শামচুল হক
মিনহাজ সহজ সরল ছেলে। লেখা পড়ায় ভালো হলেও চালাক চতুর নয়। কারো চালাকী সহজে বুঝেও না বোঝার চেষ্টাও করে না। ক্লাসে সবাই তাকে হাবলু নামেই ডাকে। ক্লাসের ছেলেদের বান্ধবী থাকলেও তার কোন বান্ধবী নেই। এ নিয়ে সে যখন আফসোস করে ক্লাসের সহপাঠীরা তখন হাসাহাসি করে।
সেদিন তার ক্লাসের তিন বান্ধবী মিলে ক্যাম্পাসের পূর্ব পার্শ্বের আম গাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনজনকে একত্রে দেখে হেসে দিল। মায়া, নুপুর, পারুলের মধ্যে মায়া দেখতে সুন্দরী এবং ভীষণ দুষ্ট। মায়া আস্তে আস্তে নুপুর আর পারুলকে ডেকে বলল, এই শোন, আমি মিনহাজের সাথে প্রেমের অভিনয় করবো, তোরা কিন্তু হাসবি না। দেখি হাবলু মিনহাজ কেমন করে। ওদেরকে কথাটি বলে মায়া মিনহাজকে ডাক দিল, এই মিনহাজ-- এই দিকে আয়।
-- কেন রে?
-- তোর সাথে কথা আছে।
-- কি কথা রে?
-- এখানে না আসলে কি করে বলবো?
মায়ার কথা শুনে মিনহাজ কাছে এলে মায়া বসতে বলল।
-- কেন রে বসবো কেন?
-- আমরা তোর সাথে আজকে আড্ডা দিব।
-- আমার সাথে আডডা দিবি! কেন তোদের আড্ডা দেয়া বন্ধুরা কোথায়?
-- ওরা কেউ আসে নাই সেই জন্য তো তোকে নিয়ে আড্ডা দিব।
-- তিন জনের একজনেরও বন্ধু আসে নাই?
-- না রে।
-- সত্যি!
-- আরে আমরা কি মিথ্যা বলছি নাকি?
হাসতে হাসতে কাছে চলে এসে ঘাসের উপর বসতে বসতে বলল, তোদের সাথে কি আড্ডা দিবরে?
-- কেন মেয়েদের সাথে কোন দিন আড্ডা দিসনি?
-- না রে।
-- কেন?
-- আমার তো কোন মেয়ে বন্ধু নেই, কি করে আড্ডা দিব?
-- বলিস কিরে, ক্যাম্পাসে এত মেয়ে ঘোরাঘুরি করে তার মধ্যে তোর একটা মেয়েও পছন্দ হয় না।
-- পছন্দ হয় কিন্তু যার দিকে তাকাই সেই দেখি কোন না কোন বন্ধু নিয়ে বসে আছে। কাজেই আমার ভাগ্যে আর মেয়ে বন্ধু জোটে না।
-- তুই কাউকে বান্ধবী হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলি?
-- না--হ।
-- কেন?
-- সে সুযোগই তো পাচ্ছি না।
-- সুযোগ দিলে তুই বান্ধবী বানাবি?
-- আমার বান্ধবী বানানোর খুব ইচ্ছারে, কিন্তু আমার যে চেহেরা এই চেহেরায় কেউ বান্ধবী হতে রাজী হবে বলে মনে হয় না।
-- কেউ রাজী হলে তাকে কি তুই বান্ধবী হিসাবে গ্রহণ করবি?
-- গ্রহণ করবো-- কিন্ত কে রাজী হবে রে? কেউ রাজী হবে না।
-- যদি আমি রাজী হই তাহলে কি তুই আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে রাজী আছিস?
