শামচুল হক
মিনহাজ চলে যাওয়ার পর নুপুর মায়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি রে মায়া, তুই কি সত্যি সত্যি মিনহাজকে ভালোবাসলি না ইয়ার্কি করলি?
মায়া একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, হারে নুপুর, ওর সথে ঠাট্টা মশকরা করতে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি ওকে ভালোবেসে ফেললাম রে। ওর জীবনের করুণ কাহিনী আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে। বলতো আমি এখন কি করি?
পারুল বলল, তুই যে মিনহাজকে ভালোবাসলি দুইবছর হলো মিরনের সাথে ভালোবাসা করছিস সেটা কি করবি? মিরন একথা শুনলে তোকে মেরে ফেলবে রে। ও যে রাগী মানুষ।
-- সেটাই তো আমিও চিন্তা করছি রে। হঠাৎ করে এটা কি করে ফেললাম?
-- তোর প্রেমিক থাকতে হুট করে কেন তুই মাটি নিয়ে কিরে কাটতে গেলি?
-- আরে ছাগল, তুই কি মনে করেছিস আমি মিরনকে বাদ দিয়ে ভালোবেসেছি। মিরনকে আসল প্রেমিক রেখেই ওকে ভালোবাসলাম।
-- তাহলে মিরন তোর আসল প্রেমিক আর মিনহাজ তোর নকল প্রেমিক।
-- বুঝিস তো তাই?
-- খামাখা তুই মিনহাজকে ধোঁকা দিচ্ছিস কেন রে? ও তো তোর মত টাউট বাটপার নয়, ও তো সহজ সরল লোক। তুই অভিনয় করলেও ও তো সত্যি সত্যি তোকে ভালোবাসবে।
-- ভালোবাসলে বাসবে, ভালোবাসলেই যে তাকে বিয়ে করতে হবে এমন কোন শর্ত আছে নাকি? ক্লাস ফ্রেন্ড হিসাবে কাউকে ভালোলাগলে ভালোবাসতেই পারি তাতে এত চিন্তা করে লাভ আছে।
-- সেটা তুই ওকে আগেই বল, আমি তোকে ভালোবাসলেও বিয়ে করবো না।
-- সে দেখা যাবে। আগে কিছুদিন ওর সাথে অভিনয় করে দেখি না ও কেমন করে?
মিনহাজকে নিয়ে অনেক কথা বলার পরে একপর্যায়ে তারা যে যার মত উঠে চলে গেল।
ঔদিন থেকে প্রত্যেকদিন ক্লাসের পরে মায়া আর মিনহাজ একত্রে কিছুক্ষণের জন্য হলেও পাশাপাশি হাঁটাহাটি করে, প্রয়োজন হলে কোন নির্জন গাছতলে নিরিবিলি বসে কথাও বলে।
মিনহাজ মেধাবী ছাত্র, যদিও মায়া, পারুলদেরকে ভালোবাসার কথা বলেছে কিন্তু বাস্তবে সে তার সাথে প্রেমের আলাপ নয় বেশির ভাগ সময় পড়াশুনার ব্যাপারেই আলোচনা করে থাকে। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন নোটও লেনদেন করে থাকে। বাহ্যিকভাবে ভালোবাসার ভাব দেখালেও আসলে মায়া মিনহাজের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করছে। সেই অভিনয়টা পারুল, নুপুরের কাছেও করছে। ওরা মায়ার অভিনয় বুঝতে না পেরে তাদের ভালোবাসাকে সঠিক বলেই ধরে নিয়েছে।
এর দু’সপ্তাহ পরের ঘটনা। মিরন ক্যাম্পাসের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, এমন সময় পারুলের সাথে দেখা। মিরন নিজেই পারুলকে বলল, পারুল কেমন আছ?
মিরনের কথায় পারুল থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ভাল, বলেই বলল-- মায়ার সাথে দেখা হয়েছে?
-- না দেখা হয় নাই। এক সপ্তাহ হলো ওর সাথে দেখা হয় না। ও কি চলে গেছে না আছে?
-- না যায় নাই, তবে ও মনে হয় আপনার আর নাই।
-- কেন?
