(ব্লগের রম্য প্রিয় পাঠকদের জন্য উৎসর্গ)
শামচুল হক
এতক্ষণ বুড়ির কণ্ঠ শুনলেও অন্ধকারের কারণে চেহারা দেখতে পাই নাই, লাইটের আলোতে চেহারা দেখে অনুমান করলাম বয়স ষাট পয়ষট্টির মত হবে। ধবধবা ফর্সা। গোলগাল মুখমন্ডলে এখনো ডিবডিব করে চেহারা। চুলে পাক ধরেছে। তারপরেও বেশ শক্ত আছে।
আমাকে সোফায় বসতে বলে রিফ্রেশমেন্ট রুমে ঢুকলো। হাতমুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এসে বলল, এখন তুই কোথায় যাবি?
বললাম, টরেন্টোতে যাবো।
টরেন্টোর কথা শুনে বুড়ি চোখ কপালে তুলে বলল, টরেন্টোতো এখান থেকে অনেক দূর, কিভাবে যাবি?
-- তাতো জানি না!
-- ওখানে কে থাকে?
-- আমার বন্ধু সৈকত থাকে।
-- কিসে যাবি?
-- বাসে যাবো।
-- আরে বোকা টরেন্টো তো অনেক দূর, ওখানে ট্রেনে যাওয়া সব চেয়ে ভালো হবে।
-- ঠিক আছে, না হয় ট্রেনেই যাবো। তা এই এলাকার রেল স্টেশনের নাম কি?
-- এখান থেকে অল্প দূরেই জাসপার রেল স্টেশন।
-- জাসপার থেকে কি টরেন্টোতে ট্রেন যায়?
-- যায়, জাসপার স্টেশনে গেলেই টিকিট পাওয়া যাবে।
জাসপার থেকে টরেন্টোতে যাওয়ার ট্রেন পাওয়া যাবে শুনে বললাম, তাহলে উঠি, আমাকে আজকেই টরেন্টো যেতে হবে, বলেই সোফা থেকে উঠতে ছিলাম, হঠাৎ ডাইনিং টেবিলের দিকে চোখ পড়ল, টেবিলে খাবার সাজানো আছে।
আমাকে টেবিলের দিকে তাকাতে দেখে বুড়ি বলল, কিছু খেয়ে যা।
আমারও খুব খিদে পেয়েছে, বুড়ির কথায় আর না বললাম না। টেবিলে বসে প্লেট নিয়ে রুটির সাথে মাংস নিতে যাবো এমন সময় মাংসের চেহারা দেখে সন্দেহ হলো, জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কিসের মাংস?
বুড়ি খুশি খুশি ভাবে বলল, খুব ভালো মাংস, পিগের মাংস।
পিগ মানে শুকুরের মাংস, নাম শুনেই পেটের ক্ষুধা উবে গেল। গামলার ঢাকনা বন্ধ করে আরেকটি গামলার ঢাকনা খুলে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কিসের মাংস?
বুড়ি বলল, ডগের মাংস।
ডগ মানে কুত্তার মাংস। কুত্তার মাংসের নাম শুনে বাকি ক্ষুধাটাও চলে গেল। ঠেলে বমি আসার অবস্থা। তাড়াতাড়ি প্লেট রেখে উঠে পড়লাম। বুড়ি আশ্চার্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে-- এত সুন্দর মাংস তারপরেও না খেয়ে উঠলি কেন?
মুখটা কাচুমাচু করে বললাম, আমি মাংস খাই না, সবজি খাই।
পাশের গামলা দেখিয়ে বলল, ওইটাতে সবজি আছে, পিগের চর্বি দিয়ে মজা করে রান্না করা, ওইটা খা।
সব্জির নাম শুনে যাও খুশি হয়েছিলাম, পিগের চর্বির কথা শুনে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। মুখে অভক্তি আর অরুচির ভাব এনে বললাম, এখন আমার ক্ষুধা নাই, যদি চা বিস্কুট থাকে তো তাই দেন।
বুড়ি বলল, এই মুহুর্তে ঘরে চা বিস্কুট কিছু নাই।
-- দোকানে পাওয়া যাবে?
