লেখাটা লিখতে প্ররোচিত হয়েছি মাইনুলের নিচের ব্লগটা পড়ে। মইনুলকে ধন্যবাদ।
Click This Link
জামাত বিষয়ক গালাগালি, তর্কবির্তক করতে যদি আমরা সাবালকত্ত্বের পরিচয় দিতে পারি তবে এই লেখা সার্থক বিবেচনা করা যাবে।
মইনুলের লেখাটার বিষয় হিশাবে নতুন নয়। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক গ্লানি জামাতের বিশেষ করে জামাতের তরুণ কর্মীদের ব্যতিব্যস্ত করে। আমি সেভাবেই দেখেছি। মইনূল লিখছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে জামাত বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে এবং বাংলাদেশে একটা শক্তিশালী দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দল হিসাবে আবির্ভুত হয়েছে। "জামাত বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে " -- এখান থেকেই জামাতের রাজনীতির রাজনৈতিক বিচার শুরু করা যেতে পারে। তবে তার আগে কোর্টকাচারির আইনী দৃষ্টিতে জামাতের রাজনীতির বিচার নিয়ে কিছু কথা শেষ করবো।
স্বাধীনতাযুদ্ধ, জামাত, যুদ্ধপরাধ ইত্যাদি বিষয়ে যেকোন আলোচনা প্রায় সবসময়েই আমরা প্রপাগান্ডার লড়াই হিসাবে থেকে যেতে দেখেছি, সিরিয়াস কোন আলোচনায় এর উত্তরণ ঘটেনি। রাজনৈতিক দিক অথবা সাংবিধানিক আইনী দিক - কোন দিক থেকেই পরিপক্কতা দেখিয়ে কোন আলোচনা তুলে আমরা প্রমাণ পারিনি যে ৩৮ বছর ধরে যে আবেগ প্রকাশ বা প্রপাগান্ডা করেছি এবার একে ছাড়িয়ে আমরা সাবালক জাতি হয়েছি; আমরা এখন রাষ্ট্র গঠন, এর রাজনৈতিক দল, সাংবিধানিক আইন নিয়ে কথা বলার মত বয়স্ক হয়েছি। আমাদের মধ্যে এখনও এই ধারণাই প্রবল - ও জা-আ-মাত? ওর কথা নিয়ে আর কী আলোচনা করবো!
প্রপাগান্ডার একটা দিক সব রাজনৈতিক দলের জন্য সবসময় গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষত ভোটের রাজনীতিতে। সিরিয়াস রাজনীতি বা মতাদর্শ তৈরীতেও একে খাটো করে দেখার কোন কারণ থাকতে পারে না। তবে প্রপাগান্ডা ওখানে শেষ কথা নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে পরাশক্তি বিষয়ক ঠান্ডাযুদ্ধের রাজনীতি সমাপ্ত হয়েছে। তবে ভুলে যাওয়া চলবে না ঐ ঠান্ডাযুদ্ধের বরাবর গুরুত্ত্বপূর্ণ মিত্র থেকেছিল জামাত। আজকের চিত্র ভিন্ন। আমেরিকান "সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের " রাজনীতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও পুরানো মিত্রের হিসাব উলটপালট হয়ে গেছে; ইসলামের নাম নিয়ে কোন সাংবিধানিক নির্বাচনী রাজনীতির প্রতিও আমেরিকানদের ভয় ঢুকে গিয়েছে। এর পররাষ্ট্র নীতি এখন জামাতকে এমনকি নির্বাচনী রাজনীতিতে দেখতে চায় কী না সে প্রশ্ন উঠেছে, সংশয়ে আছে। মিত্রের স্হান হারিয়ে ক্ষমতার করিডোরে জামাতের রাজনৈতিক ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে সত্য অথচ এর উপরই ভর করেই তো এতদিন জামাত সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষমতা তৈরীর রাজনীতি করে গিয়েছিল । দল হিসাবে টিকে থাকতে অতএব ব্যপক জনগণের কাছে যাওয়া ছাড়া এখন এর গত্যন্তর নাই। আবার গিয়েও নিজের গণভিত্তি-ক্ষমতার জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে কী না - এর উপর সবকিছু নির্ভর করছে । এখনই বলা মুস্কিল। তবে লক্ষণ বিচার করা যেতে পারে।