-- মায়া দুই সপ্তাহ হলো ক্লাসমেট মিনহাজের সাথে ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বাস না হয় ্ওইযে গাছের নিচে তাকিয়ে দেখেন, বলেই আঙুল দিয়ে দূরে গাছতলে দাঁড়ানো মিনহাজ এবং মায়াকে দেখিয়ে দিল।
মায়া মিনহাজ তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে।
মিরন প্রথমে কথাটি আমলে নেয় নি। হেসে হেসেই পারুলের কথার জবাবে বলল, তাই কি হয়? মায়া কখনই এমন কাজ করতে পারে না, এটা আমার বিশ্বাস। আমি ওকে দু’বছর হলো চিনি। পারুল, তুমি আমাদের ভালোবাসাকে পরীক্ষা করছো এটা আমি বুঝতে পেরেছি।
পারুল ঘাড় বাকিয়ে বলল, ঠিক আছে মিরন ভাই, আপনি আপনার বিশ্বাস নিয়ে থাকেন, আমি যা সত্য তাই বললাম, বলেই হনহন করে চলে গেল।
উপস্থিত ক্ষেত্রে পারুলের কথায় পাত্তা না দিলেও মনের ভিতর কেমন যেন সন্দেহ দেখা দিল। বিষয়টি পরখ করার জন্য মিরন লাইব্রেরীর পূর্বপার্শ্বে একটি গাছের নিচে দাঁড়িযে মিনহাজ আর মায়ার কথোপকথোন দেখতে লাগল। প্রায় দশমিনিট কথা বলার পর হাসতে হাসতে দুই জন দুইদিকে টাটা দিয়ে চলে গেল। ঘটনাটি দেখার পরে মিরন মায়ার সাথে আর দেখা করল না। মায়া বাস্তবেই মিরনকে ভালোবাসে কিনা তা দেখার জন্য অনুসরণ করতে লাগল।
দ্বিতীয় দিন ক্লাস শেষে মিরন একই দৃশ্য দেখতে পেল। সেদিনও মিরন মায়ার সাথে আর দেখা করল না। মনে মনে পারুলের কথাগুলো সত্যে পরিণত হওয়ার মত দৃশ্য অবলোকন করতে লাগল।
এভাবে প্রতিদিনই মিরন অনুসরণ করে মিনহাজ এবং মায়ার হাসাহাসি এবং কথা বলার দৃশ্য দেখতে লাগল। কিন্তু মায়ার সাথে দেখা করে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইল না।
কয়েক দিন পরে ক্যাম্পাসের সামনে মিরনের সাথে মায়ার দেখা। মিরন ইচ্ছা করেই মায়াকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। মায়া মিরনকে ডাক দিয়ে বলল, এ্যাঁই--, তোমাকে কয় দিন হলো দেখি না কেন?
মিরন কিছুটা রাগ রাগ ভাবেই বলল, হয়ত দেখার চেষ্টা করো না সেই জন্য দেখা হয় না। আমি তো প্রত্যেক দিনই ক্যাম্পাসে আসি এবং তোমাকেও দেখি।
মায়া কিছুটা আশ্চার্য হয়েই বলল, আমাকে প্রত্যেক দিন দেখো অথচ আমার সথে কথা বলো না কেন?
-- কারণ তোমার তো কথা বলার একজন জুটে গেছে। তাকে বাদ দিয়ে কি আমার সাথে কথা বললে ভাল লাগবে?
-- এসব কি বলছো?
-- যা সত্য তাই বলছি।
-- তুমি যা ভাবছো তা সত্য নয়।
-- তাহলে মিনহাজের সাথে যে প্রত্যেক দিন গাছ তলে কথা বলতে দেখি সেটা কি মিথ্যা?
-- না, মিথ্যা হবে কেন, সত্য।
-- তাহলে তুমিই বল মিনহাজকে পাওয়ার পরে আমাকে কি তোমার কোন প্রয়োজন আছে?
-- আছে।
-- কেন প্রয়োজন আছে?
-- মিনহাজ আমার ক্লাসমেট আর তুমি হলে অন্য কিছু।
-- তাহলে বোঝা গেল আমাকে নয় তুমি মিনহাজকেই ভালোবাস।
-- অবশ্যই ভালোবাসি তবে তোমাকে বাদ দিয়ে নয়।
-- একটা হৃদয় কয়জনকে দিবে হারামী?
-- তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?
-- তোমার সাথে আর কি ভাবে কথা বলবো?
-- তোমার আাচরণ আমার কাছে ভালো লাগছে না।
-- ভালো তো লাগবেই না, এখন তো তোমার ভালো লাগার মত একজন জুটে গেছে।
-- তোমার আজকের আচরণ আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কথা এই মুহুর্তে আমার মোটেও ভালো লাগছে না, বলেই মায়া হন হন করে চলে গেল।
-- মায়াকে দম্ভ নিয়ে চলে যেতে দেখে মিরণ রাগে গজরাতে লাগল এবং ভিতরে ভিতরে জ্বলতে লাগল। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মিনহাজের উপর।
বিকাল বেলা মিরন লাইব্রেরীর উত্তর পার্শ্বে কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়ানো ছিল। হঠাৎ দেখে মিনহাজ পাশ দিয়ে হেঁটে যাচেছ। মিনহাজকে দেখেই মিরনের মাথায় আগুন ধরে গেল। কর্কশ ভাষায় ডাক দিল, এই মিনহাজ এই দিকে আয়।
মিনহাজ মিরনের কাছে এসে বলল, মিরন ভাই কি আমাকে ডেকেছেন?
-- হা ডেকেছি।
-- কেন ভাই?
-- তুই আজ থেকে মায়ার সাথে আর কথা বলতে পারবি না।
-- কেন ভাই?
-- কেন টেন বুঝি না, বললাম কথা বলবি না।
-- কথা বললে সমস্যাটা কি ভাই?
কেন ভাই কি ভাই বলায় মিরণ অগ্নিমুর্তি ধারন করে বলল, হারামির বাচ্চা, আমি নিষেধ করতেছি তার পরেও তুই কেন কেন করছিস। বলেই নিচ থেকে একটা ভাঙা ইট হাতে তুলেই মিনহাজের মাথায় মেরে দিল। মিনহাজ ওরে বাবারে বলে একটা চিৎকার দিতে না দিতেই আরো দুই তিনবার মাথায় ইটের আঘাত করে বসল। মিনহাজ জ্ঞান হারিয়ে পরে গেল।
মিনহাজের চিৎকার শুনে আসে পাশের ছাত্রছাত্রীরা দৌড়ে এলো। মিরণ ততক্ষণে সরে পরেছে। ছাত্রছাত্রীরা ধরাধরি করে মিনহাজকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু জ্ঞান ফিরছে না। খবর মায়ার কাছেও চলে গেল। মায়া এ ঘটনার সময় ক্যাম্পাসে ছিল না বাসায় ছিল। খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে এলো। এসে দেখে পারুলসহ অনেকেই রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া কাছে আসতেই পারুল বলল, তুই এতক্ষণে আসলি? ওর তো অবস্থা ভাল নয় রে!
-- কেন?
-- এখনও জ্ঞান ফিরে নাই, যদি মারা যায় তবে কি হবে রে?
-- ওর ঔষধ পত্র দিয়েছে?
-- ওর তো টাকা নাই, আর টাকা থাকলেও ও তো কথা বলতে পারতেছে না, আমরাই কয়েক বান্ধবী মিলে কিছু টাকা দিয়েছি চিকিৎসার জন্য। ডাক্তার বলেছে আরো টাকা লাগবে।
-- কত টাকা লাগবে?
-- তাতো বলে নাই। এখন তুই যখন এসেছিস তুই নিজে গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখ।
মায়া রুমে গিয়ে ডিউটি রত ডাক্তারকে বলল, ওর চিকিৎসায় কত টাকা লাগবে?
ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, আপনার কে হয়?
-- আমার ক্লাসমেট।
-- ছেলেটার আত্মীয় স্বজন কেউ নাই?
-- কেন?
-- অনেক টাকা লাগবে তাই তার আত্মীয় স্বজন দরকার।
-- কত টাকা লাগবে বলেন আমি দিব?