-- এত রাতে চা খেতে হলে জাসপার রেল স্টেশনে যেতে হবে। রেল স্টেশনের রেস্টুরেন্ট সারা রাতই খোলা থাকে।
বুড়ি রেল স্টেশন দেখিয়ে দেয়ায় আমি বুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেল স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। আশা করেছিলাম বুড়িকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালাম বুড়ি হয়তো আমাকে থাকতে বলবে। কিন্তু বুড়ি সে ধরনের কোন কথাই বলল না। মনে মনে বুড়ির উপর খুব রাগ হলো। কিন্তু রাগ হয়ে কি করবো জীবনের প্রথম দেখা বাড়িতে না নিয়ে গেলেও কিছু করার ছিল না।
শীতের মধ্যেই রেল স্টেশনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে গিয়ে জাসপার শহরটিও দেখা হলো। চমৎকার শহর। চারদিকেই পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে শহর। রাস্তাগুলো খুবই পরিষ্কার। কোথাও এতটুকু ময়লা নেই। বাড়িগুলো বেশ সাজানো গুছানো। বাড়িগুলোর চেহারা দেখে খুব ভালো লাগল। এক কথায় কাগজের ছবির মত বেশ সাজানো গুছানো শহর। শহরের পরিবেশ দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল।
রেল স্টেশনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে ঢুকতেই দেখি একটি অল্প বয়সি মেয়ে প্লাট ফর্মের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বয়স খুব বেশি নয় তেরো চৌদ্দ হবে। কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেও বলছে না। কানাডার লোকজনের এই একটা স্বভাব, মরে গেলেও অপরিচিত কারো কাছে নিজের দুখের কথা বলতে চায় না।
কিন্তু এত সুন্দর একটি মেয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে কান্নার কারণ কি জানার খুব কৌতুহল জাগল। আদর মাখা কন্ঠে অনুনয় বিনুনয় করে কান্নার কারণ জানতে চাওয়ায় মেয়েটি যা বলল তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। তিন বছর হলো তাদের বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক নাই। মায়ের সাথেই থাকে। মাঝে মাঝে বাবার কাছে গিয়েও থাকে। আজ রাতে মায়ের এক বন্ধু এসেছে। তার সাথে রাত্রী যাপন করবে। এই কারণে মেয়ের বাবাকে ফোন করেছিল এসে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু মেয়ের বাবা জরুরী কাজ থাকায় আসতে পারে নাই। কিন্তু মেয়ের মা এই কথা শুনতে রাজী নয়। এক সপ্তাহের জন্য বন্ধু এসেছে, এই এক সপ্তাহ কোন মতেই মেয়েকে এখানে থাকতে দেবে না। তাতে তাদের পার্সোনালিটি নিয়ে নাকি সমস্যা। কাজেই মেয়ের বাবা না এলেও মেয়েকে জোর করেই বাবার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মেয়ে একলা যেতে রাজী না হওয়ায় মেরেধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
মেয়েটি লাল টকটকা পরীর মতন চেহারা। মনে হয় গালে নিষ্ঠুরের মত একটি থাপ্পর দিয়েছে, পাঁচটি আঙুল লাল হয়ে ফুলে আছে। মায়েরা নিজের জৈবিক চাহিদা মিটাতে গিয়ে নিজের পেটের সন্তানের প্রতি এত নিষ্ঠুর আচারণ করতে পারে এটা আমার জানা ছিল না, কানাডায় এসে সেটাও দেখতে হলো।
মায়ের হাতে মার খাওয়া তেরো চৌদ্দ বছর বয়সের মেয়েটির জন্য খুব দুঃখ হলো, কিন্তু আমার পক্ষে কিছু করার নাই, আমি নতুন এসেছি, কিভাবে তাকে সাহায্য করবো বুঝতে পারছি না। কানাডার পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় মেয়েটির দুখে আফসোস করতে লাগলাম। সাহয্য করতে না পারলেও মেয়েটি যাতে বিপদগ্রস্ত না হয় সেইদিক খেয়াল করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখন কোথায় যাবে?