জামাতের রাজনীতি নিয়ে আমরা যদ্দুর হতে দেখছি তাকে বলা যায় কোর্টকাচারির আইনী দৃষ্টিতে জামাতের রাজনীতির বিচার। এতে সমাজের একটা রাজনৈতিক নয়, আইনী চোখ দাড় করানো গিয়েছিল ঠিকই যাকে যুদ্ধাপরাধ বলা হচ্ছে। তাও যে আবার খুব কাজের হয়ে উঠেছে বলা যাবে না, নানান কারণে। শুরুর দিকে ডকুমেন্টেশনের নামে শাহরিয়ার কবিররা যা করেছেন তা আসলে ঐ সময়ের পত্রিকার কাটিং সংগ্রহ ও সংকলন। তার উপর ভিত্তি করে আন্দোলনও হয়েছে। মনে করিয়ে দেই জামাতের রাজনীতির বিচারের এই পথ আইনী দৃষ্টিতে, ওর দিক থেকে। অর্থাৎ আমাদের কোর্টকাচারির আইনী চোখে বিচার পদ্ধতি মেনে বিচারক জামাতের রাজনীতিকে কী বলে - সেই বিচার। ঐ বিচার পদ্ধতি চলে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অথচ সাক্ষ্যপ্রমাণের বিষয়টাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেই ঐ পথ আমরা কেউ পছন্দ করেছি ; কোর্টের দৃষ্টিতে পত্রিকার কাটিং যে কোন প্রমাণ নয় সেই জ্ঞানটুকুও না রেখে জামাতের রাজনীতির বিচারে নিজেকে যোগ্য ভেবেছি। এই বালখিল্যতা আবেগ এমনই থাপ্পর খেয়েছে যে, রাজনৈতিক বিচারে নয় আইনী বিচারে উল্টা গোলাম আজমের নাগরিকত্ত্বের বিষয় সমাধান হয়ে গেছে। আর বিচারে হেরে জনগণের ক্ষোভ ভোটের বাক্সের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নীট লাভ ঘরে তুলে দেয়া ছাড়া কোন কাজে আসে নি। ইদানিং কালে আবার যুদ্ধাপরাধের দাবী আগের মত আন্দোলন ও পথে। এবার এর উদ্দেশ্য নিয়ে আরও প্রশ্ন ও সংশয় তৈরী হয়েছে, বিশেষ করে ঘাদানির সাথে ইন্ডিয়ার সম্পর্ক ওর পররাষ্ট্র (বাংলাদেশ) নীতি, সঙ্কটের সময় বাংলাদেশে চালের দাম উঠানামার ক্ষমতা ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দেওয়া, মঈনের সফর, ইন্ডিয়ান অব: জেনারেলদের দাওয়াত করে এনে তাদের দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ানো ইত্যাদিতে। আবার অন্যদিকে আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি এখন জামাতকে এমনকি নির্বাচনী রাজনীতিতে দেখতে চায় না বলে "যুদ্ধাপরাধের দাবী" তোলার মানে আমেরিকান "সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের " রাজনীতিতে বাংলাদেশকে সামিল করা ও রণক্ষেত্র বানানোর সামিল - এটা আর এখন জামাতের রাজনীতির বিচারের আইনী অর্থেও কোর্টকাচারির বিচার নয়।
