শামচুল হক
আষাঢ় মাসের শেষে ঢাকা থেকে বাড়ি গিয়েছি। চারিদিকে বন্যার পানি। বাড়ির উঠান আর রাস্তাগুলো শুধু জেগে আছে। সারা দিনের ট্রেন জার্নি এবং গ্রামের এ্যাবড়ো থ্যাবড়ো কাঁচা রাস্তায় রিক্সার ঝাকুনি শেষে সন্ধ্যায় যখন বাড়ি পৌঁছিলাম তখন শরীরটা খুবই ক্লান্ত। তারপরেও বাবা-মা ছোট ভাই-বোনকে অবজ্ঞা করতে পারলাম না। তাদের সাথে সঙ্গ দিতে গিয়ে রাত নয়টা বাজল। মায়ের হাতের রান্না করা ভাত খেয়ে কেবল শুয়েছি। ঘুমে চোখ বুঁজে আসতে না আসতেই কানে ঢোলের শব্দ আসল। ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুম হলো না। ঢোলের মাতাল করা শব্দে শোয়া থেকে উঠতে বাধ্য হলাম। শব্দ খুব কাছেই মনে হলো। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে বাড়ির সামনের রাস্তায় গেলাম। ঢোলের শব্দ উত্তর দিক থেকে আসছে।
উত্তর পাশের বাড়িটি আমার জ্যাঠার বাড়ি। আমার জ্যাঠা নামাজি মানুষ, তার বাড়িতে ঢোল বাজানোর প্রশ্নই আসে না। ঢোল বাজাতে গেলে ঢুলির বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। জ্যাঠার বাড়িতে ঢোল বাজানো সম্ভব না জেনেও জ্যাঠার বাড়ির সামনের উঠানে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবার বুঝতে পারলাম ঢোলের শব্দ জ্যাঠার বাড়িতে নয় জ্যাঠার বাড়ির উত্তর পাশের বাড়িতে। বড়িটি আমারই দূর সম্পর্কের মামার বাড়ি। মামার বাড়িতে কেন ঢোল বাজছে বুঝতে পারলাম না। আমার বুদ্ধি হওয়া পর্যন্ত মামার বাড়িতে কখনই কোন ঢোল বাজতে দেখি নাই। সেই বাড়িতে কেন ঢোল বাজছে বিষয়টি দেখার জন্য পা বাড়ালাম কিন্তু যাওয়া সম্ভব হলো না। দুই বাড়ির মাঝখানের রাস্তা পানিতে তলানো। পানিও কম নয়। এক বুক এক গলা পরিমাণ পানি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে ছোট একটা কলাগাছের ভেলা পেলাম। ভেলায় চড়ে পার হয়ে যখন বাড়ির সামনে গেলাম তখন ঢোল করতালের সাথে গানও শুরু হয়েছে।
ভেলা বাড়ির সামনে একটি জিগা গাছের সাথে বেঁধে বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ালাম। উঠানের চারদিকে অনেক লোক গোল হয়ে বসে আছে। মাঝখানে একজনকে চাটাই পেতে দক্ষিণ সিথান করে শুইয়ে রেখেছে। একজন কবিরাজ তাকে ঝাড় ফুঁক করছে। আর একজন মুখে রংচং মেখে জরির জামা পরে, হাতে নতুন একটি গামছা উপর নিচে নাড়িয়ে নড়িয়ে রুগীর চারদিকে নেচে নেচে বেহুলা লক্ষিণদারের বিষহরি পালা গান গাচ্ছে, বাকি তিনজন ঢোল করতাল বাজিয়ে গানের সাথে তাল মিলিয়ে দোহারি করছে।
এসো এসো মাতা বিষহরি গো
আমরা তোমার অসহায় ছেলে গো
এসো এসো জয়ো মাতা বিষহরি গো
এসো এসো এই আসরে গো
জয়ো জয়ো জয়ো মাতা বিষহরি গো
(বহুলা লক্ষিণদারের বিষহরি পালার প্রথমেই যে বন্দনা তারা গেয়েছিল তার দুই একটি লাইন এখনও মনে আছে। উপরের লাইন কয়টি সেই আসরের বিষহরি পালার বন্দনার অংশ।)
ঢাকায় থাকার কারণে অনেক দিন হলো গ্রামের এরকম অনুষ্ঠান দেখা হয় না। উঠানের এক কোনে বসে গান শুনতে ছিলাম। নিরব নিস্তব্ধ রাতের গ্রাম্য পরিবেশে ঢোল করতালের সাথে নেচে নেচে গাওয়া গান শুনতে ভালই লাগছিল। গায়কের কণ্ঠও ভালো। তন্ময় হয়ে শুনছি। প্রায় তিন ঘন্টা গান গাওয়ার পর বিষহরি পালা শেষ পর্যায়ে আসলো। পালা শেষ হতে না হতেই কবিরাজও তার ঝাড় ফুঁক বন্ধ করে হাত গুটিয়ে নিল, সাথে সাথে গান বাজনাও বন্ধ হয়ে গেল।