-- এই মুহুর্তে আরো পাঁচ হাজার টাকা লাগবে।
ঠিক আছে আপনারা চিকিৎসা করেন আমি এক্ষুনি টাকা নিয়ে আসছি। বলেই মায়া রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে গেল। যাওয়ার সময় পারুলকে বলে গেল, পারুল-- আমি টাকার জন্য বাসায় চলে গেলাম, তুই একটু খেয়াল রাখিস।
মায়া বাসায় গিয়ে নিজের হাত খরচের যা টাকা ছিল সব নিয়েও মায়ের কাছ থেকে আরো দুই হাজার টাকা নিয়ে এলো। মায়ের কাছে টাকা চাইলে মা জিজ্ঞেস করল, টাকা দিয়ে কি করবি?
মায়া শুধু বলল, মা জরুরী দরকার। তাড়াতাড়ি টাকা দাও, এক্ষুনি ক্যাম্পাসে যেতে হবে।
মা মনে করেছে হয়তো ক্যাম্পাসে কোন দরকার এইজন্য টাকা চেয়েছে। টাকা নিয়েই মায়া সোজা হাসপাতাল চলে এলো। ডাক্তারের হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলল, ওর কেউ নেই, আপনাদের নিজের দায়িত্বে ওর চিকিৎসা করতে হবে। টাকা যা লাগে আমি দিব।
ডাক্তার কিছু বুঝতে না পেরে বলল, কেন, ওর বাবা মা নেই?
মায়া বলল না, ওর বাবা মা দু’জনেই মারা গেছে। এখন ও টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালায়।
-- আপনি যে ওর চিকিৎসার খরচ বহন করবেন আপনার সাথে ওর সম্পর্ক কি?
-- কোন সম্পর্ক নেই, ও আমার ক্লাস মেট। ওর অসহায়ত্বটা আমি জানি। জেনেশুনে ও বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে এটা বিবেকে লাগছে, এই জন্য ওর খরচ বহন করছি।
ডাক্তার মায়ার মানবিকতা দেখে বলল, ও বুঝতে পেরেছি, ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার সহযোগীতার হাত দেখে খুশি হলাম। পৃথিবীতে অসহায়রা কারো না কারো সহায় নিয়েই বেঁচে থাকে। আপনিও সেই কাজটিই করছেন। আপনার সহযোগীতার সাথে যতটুকু সম্ভব আমিও সহযোগীতা করে যাবো। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
মায়া ডক্তারের সাথে কথা বলে বাইরে চলে এলো। পারুল বাইরেই বসা ছিল। মায়া পারুলকে জিজ্ঞেস করল, তুই কত টাকা দিয়েছিস?
পারুল বলল, আমার কাছে যা ছিল সবই দিয়েছি। এ ছাড়া হেনা, চম্পা, কোহিনুর, লাইজু ওরাও দিয়েছে। সোহেল, কাশেম, বাবুল ওরাও এসেছিল। ওরাও ওদের পকেটে যা ছিল দিয়ে গেছে। আমার টাকা ওদের টাকা একত্র করেই প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধ পত্র কিনে দিয়েছি। বাবুল খুব সহযোগীতা করছে, ও বলেছে প্রয়োজনে আগামী কাল ক্লাসের সবার কাছ থেকে টাকা তুলে দিয়ে যাবে।
পারুলের কথা শুনে মায়া কেঁদে দিয়ে বলল, মিরন এমন একটা জঘন্য কাজ করলো পারুল! এখন ওর প্রতি আমার ঘৃণা হচ্ছে। ও একটা মানুষ নয় জানোয়ার। মিহনহাজকে আঘাত করার আগে ওর বোঝা উচিৎ ছিল, আমি সত্যিই তাকে ভালোবাসি কিনা। যাচাই না করেই একটা নিরীহ মানুষকে আঘাত করাটা মোটেই সহ্য করতে পারছি নারে পারুল। এরজন আল্লাহর গজব পরবে রে পারুল।