সরাসরি মায়ার মুখে এমন কথা শুনে মিনহাজ লজ্জিত হয়ে গেল। লজ্জা লজ্জা মুখে বলল, যাহ-- ফাজলামী করিস না--হ।
-- কেন ফাজলামী কেন? আমি সত্যি সত্যি বলছি।
-- তুই সত্যি বললেও আমার বিশ্বাস হয় না রে। কারণ, তুই হলি ক্লাসের সবচেয়ে সেরা সুন্দরী, আর আমি হলাম ক্লাসের সব চেয়ে বিদঘুটে চেহারার লোক। তুই কি করতে রাজী হবি রে। আমার বিশ্বাস হয় না।
-- আমার কথা তোর বিশ্বাস হয় না?
-- না--।
-- কি করলে তোর বিশ্বাস হবে?
-- বিশ্বাস হওয়ার মত কাজ করলে।
-- তা হলে এই নে-- হাতে মাটি নিয়ে দিব্যি কাটছি, আমি তোকে ভালবাসি, আমি তোকে ভালোবাসি, আমি তোকে ভালোবাসি। এবার তোর বিশ্বাস হচ্ছে তো?
-- বলিস কিরে! সত্যি কি তুই মাটি নিয়ে কিরে কাঁটলি? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।
-- মাটি নিয়ে কিরে কাটলাম তারপরেও তোর বিশ্বাস হ্েচছ না?
-- কি করে বিশ্বাস হবে রে, তোর মত এমন সুন্দরী আমাকে ভালবাসতে হাতে মাটি নিয়ে কিরে কাটবে এটা আমি ভাবতেও পারছি না।
-- আমি তো সত্যি সত্যি মাটি নিয়ে কিরে কেটেছি এবং তোর সামনেই তো মুখ দিয়ে বললাম, আমি তোকে ভালবাসি। তাছাড়া আমি তো একা নই। আমার সাথে পারুল, নুপুর আছে ওদের স্বাক্ষী রেখেই তো বললাম।
মায়ার এ কথা শুনে মিনহাজ মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দুই চোখ জলে ভিজে যায়। মায়া মিনহাজের চোখে পানি দেখে বিব্রতবোধ করতে লাগল। রসিকতা করতে গিয়ে একি হলো। ওর চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে? কযেক মিনিট সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কোন কথা বলছে না। মিনহাজ এমন অবস্থার সৃষ্টি করবে এটা কেউ ভাবতেও পারে নাই। সবাই নিরব হওয়ায় মায়া নিরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠল, তুই কাঁদছিস কেন রে?
-- কাঁদছি-- কান্না চেপে রাখতে পারলাম না রে।
-- কেন?
-- আজ পর্যন্ত কোন মেয়ে আমাকে এরকম করে ভালোবাসার কথা বলে নাই রে। তোর মত সুন্দরী এমন কথা বলার পরে খুশিতে অটোমেটিকেলি কান্না পেল রে।
-- সবাই খুশিতে হাসে আর তুই দেখি সবার ব্যতিক্রম, খুশিতে কাঁদিস। এমন উল্টো লোক তো কোনদিন দেখিনি রে।
মিনহাজ চোখের পানি রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, আমার দুখের জীবন সম্পর্কে হয়তো তোরা কেউ জানিস না। জানলে আমার সাথে তোরাও কেঁদে দিতিস।
-- তোর আবার দুঃখ কিসের রে?
-- থাক-- আমার দুঃখ আমার ভিতরেই থাক, তোদেরকে বলে আমার দুঃখের ভাগী করতে চাই না।
মায়া আগ্রহভরে ঘার বাঁকা করে বলল, বলনা-- তোর দুঃখের সাথে আমরাও একত্মতা করি।
-- তোরা হলি সুখি মানুষ, তোরা আমার দুখের সাথে কি একাত্মতা করবি?
পারুল বলল, বলনা-- যদি তোর দুখের সাথে আমরা একত্মতা করি তাহলে তোর অসুবিধা কি? বরঞ্চ তোর দুখের সাথি তো হলাম।
-- আমার দুখের তোরা সাথি হবি?