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতেই বলল, এডমন্টনে বাবার কাছে।
-- তুমি যে তোমার বাবার কাছে যাচ্ছো, তোমার বাবা কি জানে?
মেয়েটি বলল, জানে, আমি বাবাকে ফোন করেছি। বাবা আমার জন্য স্টেশনে বসে থাকবে।
বাবা মেয়ের জন্য স্টেশনে বসে থাকবে কথাটি শুনে খুব ভালো লাগল। মনের অজান্তেই মেয়ের বাবাকে একটা ধন্যবাদ দিলাম। অপরদিকে মেয়ের মায়ের কথা মনে হতেই ভিতর থেকে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো, আফসোস করে বললাম, হায়রে নিষ্ঠুর মা রে, একটি বাচ্চা মেয়েকে কি করে এত রাতে বাসা থেকে বের করে দিল, এটা ভাবতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরেকটু সামনে গিয়েই কয়েকটি অল্প বয়সি স্কুলের ছেলে মেয়ের দেখা পেলাম। এরাও বয়সে তরুণ-তরুণী। তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এত অল্প বয়সে এদের অন্তরঙ্গ হয়ে দাঁড়ানোটা আমার কাছে মোটেই ভালো লাগল না। বাংলাদেশে এটা কল্পনাই করা যায় না। অনেকেই তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। তারা হয়তো ট্রেনের অপেক্ষায় আছে। মনে হয় কোনও শহরের স্কুলে লেখা পড়া করে। একনজর দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ওদেরকে পাশ কাটিয়ে আরেকটু সামনে গিয়ে বায়ে চলে গেলাম। স্টেশনের প্লাট ফর্মে না গিয়ে স্টেশনের বাইরে চলে এলাম। ছিমছাম সাজানো গুছানো শহরটি আবার হেঁটে হেঁটে দেখতে লাগলাম। রাতের নিরব নিস্তব্ধ শহর স্ট্রীট লাইটের আলোতে দেখতে বেশ ভালই লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে কতদূর চলে এসেছি বলতে পারবো না। বাংলো টাইপের একটি বাড়ির সামনে যেতেই এলসেসিয়ান কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কুকুরের শব্দ শুনে সামনে না গিয়ে পিছনে ফিরে স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। কিন্তু পিছন ফিরতেই কুকুর আমাকে তাড়া করে বসল, কুকুরের ভয়ে দৌড়াতে লাগলাম।
আমাদের দেশের কুকুর অল্প কিছুদূর দৌড়িয়ে থেমে যায় কিন্তু এই কুকুর দেখি আর থামে না, যতই দৌড়াই কুকুরও তত দৌড়ায়, কোনমতেই পিছন ছাড়ে না। পিছনে পিছনে আসতেই থাকে। জান বাঁচাতে কুকুরের চেয়েও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। দৌড়ে অনেক দূর চলে এসে পিছনে তাকিয়ে দেখি তখনও কুকুর আমার পিছনে পিছনেই আসছে। কুকুরের হাত থেকে বাঁচার জন্য শহর ছেড়ে জঙ্গলের দিকে দৌড়াতে লাগলাম। জঙ্গলে ঢোকার আগেই একটি নালার মত চোখে পড়ল। মনে মনে ভাবলাম নালাটি ঝাপ দিয়ে পার হতে পারলে বাঁচা যাবে। এত প্রশস্ত নালা কুকুর কখনই পার হতে পারবে না। যে কথা সেই কাজ, দিলাম জোরে ঝাপ। ঝাপ দিতেই নালার মাঝখানে পড়ে গেলাম। দশ বারো ফুট নিচে পড়ে কমরে প্রচন্ড ব্যথা পেলাম। নালার নিচে এক ফোটা পানিও নাই। বারো ফুট খাড়া কাছারের নিচে শক্ত মাটির উপর পড়ে কোমড়ের বারোটা বেজে গেলো। সোজা হয়ে আর দাঁড়াতে পারছি না। ভাঙা কোমর নিয়ে জান বাঁচানোর জন্য বাঁচাও বাঁচাও করে চিল্লাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ চিল্লানোর পর মনে হলো এটা তো বাংলাদেশ নয়, এখানে বাংলায় বাঁচাও বাঁচাও করে চিল্লালে কেউ বুঝবে না। এটা কানাডা, এখানে ইংরাজীতে হেল্প হেল্প করে চিল্লাতে হবে। জান বাঁচানোর জন্য বাংলা বাঁচাও বাঁচাও না বলে জোরে জোরে "হেল্প হেল্প" করে চিল্লাতে লাগলাম। ইংরাজিতে হেল্প হেল্প করে চিল্লানোর এক পর্যায়ে মনে হলো কেউ একজন আমাকে হেল্প করার জন্য টেনে উঠাতেছে। জানে পানি এলো।
তার টেনে উঠানোর টানাটানিতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পর দেখি হেল্প ম্যান আর কেউ নয়, আমারই গিন্নী আমাকে অন্ধকারের মধ্যে হাতিয়ে খাটের নিচ থেকে বুকের গেঞ্জি খামছা দিয়ে ধরে টেনে উঠাতেছে আর বলতেছে, একটু আগেই তো খাটের উপরে শোয়া দেখলাম, খাটের নিচে পড়লা কেমনে?
