই হবে পাপ পুণ্যের পুরস্কার ও শাস্তি প্রদানের জন্য। এই বয়ানের মধ্যে দিয়ে ইসলাম এককভাবে স্বতন্ত্র, মৌলিকত্ব বজায় রেখেছে। প্রথম উদ্ভাবিত আদিম মতবাদকে উপেক্ষা করে ইসলাম বলছে; মানুষের রূহ বেহেশতে ছিলো। শাস্তিস্বরূপ আমরা পৃথিবীতে অবস্থান করছি।
একজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করার পর সে প্রথমে কবরের জগতে থাকে, তারপর তাকে কবরের জগতেই আবার শাস্তির জন্য জীবিত করা হবে। হাশরের ময়দানে সে দেহসহ উঠবে। হিসাব নিকাশ হবে। তার আমল অনুযায়ী সে হয়তো জান্নাতে যাবে নতুবা জাহান্নামে যাবে। তাই পুনর্জন্মের আক্বিদা ইসলাম বিরোধী। মুসলিম ধর্মে বলা হয়েছে—মৃত্যুর পর আত্মা বেহেস্তে বা দোজখে যাবে। সুখ অথবা দুঃখ নির্ধারণ করবে আল্লার শেষ বিচারের দিন কেয়ামত পর্যন্ত। সহস্র বছর ধরে যত মানুষ মারা গেছে, সব ধর্মের সব মানুষের বিদেহী আত্মারই পুনরুত্থান হবে শেষ বিচারের দিনটিতে। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতে আমাদের সচেতনতার বাইরেও দৃশ্যমান পৃথিবী গড়ে উঠতে পারে। আর এই ব্যাপারে পদার্থবিজ্ঞানীরাও একমত পোষণ করেন।
প্রশ্ন হলো পুনর্জন্ম কি হয়? যদি হয়ও তাহলে কোন এক জীবের এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে যাওয়ার ভিত্তিটা কি? কি সেই জিনিস যা কোন একজনকে একটা জন্ম থেকে অপর একটা জন্মের দিকে নিয়ে যায়। এইটা বুঝতে হলে মানুষের আধ্যাত্মিক প্রযুক্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকতেই হবে। একটা মানুষ কীভাবে তৈরি হয়, সেই যান্ত্রিক প্রযুক্তির কথা বলছি। একজন মানুষের সব থেকে বাইরের পরিধিটা হলো ভৌত বা পার্থিব শরীর। যোগ বিদ্যায় সবকিছুকে শরীর হিসেবে দেখা হয়, কারণ, আমাদের পক্ষে এইভাবেই বুঝতে সহজ হয়।
শরীর তিনিটি মাত্রা বা ডাইমেনশন অথবা তিনটি স্তরের রূপে থাকে। যেমন পার্থিব শরীর বা ফিজিক্যাল বডিকে বলা হয় অন্নময় কোষ। অন্নময় কোষ মানে খাদ্য। এইটা হলো খাদ্যজাত শরীর বা ফুড বডি। পরেরটাকে বলা হয় মনোময় কোষ, যার অর্থ হলো মানুষিক শরীর বা ম্যান্টল বডি। তৃতীয়টিকে বলা হয় প্রাণময় কোষ বা প্রানীক শরীর বা এনার্জি বডি। পার্থিব শরীর, মানুষিক শরীর ও প্রানীক শরীর এই তিনটি ডাইমেনশনই হলো ভৌত বা ফিজিক্যাল। জীবনের এই তিনটি ডাইমেনশনই কর্মের ছাপ বহন করে চলে। কার্মিক গঠন যদি ভেঙ্গে ফেলা যায় তখন আত্মা বলে কিছুই থাকেন না, প্রত্যেকটা জিনিস সবকিছুর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।
মহা-সমাধি বা মহানির্মান বলতে যা উল্লেখ্য করা হয় তা হলো মানুষ ধীরেধীরে বুঝেতে সক্ষম হয় যে মূল চাবিকাঠিটা কোথায়, এবং কার্মিক কাঠামোটা তারা এমন ভাবে ভেঙ্গে ফেলে যাতে সত্যি সত্যি অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি মোটেও সহজ নয়। একটা উদাহরণ দিয়ে বলছি- যখন কেউ মারা যায়, আমরা বলি সেই লোকটা আর নেই, এইটা সত্য নয়। সেই ব্যক্তিটা আজ আর সে রকমভাবে নেই যেরকমভাবে আমরা তাকে জানতাম। কিন্তু সে অবশ্যই আছে। এখন যদি কার্মিক কাঠামোটা একশভাগ বিনষ্ট করে সে মারা যায় তাহলেই তার অন্তিম প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটবে। এইটাকেই মুক্তি বা মহা-সমাধি বলা হয়েছে। জীবন ও জন্ম মৃত্যুর প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া। মুক্তি মানে হলো শরীর ও মনের কাঠামো থেকে মুক্তি হয়ে যাওয়া। এই শরীর তো মাটির তৈরি, পৃথিবীরই একটা অংশ যা আমরা ধার করেছি। অণু পরমাণু সহ অবশ্যই আমাদের সবকিছু সুদ করতে হবে। তাই একমাত্র কর্মের দ্বারা সময়ের সদ্ব্যবহারই আমাদের সকল মুক্তির পথ খুলে দিতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১০:৩৭