অভাবে নাকি স্বভাব নষ্ট হয় । কথাটি হয়ত এক সময়ে সত্য হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এখন আর সত্য না । এখন স্বভাব নষ্ট হয় ক্ষমতায়, অর্থে, প্রতিপত্তিতে । হাতে একটু ক্ষমতা এল তো বাকী সব বান্দির ফুত, হাতে একটু অর্থ এল তো বাকী সব ফহিন্নীর ফুত, হাতে একটু প্রতিপত্তি এল তো বাকী সব চোরের ফুত । যা মুখে আসে তাই বলে দেয় । এই হয়ে যায় ওদের স্বভাব । তো, স্বভাবের এমন গুণ(!) কি গরীবের মধ্যে দেখা যায় ? তাহলে অভাবে স্বভাব নষ্ট হয় কিভাবে ?
তো, স্বভাব নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের কিছু গবেষণার ফলাফল দেখুন আর জেনে রাখুন বিভিন্ন সব মানুষের বিচিত্র সব স্বভাব ।
১ ।
কিছু স্বভাবের মানুষ আছে সবসময় অন্য জনকে ছোট করে আনন্দ পায় ।
ধরেন আপনি বন্ধুদের মজলিশে আপনার নতুন প্রেমিকা সম্পর্কে স্তুতিগান গাইছেন । সে কত ভাল, তার পরিবার কত ভাল, কত বড় ফ্যামিলির মেয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি । ঠিক এই সময়ে আপনার এক বন্ধু বলে উঠল, “আরে এত ভাল হলে কি আর তোর সঙ্গে প্রেম করে”? ব্যস্ হোল ? দিল সব শেষ করে ?
খেয়াল করে দেখবেন আপনার বন্ধু বান্ধব কিংবা আপনার অফিসের কলিগদের মধ্যে এরকম এক আধজন থাকবেই যারা আপনাকে বা অন্যজনকে এমন ছোট করে আনন্দ পায় ।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এ স্বভাবের মানুষদের আত্মসম্মানবোধ থাকে না, আর অন্যান্যদের চেয়ে এদের আই কিউ তুলনামূলক ভাবে কম থাকে ।
আমি বলি কি ? এরা যদি কোন ভাবে একবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে উঠতে পারে, জীবনেও আর শ্বশুর বাড়ির লোকজন এদের বের করতে পারবে না । কারণ, এদের আত্মসম্মানবোধ নেই । আর আই কিউ কম থাকার কারণে এরা বউ আর শালীর পার্থক্যও বুঝবে না । সুতরাং ভেবে চিন্তে .........
২।
আচ্ছা, আপনি কি অন্যের রাগ দেখে আনন্দ পান ? যদি পান, তাহলে আপনার মজা পাওয়া এখানেই শেষ করুন । জানেন ? আপনি যে জন্যে এই আনন্দ পান তার মূল কারণ হচ্ছে আপনার শরীরে টেষ্টোষ্টেরন (testosterone) হরমোন নির্গত হচ্ছে বেশী !
এই টেষ্টোষ্টেরন হরমোনের আধিক্যের জন্য কিন্তু আপনি অল্প বয়সে টেকো হয়ে যাবেন । তখন দেখবেন অন্য জনেরা আপনাকে নিয়ে কেমন আনন্দ পায় । কি বললেন ? এ রকম কেন হবে ? আরে! পাপের শাস্তি মাথায় নেবেননা তো কোথায় নেবেন ?
৩।
কিছু স্বভাবের মানুষেরা সবসময় অন্যের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে । চিনুক আর না চিনুক, অন্যের সম্পর্কে বিভিন্ন আজে বাজে মন্তব্যে এরা যে কি আনন্দ পায় বুঝিনা ।
মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন এদের আত্মবিশ্বাস থাকে একেবারে কম !
আমি বলি কি ? এরকম মানুষ পেলে এদের কানে কানে একটু বলে আসুন যে, “ভাই/আপু, আপনার সম্পর্কে ঐ কথাটা শুনলাম(দরকার হলে বানিয়ে বানিয়ে), ওটা কি সত্য?” ব্যস্, এবার দেখুন ব্যাঙের লাফানো কাকে বলে !
৪।
কিছু মানুষের স্বভাব হচ্ছে, এরা যখন দেখে এদের দিকে কেউ লক্ষ রাখছে তখন এদের মত ভালো মানুষ আর হয় না । এরা তখন এতই ভালো হয়ে যায় যে, প্রস্রাব দরকার হলে প্যান্টে করে দেবে, তাও আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে না টয়লেটটা কোথায়, পাছে আপনি বিরক্ত হন !
ইস্, যদি প্রত্যেক চাকরীদাতাকে কানে কানে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে পারতাম এরা আর যাই হোক কাজের হয় না !
