শামচুল হক
রিপন আর দিলারার সম্পর্কটা এতদিন মামাতো ফুফাতো ভাইবোন হিসাবেই ছিল, কলেজে যাওয়ার পর সেটা ভালবাসায় পরিণত হলো। দুইজন একই কলেজে পড়ে। রিপন বিএ সেকেন্ড ইয়ার আর দিলারা আইএ ফাস্ট ইয়ার। এক পর্যায়ে দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠে। কলেজে উভয় উভয়কে একদিন না দেখলে তাদের যেন দিন কাটতে চায় না।
ঘটনাটি অনেকের চোখে পড়ে। উভয় পরিবারের মধ্যেও জানাজানি হয়। রিপনের পরিবার থেকে কোন বাধা না দিলেও দিলারার পরিবার থেকে বাধা আসে। রিপনের পরিবার সচ্ছল হলেও দিলারার পরিবার রিপনদের চেয়ে অনেক অবস্থাপন্ন। বাবা ঢাকার বড় ব্যাবসায়ী। দিলারার জন্য দামী কসমেটিকস কিনে দিতে দিলারার বাবা কার্পণ্য করে না। দিলারাকে ছোট থেকে যে পরিবেশে মানুষ করেছে সেই ব্যয়ভার বহন করার মত যোগ্যতা রিপনের নেই। তাই তার বাবার ইচ্ছা ভাল আয় রোজগার সম্পন্ন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবে।
বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী দিলারা রিপনকে আয় রোজগারের পথ দেখতে বলে। ব্যবসা ধরতে বলে। কিন্তু রিপন এতে রাজী নয়। তার ইচ্ছা লেখাপড়া করে মুদির দোকান দিলে লেখাপড়ার দাম পাওয়া যায় না। সে চাকরীই করবে এবং বিএ পাশ করার পর সৌভাগ্য বশতঃ ব্যাংকেই চাকরী পেল। চাকরী পাওয়ার পর রিপনের ইচ্ছা অনুযায়ী দিলারার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে দিলারার বাবা হা না কোন জবাব দিল না। তবে মেয়েকে আরো পড়াবে বলে জানিয়ে দিল। দিলারাকে পড়ানোর কথা বললেও তলে তলে সে দিলারার পাত্র খুঁজতে লাগল। একসময় পেয়েও গেল। ছেলে জাপানে থাকে। লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক। লেখাপড়ায় একটু কম। মাত্র অষ্টম শ্রেনী পাস। দিলারার বাবার কথা হলো ছেলের লেখাপড়ায় কি আসে যায়। ছেলের আয় রোজগারই সব। দিলারার জন্য যে ছেলে পেয়েছি সে অনেক টাকা আয় করে। অল্পদিনেই সে কোটি পতি হবে। মেয়ের টাকা পয়সার কোন অভাব হবে না, ভাল খাবে, ভাল পরবে, ভাল চলবে, ভাল থাকবে।
দু’দিন পরেই দুলাভাইসহ ছেলে দিলারাকে দেখতে আসল। দিলারা দেখতে সুন্দরীই বলা চলে এবং খুবই স্মার্ট। প্রথম দর্শনেই ছেলের পছন্দ হলো। ছেলের দুলাভাই মেয়ে দেখার সম্মানী হিসাবে দশহাজার টাকা মেয়ের হাতে গুঁজে দিল। মেয়ে দেখা শেষ হলে দুলাভাই মেয়েকে চলে যেতে বলল। দিলারার বাবা খাওয়া দাওয়ার অনেক আয়োজন করেছে। খাওয়া শেষে আলাপ আলোচনায় বরপক্ষের মেয়ে পছন্দ হয়েছে বলে জানালো। তাদের কোন দাবী দাওয়া নাই। উপরন্ত বিশ ভরি স্বর্ণ দিয়ে নিজেরা মেয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাবে। শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রীর খাওয়া-দাওয়াটা যেন ভাল হয় সেই অনুরোধ করে বিয়ের দিন তারিখ ধার্য করে গেল। যাওয়ার সময় মেয়ের হাতে আটআনা ওজনের আংটিও পরিয়ে দিয়ে গেল।
ছেলে অল্পদিন পরেই জাপানে যাবে, হাতে বেশি সময় নেই। দিলারার বাবা কয়েক দিন সময় চাইলেও বরপক্ষ সময় দিতে রাজী হলো না। তিনদিন পরেই বিয়ের তারিখ ঠিক হলো।
দিলারার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনেই রিপন দিলারার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু তার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারল না। বাবা মা তাকে কড়া নজরে রেখেছে। বাড়ির বাইরে বেরোতে দেয় না। বিয়ের ঘটক দিলারার দুরসম্পর্কের এক ফুফু। পরদিন দুপুরে এসে ফুফু দিলারার কাছে ছেলের অনেক প্রশাংসা করে গেল। ছেলের নামে এলাকায় অনেক জমিজমাসহ ঢাকার ইসলামপুরে একটা দোকানও আছে। সেটা এখন ভাড়া চলে। তারা দুই ভাই। ছেলে ছোট। বাবা মারা গেছে। দু’টা বোন ছিল অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বোনেরাও খুব ভাল চলে। সবাই স্বচ্ছল, ভাই-বোনদের কারো কোনো আর্থিক অনটন নাই। দিলারা খুব সুখেই থাকবে। তাছাড়া জাপান থেকে পাঠানো টাকা তো বিয়ের পর দিলারার হাতেই আসবে। লক্ষ লক্ষ টাকা নিজ হাতে খরচ করতে পারবে। ছেলে সম্পর্কে ফুফুর অর্থ বিত্তের মন গলানো বর্ণনায় দিলারার রিপনের প্রতি যে দুর্বলতা ছিল সেটা ভাটা পরে যায়। দিলারা নিজেও ছেলেকে স্বচক্ষে দেখেছে। দেখতে খারাপ নয়। যেমন সুন্দর তেমন স্মার্ট। রিপনের চেয়ে অনেক সুন্দর। রিপনের গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু এ ছেলে অনেকটা ফর্সা।
সারাদিন দিলারা ঘরের বাইরে বের হয়নি। শুয়ে শুয়ে নানা কিছু কল্পনা করেছে। রিপন আর জাপানের ছেলের অনেক তফাৎ খুঁজেছে। রিপনের চেয়ে এ ছেলের সাথে বিয়ে হলে তার ভালই হবে। অনেক টাকা পয়সা সে নিজ হাতে নাড়াচাড়া করতে পারবে। তার সাথে চালাফেরা করলে জুটি হিসেবে ভালই দেখাবে। কেউ খারাপ বলতে পারবে না। বান্ধবীদের চেয়ে সব দিক দিয়েই সে উপরে থাকবে। সব জায়গায় গর্ব করতে পারবে। অনেক হিসাব-নিকাস চিন্তা-ভাবনার পর রিপনের চেয়ে জাপানী ছেলেকেই বিয়ে করা উপযুক্ত মনে করল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল রিপনকে মন থেকে মুছেই ফেলবে। কল্পনায় রিপনকে নয় জাপানী ছেলের নানা ছবি আঁকতে লাগল।
রাতে খাওয়ার সময় দিলারার মা দিলারাকে অনেক উপদেশ দিল। মায়ের কথা বলার এক পর্যায়ে দিলারা বলল, মা, তুমি কি ছেলেকে দেখেছো?
মা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু আশ্চার্য হয়েই বলল, কেন, দেখেছি তো!
-- কেমন দেখতে মা?
-- দেখতে তো আমার কাছে খুব ভালই মনে হলো।
-- তুমি ভাল করে দেখেছো তো?
-- হা ভাল করেই তো দেখেছি। ছেলেটা আমার পায়ে হাত দিয়ে ছালামও করেছে। আদাব কায়দাও ভাল। কেন তুই কি দেখিস নি?
দিলারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল, দেখেছি।
-- তোর কাছে কেমন মনে হলো?
দিলারা মাথা নিচু করে বলল, তোমরা যা দেখেছ আমিও তাই দেখেছি।
-- তোর কি কোন সন্দেহ আছে, না কোন আপত্তি আছে?
-- না মা আমার কোন আপত্তি নাই। তোমরা যা ভাল মনে করেছো তাতেই আমি রাজি।
মা খুব খুশি হয়ে বলল, এই তো লক্ষী মেয়ের মত কথা বললি। ভাল মেয়েরা কখনও বাপ মায়ের অবাধ্য হয় না রে মা। তাছাড়া কোন বাপ মাই চায় না তার মেয়েকে খারাপ ছেলের কাছে তুলে দিতে। তুই দেখিস, সব দিক থেকে তুই সুখি হবি।
দিলারা মায়ের কথায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। দিলারার মনের ভাব ভাল মনে হওয়ায় মা খুব খুশি।
রাতে দিলারার মা দিলারার বাবাকে ঘটনাটা খুলে বললে দিলারার বাবা পাল্টা প্রশ্ন করল, তুমি ওর কথা বার্তায় কি বুঝলে?
দিলারার মা মুখে আনন্দ প্রকাশ করে বলল, ওকে খুব খুশিই মনে হলো।
দিলারার বাবা মুচকি হেসে বলল, ছেলেটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি অর্থবিত্ত। এমন ছেলে দেখে কোনো মেয়েই অখুশি হওয়ার কথা নয় দিলারার মা। আমি জেনে শুনেই এ ছেলের সাথে দিলারার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছি। এমন ছেলে দু’ চার দশ গ্রামের মধ্যে আর একটিও নাই।
রিপন দু’দিন হলো দিলারার সাথে দেখা করার জন্য খুব চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনভাবেই দেখা করতে পারছে না। দিলারার বান্ধবীদের দিয়ে কয়েকবার খবর দিয়েছে কিন্তু দিলারা বাড়ির বাহিরে একবারও যায় না। পরদিন সকালে দিলারা পাশের বাড়িতে তার এক বান্ধবীর সাথে বেড়াতে গেলো। মা তাকে আর না করে নাই। সেখানে রিপনের সাথে দেখা।
দিলারার দেখা পেয়ে রিপন খুব খুশি হলো। আগ্রহ নিয়ে বলল, দিলারা ভাল আছ?