*** গিন্নীর কথা শুনে ব্যাক্কল হয়ে গেলাম। গিন্নী বলে কি? আমি আছাড় খেলাম কানাডাতে আর গিন্নী আমাকে খাটের নিচ থেকে টেনে উঠায় আর বলে খাটের নিচে পড়লা ক্যামনে? লজ্জায় কোন কথাই বললাম না। ***
গিন্নী আমাকে টেনে তুলে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে আলো জ্বালালো। আমি তখনও কুকুরের ভয়ে থর থর করে কাঁপছি। আমাকে থরথর করে কাঁপতে দেখে গিন্নী বলল, ভয় পাইছেন নিহি?
আমি কথা না বলে তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম।
গিন্নী আমার তাকানো দেখে বলল, বুজছি-- যেই জোরে চিল্লানী দিছেন, আমারই কইলজা কাঁইপা উঠছে, না ভয় পাইলে কি আর এমন চিল্লানী দিছেন? বলেই বলল, খাটের উপর উইঠা বহেন, আমি নোয়া পুইড়া পানি আইনা দেই। আগেই কিন্তু শুইয়া পইড়েন না। নোয়া পোড়া পানি খায়া তারপর শুইতে হইবো। নইলে ক্ষতি হইতে পারে।
আমি কোমরের ব্যথা নিয়ে আস্তে আস্তে খাটের উপরে উঠে বসলাম। খাটের উপরে বসে কানাডার জঙ্গলের সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলো নিয়ে ভাবছি, এমন সময় গিন্নি আমার সামনে এক গ্লাস গরম পানি ধরে বলল, অর্ধেক খাইবেন আর বাকি অর্ধেক দিয়া গোসল করতে হইবো।
মনে মনে বললাম, কি জ্বালায় পড়লাম রে--! পানি খেতে অসুবিধা নাই কিন্তু এই কনকনে ঠান্ডা রাতে যদি গোসল করতে হয়, এর চেয়ে কষ্ট তো আর কিছু হতে পারে না? কানাডার কুত্তার দৌড়ানিও তো এর চেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা, এ তো হলো আমার মায়ের শিষ্য, আমার মা তাকে যা টোটকা শিখিয়েছে তার একচুলও কম করবে না। আমি যতই না না করি না কেন, আমার নাতে কোন কাজ হবে না, আমার মায়ের শিক্ষা অনুযায়ী আমাকে এই শীতের মধ্যে গোসল করিয়েই ছাড়বে।
শীতের অজুহাত দেখিয়ে আমি নিষেধ করলেও গিন্নী মানলো না। উল্টো আমাকে ধমক দিয়ে বলল, আপনি কইলেই হইবো, আঁতকা ভয় পাইছেন, আত্মাডা চুইমকা গেছে, নোয়া পোড়া পানি খাওয়ার পর বাকী নোয়া পোড়া পানি দিয়া গোসলা না করা পর্যন্ত আত্মার ধরফরানি কুমবো না।
এসব যে কুসংস্কার এবং অবৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড, এই কথাগুলো আমার ডিগ্রী পাাস গিন্নি কিছুতেই বুঝে না। আমার মা যেটা শিখিয়েছে সেটাই সে বেদ বাক্যের মত পালন করবে। কি আর করা, মায়ের হাতের শিষ্য যদি তার দোহাই দেয় তখন মায়ের প্রতি শ্রোদ্ধা থেকেই সব মেনে নিতে হয়। হাজার হলেও আমার গর্ভধারিনী মায়ের উপদেশ আমার গিন্নি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে