চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের পশ্চিমে শেখ মুজিব রোডস্থ বাদাম আলীর মোড়ের উত্তরে পাঠান তলা মহল্লায় “চট্টগ্রাম জাতি তাত্ত্বিক জাদুঘর” অবস্থিত। লোহার সীমানায় প্রাচীর ঘেরা বিশাল একটি একতলা ভবন। প্রধান ফটকের ডান এবং বাঁ পাশে রয়েছে দুটি মনোমুগ্ধকর ভাস্কর্য, তারপর ফটক পেরিয়ে মূল ভবনে যেতে যেতেই দেখা মিলবে, নানান ধরনের দেশি-বিদেশি ফুল ও পাতাবাহারের বাগান। ভবনের ভেতরে রয়েছে টিকেট বিক্রয় কেন্দ্র এবং টিকেট বোর্ডের নোটিশ অনুযায়ী বিদেশিদের জন্য ২০০ টাকা, সার্কভূক্ত দেশের পর্যটকের জন্য ১০০ টাকা, বাংলাদেশী নাগরিকের জন্য ২০ টাকা, এবং মাধ্যমিক স্তর (হাইস্কুল) পর্যন্ত শিক্ষার্থী ৫ টাকা এবং ৫ বছরের শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ফ্রি করে, টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তারপর টিকেট কেটে ডানদিকে ঘুরলেই দেখা যাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের মনোরম মাচানঘর। বাঁ পাশের দেয়ালে আছে নিগ্রয়েড, ককেশয়েড, মঙ্গোলয়েড ও অস্ট্রালয়েডথ—এই চারটি প্রধান মানব ধারার প্রতিকৃতি। ভেতরে ঢুকার পর বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন আদিবাসী ও মৌল-গোষ্ঠী যেমন চাক, মুরং, লুসাই, পাংখো, বম, খুমি, হাজং, কোচ, দালু, মান্দাই, বোনা, কুকী, সাঁওত্ বাবুবলী, ওরা্ পলিয়া, এদের সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় নিদর্শন জাদুঘরে রাখা আছে। এছাড়া বাংলাদেশের জাতি তাত্ত্বিক নিদর্শনাবলী সাথে তুলনামূলক জ্ঞানলাভ এবং পর্যালোচনার জন্য বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশের জাতি তাত্ত্বিক নিদর্শন স্থান লাভ করেছে।
জাতি তাত্ত্বিক জাদুঘরের ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, ১৯৬৫ সালে 'সেন্ট্রাল ইতনোলজিক্যাল মিউজিয়াম অব পাকিস্তান' নামে জাদুঘরটি প্রথম পর্বের নির্মাণ কাজ শুরু করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। তবে ১৯৭৪ সালের আগ পর্যন্ত জাদুঘরটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিলোনা, তবে পরবর্তী ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ে এটি সকলের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৮ সালে প্রথম এই জাতি তাত্ত্বিক জাদুঘরটি সম্প্রসারণের কাজে পদক্ষেপ গৃহীত হয় এবং ১খ, ২খ, ৩খ এবং ৪খ নামে ৪টি নতুন কক্ষ নির্মিত হয়। পরবর্তী ১৯৮৫ সালে জাদুঘরটির পূর্বদিকে ২টি নতুন গ্যালারি (৩ ও ৪) সংযোজন করা হয়। সাপ্তাহিক ছুটি রোববার ছাড়া প্রতিদিনই এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে সরকার ঘোষিত সাধারণ এবং নির্বাহী আদেশে ছুটির দিন এটি বন্ধ থাকে।
জাদুঘরের কর্মকর্তার তথ্য সূত্রে ১.৩২ একর জায়গার ওপর মূল ভবনটি, বর্তমানে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে। কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ জাতি তাত্ত্বিক জাদুঘরটি দেখভালের জন্য ৩২টি পদ সংরক্ষিত আছে। তবে তার মধ্যে ১২ টিই রয়েছে শূন্য। স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে বৃহত্তর এই জাদুঘরটি রক্ষণাবেক্ষণে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমান ইন্টারনেটের অনলাইনে এই জাদুঘরটি সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে তেমন কোন তথ্য নেই। প্রচারের ক্ষেত্রেও রয়েছে চরম মাত্রার প্রশাসনিক অবহেলা, তাই অনেকে এ যাদুঘর সম্পর্কে জানেও না। জাদুঘরের অভ্যন্তরীণ কাজ সম্পাদিত হয় খুবই অনুন্নত প্রযুক্তির মধ্যমে। দর্শক কে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে প্রচারণায় কোন প্রকারের উদ্যোগ নেই বলেই হয়তো অগ্রগতির দিক দিয়ে অনেক খানি পিছিয়ে।
সর্বাংশে বলতে হয়, মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে “চট্টগ্রাম জাতি তাত্ত্বিক জাদুঘর” টি প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি তার লক্ষ্য অর্জনে আজও কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে পারেনি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি দুর্বলতার কারণে। তারপরেও সাংস্কৃতিক বিনিময়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর, জীবনযাত্রা ও আচার আচরণ সম্পর্কে বিশ্বপরিমন্ডলে বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই পর্যাপ্ত প্রকাশনা এবং ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দূরীকরণে যথার্থ উদ্যোগ এখন সময়ের দাবী।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:০৯