গান শেষে বাড়ি আসতে চাইলেও আসতে দিল না। গান উপলক্ষে খিচুড়ি রান্না হয়েছে। উঠানে বিছানো খড়ের উপর বসে কলার পাতায় দেয়া খিচুড়ি খেয়ে আসতে হলো।
যে কারণে গানের আসর দেয়া হয়েছে তা শুনে আশ্চার্য হয়ে গেলাম। প্যারালাইসিসের রুগীর সুচিকিৎসার জন্য এই আয়োজন। রুগী আর কেউ নয় আমারই দূর সম্পর্কের মামা। প্রায় ছয়মাস হলো প্যারালাইসিস হয়েছে। উঠতে বসতে পারে না। ডাক্তার কবিরাজ অনেক দেখিয়েছে কিন্তু রোগ ভালো হয় না। সদর হাসপাতালেও কয়েকবার নিয়েছিল, হাসপাতালের ওষুধ পথ্য খাওয়ানোর পরও কোন কাজ হয় নাই। কোন চিকিৎসায় যখন কাজ হচ্ছে না তখন লেখাপড়া না জানা আমার মামাতো ভাইদের কে যে বুদ্ধি দিয়েছে বেহুলার গানের মাধ্যমে এই রোগ ভালো হয়। তাই বেহুলার গানের আয়োজন। সাতদিন বেহুলার গানে গানে ঝাড়তে হবে। এই সাতদিনে কবিরাজকে সাতশ’ টাকা দিতে হবে আর এর সাথে প্রত্যেক দিনই খিচুড়ি রান্না করে উপস্থিত লোকজনকে সিন্নি দিতে হবে।
ঘটনাটি ১৯৯৫ সালের। তখন সাতশ টাকা কম নয়। সেই সময় চালের কেজি ১০/১২টাকা। ডাক্তারের কাছে না নিয়ে এত টাকা খরচ করার জন্য এই বুদ্ধি যে দিয়েছে তার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে বকতে লাগলাম। মামতো ভাইদের বললাম, বেহুলার গান গাইলেই যদি রোগ ভালো হয়, তাহলে সরকারের এত কোটি কোটি টাকা খরচ করে হাসপাতাল দেয়ার কি দরকার, প্রত্যেক জেলায় জেলায় একটি করে বেহুলা গানের দল তৈরী করলেই তো হয়, তাতে সারা রাত গানও শোনা হলো রুগীর অসুখও ভালো হলো। গান শুনে মানুষও খুশি হলো রুগিও সুস্থ্য হলো। আমার কথা শুনে মামাতো ভাইয়েরা খুশি না হয়ে উল্টো বিরুক্তই হলো। তবে আমি যত বকাবকিই করি না কেন তাদেরকে বেহুলার গানের বিশ্বাস থেকে এক পা নড়াতে পারলাম না। গান পুরো সাতদিনই হলো।
এক নাগারে পুরো সাতদিন গান হলেও মামার কোন উন্নতি হলো না। বেহুলা গানের আগে যেমন ছিল গানের পরেও তেমন অসাড় হয়ে বিছানায় পরে রইল। এর দেড় মাস পরেই মামা মারা গেল।
উন্নত চিকিৎসা না করে বেহুলা গানের মাধ্যমে চিকিৎসার পর মামা মারা গেলেও আমার মামাতো ভাইদের আত্মতৃপ্তি দেখে অবাকই হলাম। তাদের ভাষ্য মতে, সব ধরনের চিকিৎসাই করিয়েছি, আমাদের পক্ষ থেকে চিকিৎসার কোন ত্রুটি করি নাই, বেহুলার গানটাই বাকি ছিল, সেটাও করিয়ে দিয়েছি, বাবা মারা গেলেও এখন আর আমাদের চিকিৎসা নিয়ে কোন আফসোস নাই।
তাদের সান্তনা দেখে আমিও সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হলাম। কারণ যারা বেহুলা গানের উপদেশ দিয়েছে তারা মামা মারা যাওয়ার পরে উল্টো দোষারোপ করতো যে বেহুলার গান না দেয়ার জন্য রুগী তাড়াতাড়ি মারা গেছে, গান দিলে অবশ্যই সুস্থ্য হতো এবং এত তাড়াতাড়ি মরতো না। আমার কথা মত যদি সত্যি সত্যি বেহুলার গান বন্ধ হতো তাহলে মামা মারা যাওয়ার পরে সেই দোষের তলে আমিই পড়তাম, এখন মামা মারা গেলেও অন্তত সেই দোষারোপ থেকে রেহাই পেয়েছি। মুর্খ মামাতো ভাইদের কাছে এখানেই অনেকটা শান্তি অনুভব করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৮ রাত ৯:৪১