-- তিনজনই বলল, হ্যাঁ-- এবার বল।
মিনহাজ প্রথমে হাসি হাসি মুখেই বলতে লাগল, আমার যখন তিন বছর বয়স তখন আমার মা মারা যায়। এর পর ঘরে আসে সৎ মা। সৎমায়ের অনেক অত্যাচার অনাচারের ভিতর মানুষ হয়েছি। ক্লাস এইটে পড়া অবস্থায় বাবা মারা গেল। এক মাস পরেই সৎ মা আমাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিল। বাবার জমিজমা যা ছিল সব নাকি তার নামে লিখে নিয়েছে। পথের ভিখারী হয়ে মামার বাড়ি গেলাম। কযেক দিন যেতে না যেতেই মামীরা আমার ভাত বন্ধ করে দিল। মামা ছিল নরম মানুষ, মামীদের সাথে ঝগড়া করে কুলোতে পারতো না। আমাকে নিয়ে ঝগড়া করে মামা নিজেও দু’দিন না খেয়ে থাকল। কিন্তু মমীরা তাতে হার মানলো না। মামা অবশেষে মামীর সাথে কুলোতে না পেরে পাশের গ্রামে নিয়ে আমাকে লজিং-এর ব্যবস্থা করে দিল। সেখানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলেও পড়ার খরচ নিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম? মামা প্রথম প্রথম টাকা পয়সা দিলেও পরে হয়তো মামীর শাসনের কারনে দিতে ভয় পেল। বাধ্য হয়ে লজিং বাড়ির ছেলেদের পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা টিউশনি করে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে ভিক্ষা করে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। এসএসসি পাশ করার পর থেকে টিউশনি করেই নিজের খরচ নিজে যোগাড় করতে লাগলাম। সেই থেকে নিজের ইনকাম নিজে করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত এসেছি। মাঝে মাঝে ইউনিভার্সিটি বন্ধ হলে বিপদে পড়ে যাই। কোথায় যাবো? কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। মামার বাড়ি গেলে মামীরা ভালো চোখে দেখে না। এক বেলা ভাত দিলে দুই বেলা না খেয়ে রাখে। বাধ্য হয়ে দু’একদিন থেকেই চলে আসি। মা মারা যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোথাও আমি কারো ভালোবাসা পাইনি রে। কেউ আমাকে একদিনের জন্যও ভালোবাসে নাই। তুই যখন হাতে মাটি নিয়ে কিরে কাটলি তখন তোর ভালোবাসার কথাটার আবেগ সহ্য করতে না পেরে কেঁদে দিয়েছি। তুই ফাজলামী করেই বলিস আর ভালোবেসেই বলিস তোর কথায় আমি সত্যি সত্যি দুর্বল হয়েছি রে।
মিনহাজের কথা শুনে তিন জনই হতভম্ব হয়ে গেল। ফাজলামী করতে গিয়ে তার মুখ থেকে এ কোন কাহিনী শুনলো। তিন জন মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। তাদের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
পুরো পরিবেশটা গুমোট হয়ে গেল। পরিবেশ হালকা করার জন্য মায়া বলল, এই নুপুর, বাদমওয়ালাকে ডাক দে। বলেই পার্টস থেকে দশটাকা বের করে দিল।
মিনহাজ চোখ দু’টা মুছে বলল, এই শোন-- তোর টাকা রেখে দে, আমি তো তোদের কখনও খাওয়াতে পারিনি। আজ আমি বাদাম কিনে তোদের খাওয়াবো।
মায়া তার টাকায় বাদাম নিতে বাধা দিলে সে আবার চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, আমি আজকের মত এরকম আনন্দঘন পরিবেশ কখনও পাইনিরে। আজকের বাদাম আমি খাওয়াবো। আর যদি তোরা না খাস তাহলে খুব কষ্ট পাবো। মিহনহাজের অনুরোধে মায়া অনিচ্ছা সত্বেও টাকা পার্টসে ঢুকালো।
বাদাম খেতে খেতে তাদের মধ্যে আরো অনেক কথা হলো। মায়া যেভাবে রসিকতা শুরু করেছিল মিনহাজের দুঃখের কাহিনী শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। রসিকতা না করে মিনহাজের দুখের কাহিনী মন দিয়ে শুনছে। একসময় মিনহাজ বলল, তোরা থাক আমার বিকেল পাঁচটায় টিউশনি আছে, আমি আর থাকতে পারছি না। বলেই বলল, তাহলে তুই কি আসলেই আমাকে ভালোবাসলি না ঠাট্টা মশকরা করলি?