-- হ্যাঁ ভাল আছি।
-- তোমার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?
-- হ্যাঁ, হয়েছে।
-- তুমি কি এ বিয়েতে রাজী আছ?
-- হ্যাঁ, রাজী আছি।
-- রিপন আশ্চার্য হয়ে বলল, কি বল তুমি! বিয়েতে রাজী আছ! তোমার কি মাথাটাতা ঠিক আছে না পাগোল হলে!
-- না আমার মাথা ঠিক আছে।
-- তুমি সত্যিই এ বিয়েতে রাজী আছ?
-- হা সত্যিই রাজী আছি।
-- তুমি কেমনে এ বিয়েতে রাজী হলে দিলারা?
-- বাবা মা বিয়ে ঠিক করেছে তাই রাজী হয়েছি।
-- বাবা মায়ের কথায় তুমি রাজী হলে তোমার মতামত নাই?
-- আমি বাবা মায়ের কথার অবাধ্য হতে পারবো না।
-- তাহলে তোমার কাছে আমার এতদিনের ভালবাসার কোন দাম নাই?
-- একসময় ছিল এখন নাই।
-- কেন, এখন আর নাই কেন?
-- বাবা মা যে ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে সে কোন ক্রমেই তোমার চেয়ে খারাপ নয় বরঞ্চ ভাল। তাই চিন্তাভাবনা করে রাজী হয়ে গেলাম।
-- তাহলে আমি এখন কি করব?
-- এটা তোমার ব্যাপার।
-- তুমি আমার চেয়ে ছেলের কোন দিকে ভাল দেখলে?
-- সব দিক দিয়েই।
-- যেমন?
-- যেমন ছেলে দেখতেও সুন্দর, টাকা পয়সাও ভাল, জাপানে থাকে সেদিক দিয়েও গর্ব করার মত।
-- আমিও তো এখন বেকার নই, আমিও তো এখন ব্যাংকে চাকরী করি, চলার মত টাকা পয়সা রোজগার করি?
রিপনের কথা শুনে দিলারা কিছুটা তাচ্ছিল্যভরেই বলল, রিপন ভাই, মনে কিছু করবেন না, আপনি যে টাকা রোজগার করেন সেটা আমার কসমেটিকস কেনার টাকাও না। কাজেই আপনার ঐ টাকা দিয়ে আমার ভরণ পোষণ তো দূরের কথা আমার মিনিমাম চাহিদাটাও পুরণ হবে না। আপনাকে বিয়ে করলে সারাজীবন কষ্ট করতে হবে। এসব চিন্তা করেই আমি এ বিয়েতে রাজী হয়েছি।
এতক্ষণ দিলারার সাথে রিপন কথা বললেও তেমন একটা কথার আঘাত মনে হয় নাই। কিন্তু এবারের কথায় যেন রিপনের বুকে কুড়ালের আঘাত পড়ল। তার হার্টবিট বেড়ে গেল। মুখের উপরে নিষ্ঠুরের মত এ কেমন কথা বলল? এর আগেও তো তার সাথে অনেক কথা হয়েছে। অনেক মান অভিমানও হয়েছে, কিন্তু কখনও তো এধরনের কথা বলে নাই। বেকার অবস্থায় রিপনকে শুধু বিয়েই নয় প্রয়োজনে গাছ তলায় থাকতেও রাজী ছিল। কিন্তু এখন এটি কি বলল? রিপন আর কথা না বাড়িয়ে শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, তাহলে তোমার এইটাই কি শেষ কথা?
দিলারা জবাব দিল, হ রিপন ভাই, এটাই আমার শেষ কথা।
রিপন উদভ্রান্ত পাগলের মত টলতে টলতে দিলারার সামনে থেকে চলে গেল। সে কল্পনাও করতে পারেনি দিলারা তার মুখের উপর এমন কথা বলবে।
দিলারার কলেজের বান্ধবী সীমা পাশেই দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছিল। রিপন চলে যাওয়ার পর সীমা এগিয়ে এসে দিলারাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি রে দিলারা, তুই হঠাৎ করে এমন পরিবর্তন হলি কি করে রে? যে রিপনকে একদিন কলেজে না দেখলে তুই পাগলের মত খুঁজে বেরিয়েছিস। সেই রিপনের মুখের উপর এমন নিষ্ঠুর কথা কি করে বললি রে?
দিলারা মাথা নিচের দিকে দিয়ে বলল, জীবনের বাস্তবতা নির্ধারন করতে গিয়ে অনেক কথাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলতে হয়রে সীমা। এ ভাবে কথা না বললে ও আমার পিছু ছাড়তো না।
চলেব---
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৫