ইতোমধ্যে পুরানো অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি আন্তরিকভাবে চাইলেও আইনী দিক থেকে জামাতের রাজনীতির বিচারের পথ কত অসম্ভব। তাসত্ত্বেও আবার যুদ্ধাপরাধের দাবী তুলে জনগণকে এর আগেও মত বিক্ষুব্ধ করতেও দেখছি। আমরা চাই না চাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাত বিষয়ক জটিলতা সমস্যা আছে। আমরা কিভাবে এর সমাপ্তি দেখতে চাই? সম্ভব না হলেও আমরা আইনী দিক থেকে জামাতের রাজনীতির বিচারের পথে যেতে দেখেছি। এর পরিণতি কী হয়েছে? একদিকে দাবী তুলে জনগণকে বিক্ষুব্ধ করা গেছে কিন্তু বিচারের ফল দেখে হতাশা আর গুপ্ত ক্ষোভ নিয়ে তাকে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। বিগত না হওয়া নির্বাচনের আগে, ২২ নভেম্বর রাস্তায় জামাত কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের উপর দাপাদাপি করে জিঘাংসা মিটানো গেছে সত্য। এটাই আমাদের বাড়ি ফিরা গুপ্ত ক্ষোভ আর হতাশার প্রকাশ নয় কী? বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাত বিষয়ক জটিলতা সমস্যা আমরা কি এভাবেই এর সমাপ্তি দেখতে চাচ্ছি? এটাই কী আমাদের কাঙ্খিত সমাধান না শরীর খুঁড়ে পুরানো ঘা কে দগদগে করা। এক '৪৭ এর দাঙ্গার রক্তের দাগ আমরা আজ ৬০ বছর পরেও মুছে ফেলতে পারিনি। প্রায়ই তা এখনও আমাদের যেকোন দুজনের মাঝে হানা দেয়। মানবিক জাতি হিসাবে দাড়াতে আগামিতে আরও কতবার পুরানো এই স্মৃতি আমাদের ব্যঙ্গ করবে কে জানে! অজ্ঞানে এরকম আরও পুনরাবৃত্তি হওয়ার আগে এবার আমরা যাই করি তা যেন আমরা সজ্ঞানে দায় নিয়েই করি, এই আমার বিনীত নিবেদন। আর একালের গৃহযুদ্ধের অর্থ কিন্তু অন্যরকম। একালে গৃহযুদ্ধের পরিণতি বিদেশী দখলদার বাহিনীর অথবা জাতিসংঘ শান্তিবাহিনীর আগমন। অনেকের কাছে ব্যাপারটা থ্রীলিং মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখা ভালো, ব্যক্তির দিক থেকে বিদেশে শান্তিবাহিনীতে চাকরি পাওয়া লোভনীয় হলেও কর্মদোষে যে জাতির ভাগ্যে শান্তিবাহিনী জুটবে তার মত দুর্ভাগা আর অভিশপ্ত জাতি দুনিয়ায় নাই।
আগে যেভাবে বলছিলাম, ইসলামের নাম নিয়ে কোন সাংবিধানিক নির্বাচনী রাজনীতির প্রতিও আমেরিকানদের আল-কায়েদা ভয় ঢুকে গিয়েছে। মিত্রের স্হান হারিয়ে ক্ষমতার করিডোরে জামাতের রাজনৈতিক ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে অথচ এর উপরই ভর করে এতদিন সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষমতা তৈরীর রাজনীতি করে গিয়েছিল জামাত। দল হিসাবে টিকে থাকতে অতএব ব্যপক জনগণের কাছে যাওয়া ছাড়া এর গত্যন্তর নাই। আবার গিয়েও নিজের গণভিত্তি-ক্ষমতা জায়গা করে নিতে সক্ষম হবে কী না - সেই প্রশ্ন রেখেছিলাম। আমি মইনুলকে আশ্বস্ত করতে চাই কোর্টকাচারির আইনী দৃষ্টিতে আপনার কথার বা জামাতের রাজনীতি বিচার এখানে করবো না। কিন্তু রাজনৈতিক বিচার করবো।
আপনি লিখছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে জামাত বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে - ১, এই মেনে নেওয়া মানে কী? এটা কী জামাতের দলীয় নীতিনির্ধারক স্তরের সভার প্রস্তাব ?