আল্লাহর গজব পড়বে কথাটি শুনে পারুল মুখটা কালো করে ফেলল, কারণ মিরনকে উসকে যে সেই দিয়েছে। সে উসকে না দিলে মিরন হয়তো এত জঘন্য কাজ করতো না। কিন্তু পারুলও বুঝতে পারে নাই মিরন এরকম একটা ঘটনা ঘটাবে। সে মনে করেছিল মিরন হয়তো মায়াকে চাপ দিবে মিনহাজের সাথে কথা না বলার জন্য, কিন্তু মিরন মায়াকে রেখে মিনহাজকে আঘাত করে বসবে এটা তার কল্পনায় ছিল না।
মায়া কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, পারুলরে-- যে কোন উপয়েই হোক মিনহাজকে বাঁচাতে হবে রে। তা না হলে আমরা পাপের মধ্যে পরে যাবো। আমার জন্যই তো আজ ও মরতে বসেছে। আমি অভিনয় না করলে মিরন ওকে কোনদিনও মারতো না। সামন্য পরিহাস করতে গিয়ে কি পরিণতি হলো বুঝতে পারলাম না। কিন্তু ওর চিকিৎসার এত টাকা আমি এখন কিভাবে যোগাড় করবো। টাকার কথা তো বাবাকেও বলতে পারছি না মাকেও বলতে পারছি না।
পারুল বলল, তুই যদি পুরোপুরি টাকা যোগাড় করতে না পারিস প্রয়োজনে আমি আমার কানের স্বর্ণের দুল জোড়া বিক্রি করে দেব। তাও ওকে বাঁচাতে হবে রে।
--তুই কেন টাকা দিবি। তোর জন্য তো ও বিপদে পড়ে নাই, পড়েছে তো আমার জন্য।
-- তুই বুঝবি না মায়া, এই ঘটনার সাথে যে আমিও জড়িত।
পারুলের কথায় মায়া মনে করেছে, যেহেতু পরিহাস করার সময় পারুল উপস্থিত ছিল এইজন্য হয়তো পারুল নিজেকে এই অপরাধের অপরাধী মনে করছে। আসলে সে যে এই ঘটনার কুচক্রী হিসাবে কাজ করেছে এটা তো মায়া জানে না, এজন্য সব দোষ মায়া নিজের ঘাড়েই চেপে নিচ্ছে।
মায়া বলল, তুই যদি কানের দুল বিক্রি করতে পারিস আমিও আমার মায়ের দেয়া হাতের বালা বিক্রি করে দিবো তবুও মিহনহাজের চিকিৎসার ত্রুটি হতে দেবো না রে।
ওরা দুইজন কথাপোকথোন করা অবস্থায় নার্স এসে বলল, রুগীর জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা এসে দেখা করতে পারেন। তবে সাবধান রুগীর সাথে এই মুহুর্তে কোন কথা বলবেন না। একটু পরে মাথায় একটা সিটি স্ক্যান করতে হবে।
মায়া পারুল দুইজনেই একসাথে রুমে গেল। মিনহাজ চোখ মেলে আছে। কাছে যেতেই মায়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো। তার অসহায় মায়া ভরা চোখে তাকানো দেখে মায়ার চোখ জলে ভরে গেল। দু’ফোটা জল গাল বেয়ে নিচে নেমে গেল। ভিজা চোখে ধরা গলায় বলল, তুই চিন্তা করিস না রে মিনহাজ, আমি যে করেই হোক তোর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে যাবো।
মায়ার কথা শুনে মিনহাজের দুই চোখ ছলছল করে উঠলেও কোন কথা বলতে পারল না। মায়াময় ভিজা চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে দেখে মায়া, পারুলও চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কাঁদতে লাগল। রুগীর সামনে তাদের কাঁদতে দেখে ডাক্তার কিছুটা রেগে গেল। তাদের আবেগী কান্নায় রুগীর যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেই চিন্তা করে দুইজনকেই রুমের বাইরে বের করে দিল।
একটু পরেই ট্রলিতে করে শোয়ানো অবস্থায় সিটি স্ক্যান রুমে নিয়ে গেল। সিটি স্ক্যান করে ফিরে এলে মায়া ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল, মাথায় কি খুব মারাত্মক জখম হয়েছে?