এই মুহুর্তে মায়া ভাবল আমরা ইয়ার্কী করলেও ও হয়তো এটাকে সত্য হিসাবে ধরে নিয়েছে। এখন যদি বলি ভালোবাসি নাই, এমনি ইয়ার্কি করেছি তাহলে ও মনে খুব কষ্ট পাবে। সহজ সরল মানুষ নিয়ে এই জ্বালা। কোনটা আসল কথা কোনটা নকল কথা এটাও বুঝতে পারে না। তাই মিনহাজকে মানসিক সান্তনা দেয়ার জন্য মায়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল, এতোগুলো দিব্যি দেয়ার পরও তুই আমাকে বিশ্বাস করতে পারলি না? তোর ভিতরে যদি বিশ্বাস না থাকে তাহলে তোকে আমি ভালোবাসবো কি করে রে?
মিনহাজ সরল ভাবে বলল, না না, সে জন্য নয়, অবিশ্বাসের প্রথম কারণ হলো আমার চেহারার মধ্যে কোন আকর্ষণীয়তা নেই। তুই হলি সুন্দরী। তোকে যে কোন হ্যান্ডসাম ছেলে বা গুন্ডা পান্ডা মাস্তান ছেলে ভালোবাসার প্রস্তাব দিতে পারে। তখন আমার ভালোবাসা তোর কাছে নগণ্য হবে। আরেকটি কথা হলো আমার মা-বাবা, অর্থ-বিত্ত, শক্তি-সামর্থ কোন কিছুই নেই। সুন্দরীদের নিয়ে এই পৃথিবীতে বিপদ বেশি। তোকে ভালোবেসে যদি সে সকল বিপদে পরি তখন কি হবে? সে সব কথা চিন্তা করেই ভালোবাসা কথাটা যত ভালো লাগছে বিপদের কথা মনে করে তত ভয়ও লাগছে।
তুই যদি ভালোবাসার আগেই বিপদের কথা ভেবে ভয় পাস, তাহলে তুই আমাকে ভালবাসবি কি করে?
তুই যদি আমাকে ভয় পাস তাহলে নুপুর, পারুলকে তোর কেমন লাগে? ওদের সাথে প্রেম কর।
মিনহাজ মৃদু হেসে বলল, তোদের তিনজনকেই আমার ভালো লাগে। কিন্তু আমি নিজের থেকে কাউকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিব না। যদি তোরা তিনজনের কেউ আমাকে নিজের থেকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিস তখন আমি সেটা বিবেচনায় নিব।
মায়া বলল, তিন জনের ভিতর থেকে আমি তোকে ভালবাসার প্রস্তাব দিলাম তাহলে আমাকে তোর ভালোলাগে নাই?
মিনহাজ মৃদু হেসে বলল, অবশ্যই ভালোলেগেছে এবং তোকে ভালোওবেসেছি। কিন্তু ভয় হচ্ছে। তোর যদি কোন প্রেমিক থেকে থাকে বা কেউ তোকে মনে মনে ভালোবেসে থাকে আর তখন তো সে আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষতি করে বসবে রে।
মায়া হেসে হেসে বলল, এতো ভিতু হলে তো তোকে কেউ ভালোবাসবে না রে। ছেলেদের চেহারার পাশাপাশি স্মার্ট এবং সাহসিকতাই হলো মেয়েদের পছন্দ। তোর এগুলো কিছুই নেই। তোকে ভালোবেসে তো ভুল করে ফেললাম।
মিনহাজ মায়ার এ কথায় প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, ঠিক আছে, এসব কথা আজ থাক, আগামী কাল হবে। আমি রাতে আগে চিন্তা করে নিই। তারপরে তোর ভালোবাসায় সায় দিব কি দিব না সেটা পরে বলবো। বলেই সে উঠে দাঁড়ালো এবং ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
(চলবে)
ছবি ঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৮ রাত ৯:১২