৫।
বিশ্বের নামকরা ইন্টারভিউয়াররা চাকরীর আবেদনকারীদের সামনা সামনি ইন্টারভিউ নেবার আগে প্রথম কাজটা কি করে জানেন ? প্রথমে বায়োডাটা বা সি ভি এর ইন্টারভিউ নেন । যার বায়োডাটা ওজনে ভারী বা তুলনামূলক আকর্ষনীয় ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সে আবেদনকারীর চাকরী হবার সম্ভাবনা কিন্তু বেড়ে যায় সেখান থেকেই ! সুতরাং চাকরীর বায়োডাটা তৈরী করবেন একটু চিন্তা ভাবনা করে, আর এ কাজে একটু সময় আর শ্রম দেবেন । মাথায় গেল ব্যপারটা ? না গেলে চাকরিও গেল ! ঐ সোনার হরিণ হয়েই থাকবে !
নামকরা ইন্টারভিউয়ারদের কিন্তু এটা একটা কমন স্বভাব ।
৬।
যারা কঠোর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবন পার করে তাদেরকে কনভিন্স করা অন্যান্যদের চেয়ে বেশী কষ্টকর । এমনকি যারা শক্ত চেয়ারে বসে কাজ করে কিংবা শক্ত বিছানায় ঘুমায় তাদেরও কিন্তু অন্যান্যদের চেয়ে কনভিন্স করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় ।
বলি, আমাদের বাপ দাদারা শক্ত কাঠের চেয়ারে বসে কাজ করত বলেই কি তাদের কোন কিছু মানাতে পারতাম না ? আর আমরা নরম গদির চেয়ারে বসে কাজ করি বলে সব কিছু মেনে নেই ? তাহলে তো আমাদের কোন দোষ নেই বাবা ! সব দোষ তো ঐ নরম চেয়ারের !
এ হচ্ছে কঠোর পরিবেশে বেশীদিন থাকার ফলে অর্জিত স্বভাব ।
৭।
মানুষের আরেকটা অদ্ভুৎ স্বভাব শুনেন, ধরেন আপনি কারও কাছে পাঁচ হাজার টাকা ধার চাইলেন, এখন সে আপনাকে টাকাটা দিতে পারে বা নাও দিতে পারে, ঠিক না ? দিতে পারলে দিবে, আর না দিতে পারলে মানা করবে বা হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিবে । এই তো ? এখন আপনি ঐ মানুষের কাছে টাকা না চেয়ে নামাজ পড়ে আপনার জন্য একটু দোয়া করতে বলুন তো ? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, তার যদি নামাজ পড়ার অভ্যাস না থাকে সে কখনই আপনার এ অনুরোধ রক্ষার জন্য নামায পড়ে আপনার জন্য দোয়া করবে না । আর শুধু দোয়া যে করবে না তা না, আপনাকে মানাও করবে না বা হাত জোড় করে ক্ষমাও চাইবে না ।
যে সাহায্য করতে কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, মানুষ সে সাহায্য করতে কম আগ্রহী হয় ।
আমিও বারবার ভেবে দেখেছি, কথাটা আসলেই ঠিক । তাই ঠিক করেছি এখন থেকে আর দোয়া চাইব না, টাকাই চাইব ।
৮।
এবারেও ঐ একই প্রসংগ, মানবিক সাহায্যের বিষয়ে বেশীরভাগ মানুষই ওয়াদা করতে পিছপা হবে না । একই সাথে বেশীর ভাগ মানুষই ওয়াদা পূরণও করবে না ।
৯।
মিথ্যা কথা বলার জন্য কিন্তু অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হয় । কারণ একই সাথে মিথ্যাটাও বলতে হয়, আবার একই সাথে সত্যটাও গোপন করতে হয় । এত সব চিন্তা করে মিথ্যাবাদী মিথ্যাবলার ক্ষেত্রে সহজ সরল শব্দগুলোই বেছে নেয় বেশী । আর আমরা সহজ সরল শব্দ গুলোকেই সত্য মনে করি ।
১০।
আকর্ষণীয় বাহ্যিক রুপ ও সততার মুখোশধারীরা সহজেই সাধারণ পাবলিকের আস্থা অর্জন করে । সাধারণ পাবলিকেরা সততার চেয়ে বাহ্যিক রুপ বেশী গুরুত্ব সহকারে নেয় ।
বলি, তা নেবে না ? বাহ্যিক রুপ তো দেখা যায়, সততা কি দেখা যায় নাকি ?
এ হচ্ছে পাবলিকের স্বভাব ।
১১।
ভোট বা ইলেকশনের সময় বেশীর ভাগ সাধারণ ভোটাররা মধ্য বয়স্ক ও সুদর্শন প্রার্থির দিকে আকর্ষিত হয় বেশী ।
আমার কি মনে হয় জানেন ? আমাদের দেশের ভোটারদের বেলায় মনোবিজ্ঞানীদের এ ফর্মূলা ঠিক খাটে না । আরে আমরা তো প্রার্থীর দিকে তাকিয়ে ভোট দেই না, আমরা মার্কার দিকে তাকিয়ে ভোট দেই । তা, প্রার্থী যেমনই হোক না কেন, আমাদের কিচ্ছু আসে যায় না ।
১২।
জীবনে ব্যর্থ লোকেরা সব সময় সফল ও ধনীদের আসাধারণ বুদ্ধিমান আর জ্ঞানী মনে করে ।
ভাই, আমিও তো তাই মনে করি । তারমানে আমি কি......?