ডাক্তার বলল, হ্যা জখম টা খুব মারাত্মকই বটে, তবে এতটুকু রক্ষা যে মাথার হাড় ভাঙলেও ব্রেনে খুব একটা আঘাত পড়ে নাই। আমরা এখন ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াবো। আপনারা একজন ওর কাছে বসে থাকবেন?
রাত তখন নয়টা বাজে। মায়া খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তার পক্ষে তো থাকা সম্ভব নয়। এখানে এভাবে অনাত্মিয় একজন যুবকের কাছে রাত কাটালে বাবা মা দু’জনেই ক্ষিপ্ত হবেন। ভেবে চিন্তে কোন কুল পাচ্ছে না। অবশেষে পারুলকে বলল, পারুল রে, ওর কাছে একজন লোক থাকা দরকার, কাকে রাখা যায় বলতো?
পারুল বলল-- তুই থাক না কেন?
মায়া বলল -- আমি থাকতে পারছি নারে। আমার বাবা, মা তো এসব কাহিনী জানে না, জানলে তারা মহা ক্ষেপে যাবে। তাছাড়া মেয়ে হয়ে এখানে একা একা থাকাটাও সমস্যা, দেখতো কোন ছেলে টেলে যোগাড় করা যায় কিনা।
এমন সময় একজন আয়া এসে বলল, আপা আপনাদের কোন কিছু লাগবো? লাগলে বইলেন আমি আইনা দিমু।
মায়া বলল, আপনি কি সারা রাত থাকতে পারবেন?
-- না আপা, আমি হেই বেয়ান বেলা আইছি, হারা দিন বাড়ি যাই নাই, একটু পরে বাড়ি চইলা যামু।
-- আপনি যদি না থাকতে পারেন তাহলে আমাদের একজন মহিলা যোগাড় করে দিতে পারবেন, যে সারা রাত থাকতে পারবে?
-- আপা আপনারা যদি আমারে খুশি করেন তাইলে কষ্ট হইলেও আমিই না হয় থাইকা যামু।
মহিলাকে উপযুক্ত পরিশ্রমিক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ায় মহিলা থেকে যেতে রাজী হলো। মহিলাকে রেখে যাওয়ার কথা বলে ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে ডাক্তার আয়ার প্রতি আস্থা না রেখে বলল, আপনাদের কাজ তো আয়া দিয়ে হবে না। রাতে যখন এমারজেন্সি কোন ঔষধ পত্র লাগবে তখন কে এনে দিবে? কাজেই আপনাদের যে কেউ একজনকে থাকতে হবে।
ডাক্তারের কথায় মায়া বিপদে পড়ে গেল। এখন এখানে থাকার ব্যাপারে কাকে রাখা যায়। অবশেষে পারুলকে বলল, পারুল তুই তো হোষ্টেলে থাকিস, বোন তুই আজকের রাতটা একটু সেক্রিফাইস কর না?
-- আমি তো থাকতে পারি, তবে হোষ্টেলে আমার রুম মেটদের বলে আসাতে হবে। না হলে নানা রকম সমস্যা তৈরী হবে।
-- আমি না হয় এখানে অপেক্ষা করি তুই হোষ্টেলে গিয়ে বলে আয়।
-- আমি একা বললে হোষ্টেলের মেয়েরা অন্য রকম মাইন্ড করতে পারে, তার চেয়ে তুইও চল আমার সাথে, ওরা জিজ্ঞেস করলে বলবি আমাদের বাসায় থাকবে।
পারুলের কথামত মায়া সাথে গেল। হোষ্টেল থেকে প্রয়োজনীয় জামা কাপড় নিয়ে দুইজন একসাথেই বেরিয়ে এল।
রাত দশটার দিকে মায়া পারুলকে আর আয়াকে রেখে রাতের ডিউটিরত নার্সকে হেল্প করার জন্য বলে চলে এলো।
রাত দু’টার দিকে মিনহাজের ঘুম ভাঙলে মিনহাজ ব্যথায় কাতরাতে লাগল। পারুল সজাগই ছিল, তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে দেখে খুব জ্বর। তাড়াতাড়ি নার্স ডেকে এনে জ্বরের ঔষধসহ ব্যাথার ইনজেকশন দিল। আরেকটি ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
বাসায় গেলেও মায়ার ঘুম হচ্ছিল না। অজানা আশঙ্কায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করছিল। একদিকে মরাণাপন্ন মিনহাজের চিন্তা আবার পারুলকে রেখে এসেছে তারও চিন্তা। যদি পারুলের কোন অঘটন ঘটে তখন এর জবাব দেবে কে? তাকেই তো দিতে হবে। ছটফট করতে করতে সাকালের দিকে ঘুমালো। সকাল আটটার সময় মায়ার মা মায়াকে ঘুম থেকে ডেকে উঠালো। মায়ার বাবা তখনও অফিসে যায় নাই। মায়ার হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে বলল, দেখতো কে যেন তোর সাথে কথা বলবে, খুব নাকি জরুরি ফোন।
মায়া শোয়া থেকে উঠে বসল, সোজা হয়ে ফোন হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে পারুলের কন্ঠ ভেসে আসল। পারুল কাঁদতে কাঁদতে বলল, মায়ারে সব শেষ।
মায়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কি শেষ?