যাচ্ছে। কাজেই মোড়ামুড়ি যাই করি শেষে গিন্নীর কথা মতই বাথরুমে গিয়ে লোহা পুড়ে গরম করা আধা গ্লাস পানি এক বালতি ঠান্ডা পানিতে মিশিয়ে গোসল করলাম। একে তো ঠান্ডা পানি তারোপর প্রচন্ড শীত, জারে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলাম। আমাকে কাঁপতে দেখে বউ তাড়াতাড়ি শরিষার তেল গরম করে এনে দিল, গায়ে মাথায় মালিশ করায় শরীরের কাঁপাকাপি কিছুটা কমলেও একেবারে ছাড়ল না।
আমাকে কাঁপতে দেখে গিন্নি বিছানায় শোয়ায়ে দিয়ে গায়ের উপরে দুইটা লেপ দিয়ে ঢেকে দিল। আমি শুয়ে পড়লেও আমার গিন্নি ঘুমালো না। আলো জ্বালিয়ে আমার মাথার কাছে বসে রইল। একটু পরপরই মাথায় হাত দিয়ে ঘুমিয়েছি কিনা পরখ করছে।
বার বার মাথায় হাত দিলে কি আর ঘুম হয়? বিরুক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বললাম, বার বার মাথায় হাত দাও ক্যান? মাথায় হাত দিলে কি আমার ঘুম হইবো?
আমার ধমক খেয়ে মনে করেছিলাম গিন্নী রেগে যাবে কিন্তু না রেগে উল্টো ঠান্ডা গলায় বলল, এমনি কি আর মাথায় হাত দেই, কওয়া তো যায় না, দুষ্টারা আবার যদি ঘুমের মধ্যে আইসা ভর করে? দুষ্টারা তো মনে হয় বেশিদূর যায় নাই, আশেপাশেই আছে। কাছে আছিলাম দেইখা ভয় দেখাইয়া খাটের নিচে নামাইলেও ক্ষতি করবার পারে নাই, আবার যদি ঘুমের মধ্যে আইসা ভর কইরা ক্ষতিটতি কইরা ফালায়, এর লাইগা মাথায় হাত দিয়া পাহারা দিতেছি।
ভুতের ভয়ে গিন্নী নিজে না ঘুমিয়ে রাত জেগে আমাকে পাহারা দিচ্ছে। তার পাহারা দেয়া দেখে কানাডার বুড়ির কথা মনে পড়ে গেল, মনে মনে বললাম, হয়রে কানাডার অভাগী বুড়িরে---, বাঙালি বউদের মত যদি তোরা স্বামীদের খেদমত করতিস, তাহলে কি বুড়ো বয়সে আত্মহত্যা করার জন্য রেল লাইন খুঁজতে হয়?
বাঙালিদের টাকা পয়সার অভাব আছে বটে কিন্তু বাঙালি বউদের মত এত ভালোবাসা কানাডায় আছে কি না সন্দেহ। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েই সব শেষ করে দেয়। শেষ বয়সে একাকি জীবন যাপনে অসহায় হয়ে পড়ে। কানাডার এইসব লোকজনের অসহায়ত্বের কথা মনে হতেই কানাডা যাওয়ার ইচ্ছায় ছেদ পড়ে গেল। বার বার মনে হতে লাগল কানাডার অফুরান্ত সুখের একাকিত্ব জীবনের চেয়ে বাঙালি বধুদের ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে চারটা ডাল ভাত খাওয়া অনেক শ্রেয়।
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচে ক্লিক করুন
কানাডার জঙ্গলে এক রাত
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৮ রাত ১১:২১