১৩।
মানুষ নাকি যত অর্থের মালিকই হোক না কেন সে ততটুকু খুশী হয় না, যতটুকু খুশী সে তার কম্পিটিটরের চাইতে বেশী অর্থের মালিক হলে হয় ।
আজব তো, আমি তো এমনি এমনিই খুশী হই । আর আমার কোন কম্পিটিটরও নাই, তাহলে কি আমি মানুষ না ?
১৪।
মাঝে মাঝে কিছু মানুষ রেগে গিয়ে এত্ত হৈ চৈ, চিল্লা চিল্লি, মারামারি কেন করে জানেন ? পুরোপুরি অন্যের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য । এই দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য এরা যে কোন কিছু করে ফেলতে পারে । এ ধরণের মানুষরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অসৎ হয় ।
১৫।
ডিসিশন নেয়া যত কঠিন হয়, মানুষ ডিসিশন নেবার আগ্রহ ততটাই হারিয়ে ফেলে । বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যে স্টোর গুলোতে পণ্যের অপশন(option, model, variation) বেশী রাখা হয় সেখানে কাস্টমারদের ডিসিশন নেয়া ততই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । ফলে শুধুমাত্র ডিসিশন নেয়ার অভাবে তারা পণ্য ক্রয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের এ বিষয়টা নিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করা উচিত ।
১৬।
বেশিরভাগ মানুষই দ্রুত সিদ্ধান্ত পছন্দ করে না । এ সিদ্ধান্ত অন্যের হোক বা নিজেরই হোক । বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে দ্রুত সিদ্ধান্তের ফলাফল সন্তোষজনক হলেও তারা পরবর্তীতে এ সিদ্ধান্তে অসন্তষ্ট থাকে । তারা মনে করে আরেকটু সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে ফলাফলটা হয়ত আরও ভালো হোত ।
হুম্, দেখবেন যারা তড়িঘড়ি করে বিয়ে করে তারা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু এ সমস্যায় পড়ে থাকে । বিয়ের কয়েকদিন পরেই মনে করে আরেকটু চিন্তা ভাবনা করে বিয়ে করলে হয়ত আরও ভালো ছেলে বা মেয়ে পেতাম । আরে বাবা, এটা কোন চিন্তার বিষয় হোল ? আসল চিন্তার বিষয় যে অন্যখানে ! আপনার সংগী বা সংগীনি যে একই চিন্তা করছে না, তার গ্যারান্টি কি ?
১৭।
বিভিন্ন মানুষের কাছে রিস্ক এর সংজ্ঞা বিভিন্ন রকম । কেউ হয়ত মাটি থেকে ত্রিশ হাজার ফিট উঁচু হতে প্যারাস্যুট জাম্প করতে ভয় পায় না, কিন্তু সেই যখন বসের রুমে ঢুকেন তখন হয়ত ভয়ে কাঁপতে থাকেন । আবার দেখা যায় কেউ হয়ত বাঘের হুংকার শুনে ভয় পান না, কিন্তু বউয়ের হুংকারে জ্ঞান হারানোর দশা হয় ।
পরিশিষ্ঠঃ
এগুলোর বাইরে আরও একটা স্বভাব আছে, যে স্বভাবের প্রাণী গুলোকে আসলে মানুষ বলা যায় না । এদের কোন জানোয়ার বলে গালি দিলে আসলে সেই জানোয়ারকেই গালি দেয়া হয় । এদের আকার আকৃতি মানুষের মতই, কিন্তু মানুষ না । এদেরকে পিশাচ বলা হয় । এরা রাজনের মত অবুঝ নিষ্পাপ শিশুকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে ।
রাজন আমাদের ক্ষমা কর বাবা । তোর হত্যার বিচার চাওয়া ছাড়া আর কি করব বল ? তুই মৃত্যুর আগে আইনের আশ্রয় পাসনি, কিন্তু ওরা ঠিকই আইনের আশ্রয় পেল, আমরা ওদের পিটিয়ে মারতে পারলাম না । তুই এত পানি পানি করে কাঁদলি, ওরা তোকে একফোঁটা পানি দিল না, আর ওরা কিন্তু দিনের পর দিন তোর বাবা আর আমাদের পয়সার অন্ন ধ্বংস করে যাবে । এ কষ্টও বড় কষ্ট রে বাবা, অনেক বড় কষ্ট ।
চলবে-
এই সিরিজের অন্যান্য পোষ্টগুলিঃ
১। কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-১
২।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-২
৩।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-৩
৪।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-৪
৫।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-৫
৬।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-৬
৭।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-৭
৮।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-৮
১০।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-১০
১১।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-১১
১২।কত কিছু জানি নারে ? পাঠক নিজ দায়িত্বে হজম করিবেন-১২