-- মারা গেছে।
-- মারা গেছে! বলিস কি!!
পারুল কাঁদতে কাঁদতেই বলল, হ্যাঁ, সাড়ে সাতটার দিকে মিনহাজ মারা গেছে।
মিনহাজ মারা গেছে কথাটি বলতে না বলতেই মায়ার হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। একটা চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, মা গো-- সব শেষ হয়ে গেলো গো মা--। এখন কি হবে মা গো মা -- -? বলেই হু হু করে কাঁদতে লাগল।
মেয়ের চিৎকার শুনে মা রান্না ঘর থেকে দৌড়ে এলো। মেয়ের অমঙ্গল কিছু চিন্তা করে ভয়ে চুপসে গিয়ে আমতা আমতা করে বলল, কি-- কি-- শেষ হয়েছে মা?
মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা গো--আমার জন্য একজন শেষ হয়ে গেল মা, এখন আমার কি হবে গো মা- -- ?
মা কিছু বুঝতে না পেরে ভয়ে চোখে মুখে জড়তা নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, কে শেষ হলো মা?
-- আমার জন্য অনাথ একটি ছেলে মারা গেল মা।
অনাথ ছেলের কথা শুনে মা ভীতু অবস্থায়ও আশ্চার্য হয়ে বলল, অনাথ ছেলে! অনাথ ছেলেটা কে?
-- আমার ক্লাসের মিনহাজ। বলেই জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় ঢলে পড়ল।
মায়াকে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়তে দেখে মায়ার মা চিৎকার দিয়ে উঠল, ও মায়ার বাপ তাড়াতাড়ি আসো, মায়া যেন কেমন করছে।
মায়ার বাবা পাশের রুমেই অফিসে যাওয়ার জন্য কাপড় পরতে ছিল, স্ত্রীর চিৎকার শুনে দ্রুত মায়ার রুমে চলে এলো। মায়া জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মেয়ের অবস্থা দেখে আর অফিসে গেল না তাড়াতাড়ি মায়াকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। মায়ার জ্ঞান ফিরলেও স্বাভাবিক হতে পারল না। মিনহাজ মিনহাজ করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
হঠাৎ মানসিক আঘাতের কারণে মায়ার চিৎকার চেঁচামেচির মাত্রা একটু বেড়েই গেল। ডাক্তার মিনহাজের ঘটনাটি অবহিত হওয়ার পরে মায়াকে আর রিলিজ দিল না। তাকে হাসপাতালের বেডেই ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে শুইয়ে রেখে দিল। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় মিনহাজের লাশ আঞ্জুমান মফিদুলের কাছে হস্তান্তর হয়ে গেল। কবর দেয়ার সময় ক্লাসমেট অনেকে সাথে গেলেও মায়ার পক্ষে মিনহাজের মুখটা দেখার সৌভাগ্যও হলো না। পারুল অবশ্য মিনহাজের মৃত্যু থেকে শেষকৃত্য পর্যন্ত মিনহাজের লাশের পাশেই ছিল।
(সমাপ্ত)
ছবি ঃ গুগল
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচে ক্লিক করুন
পরিহাস থেকে প্রেম
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৮ রাত ১২:০৭