২, আপনি আমি জামাতের সমর্থক সদস্য হই বা না হই, আমাদের সকলের এটা জানা দরকার আছে। নইলে সমাজে কোন কোণেই এধরণের আলোচনা অর্থহীন হবে। পরিণতি হবে গালাগালি শব্দ প্রয়োগ, কারো ভোটের বাক্স ভর্তি। এইসব হতে বাধ্য।
৩, দলের নাম জামায়েতে ইসলামী বাংলাদেশ রাখার সিদ্ধান্ত যে সভায় নেয়া হয়েছিল ওখানে কী যুক্তি বা আলোচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল? জানতে হবে।
৪, আপনি লিখেছেন, ১৯৭০ সালে নির্বাচনে যখন আওয়ামীলীগ জয়ী হয় তখন জামাত পাকিস্থান সরকারের কাছে বার বার দাবী জানায় আওয়ামীলীগ কে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য - মানলাম সত্য কথা । কিন্তু নির্বাচিতকে ন্যায্য ক্ষমতা হস্তান্তর যখন করা হলো না বরং নিজের জনগণের উপর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে পাকিস্তানি শাসকের নির্মম অত্যাচার আর হত্যাযজ্ঞ চালালো তার প্রতিবাদের বদলে ঐ নিপীড়ক সামরিক শাসন ক্ষমতার অধীনে সরকারের অংশীদার হয়ে মন্ত্রীত্ত্ব নেয়ার সপক্ষে দলীয় সিদ্ধান্ত প্রস্তাব কী ছিল? কী ছিল এর যুক্তি?
৫, জামাতের এইসব নানান সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের মূল্যায়ন অবশ্যই হতে হবে। এরপর যদি মনে হ্য় ঐসব সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল তাও জনগণকে জানাতে হবে, যদি ভুল হয়ে থাকে তাও জনগণকে জানাতে হবে। নইলে দলের ভিতরের নিজের নৈতিক সঙ্কট কাটতে পারে না।
৬, বঙ্গবন্ধু খেতাব পাওয়া শেখ মুজিব মহানুভবতায় যদি ত্রিদেশীয় চুক্তিতে বলতে পারেন, বাঙালী ক্ষমা করতে জানে তবে তাঁর দূরদর্শী জাতি-পুনর্গঠনের আহ্বানে যে সাড়া দিতে পারে না ব্যর্থতার দায়ভার সম্পূর্ণ তার উপরই বর্তায়।
৭, আপনি লিখছেন, এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আর এই সিদ্ধান্ত নেবার পিছনে আরেকটা কারণ ও ছিল। বাংলাদেশের চারপাশে ইন্ডিয়া ঘিরে রেখেছে। এই অবস্থায় জামাত বা ইসলামী দলগুলি মনে করেছিল , বাংলাদেশ আলাদা হয়েগেলে হয়তো ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে দখল করে নিবে। যেভাবে ইন্ডিয়া - আজ বলার অপেক্ষা রাখে না আপনি বাংলাদেশের নাগরিক, অন্তত কাশ্মীর দখলের অর্থেও ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে দখল করে নাই। জামাতের এই মুল্যায়ন ভুল বরং এই ধরণের সাফাই গেয়ে রাজনীতি চালিয়ে যাবার কারণে জেনুইন ভারতের বাংলাদেশ নীতির বিরোধীতা সময়ে জনগণের কাছে সাম্প্রদায়িক প্রচারণার অভিযোগ থেকে বাচতে পারেনি।
৭, দলের সাথে দলের রাজনৈতিক অবস্হানের ভিন্নতা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, এমনকি তাতে দলীয় খুনোখুনীও ঘটে যায় কখনও কখনো। কিন্তু এই ভিন্নতার কারণে, নিজের জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ, অথবা জনগণের বিরুদ্ধে ঐ নিপীড়ক অস্ত্রধারী শাসক সরকারের মণ্ত্রীত্ত্ব - না, এটা রাজনৈতিক অবস্হানের ভিন্নতার সংজ্ঞার সীমা পার হয়ে রাজনৈতিক অপরাধ হয়ে গেছে।
৮, একাত্তরের যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল না। আকার ইঙ্গিতে যারা এমন মানে দেবার সুযোগ নিয়েছে তার পিছনে কম হলেও জামাতের অবদান আছে।
৯, না মইনুল আপনার এই পদ্ধতি আপনি, জামাত, ইসলাম বা বাংলাদেশ কাউকে সাহায্য করত পারবেন না। আভ্যন্তরীণভাবে হলেও জামাতকে নিজের ৭১ এর রাজনীতি দ্রুত মুল্যায়নে যেতেই হবে। এতে কিছু হলেও আলো যদি দেখা যায়, গেলেও যেতে পারে।