শামচুল হক
কামাখ্যা দাদী এবং তার পরোপকারী কাহিনী শুনে সোহেল মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ল। তার দুর্বলতা বুঝতে পেরে কথা বলার এক পর্যায়ে লোকটি জিজ্ঞেস করল, ভাই, আপনি কি বিয়ে সাদী করেছেন?
সোহেল বলল, না।
-- চাকরী করেন না লেখা পড়া করেন?
-- লেখা পড়া করি।
-- মনে কিছু করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞাস করতে চাই?
-- বলেন।
-- কোনো প্রেমট্রেম করেছেন বা কাউকে পছন্দ হয় এরকম কেউ আছে?
-- না ভাই, কোন প্রেমট্রেম এখনও করি নাই।
-- কাউকে পছন্দও করেন নাই?
-- পছন্দ তো অনেককেই হয়।
-- অনেককে পছন্দ হলেও অনেককে তো বিয়া করা যাবে না। যে কোন একজনকে বিয়ে করতে হবে, তাহলে না আপনি সুখি হতে পারবেন। শোনেন-- আমার দাদী বলেছেন, যে সংসারে একটা বউ দেখবি সেই সংসারেই শান্তি দেখবি। যে সংসারে দুইটা বউ দেখবি সে সংসারে অশান্তি দেখবি। আমার বয়স তো কম হলো না। পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই বয়সে দাদীর কথার অনেক সত্য প্রমাণ পেয়েছি। কাজেই আপনার ভাল লাগে এরকম একটা মেয়েকে পছন্দ করেন। পছন্দমত একটা বিয়া করেন, তাহলে জীবনে সুখী হতে পারবেন।
-- আমি যাকে পছন্দ করি সে যদি আমাকে পছন্দ না করে, তাহলে কি করে তাকে বিয়ে করবো?
-- আরে ভাই আমার দাদী আমাকে সেই জিনিষগুলোই শিখিয়ে দিয়ে গেছে। আমার দাদীর কথা হলো, কারো বিয়ে হয় না তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দিবি, বিয়া ভেঙে যায় যায় অবস্থা এরকম ভাঙা বিয়ে জোড়া দিয়ে দিবি, স্বামী স্ত্রী মিল নাই মিল করে দিবি, এরা যদি জীবনে সুখী হয় এবং উপরওয়ালার কাছে দোয়া করে, এর প্রতিদান সারাজীবন পেতেই থাকবি।
-- আপনি কি এই কাজগুলি করেন?
-- বলেন কি! দাদী মরার পর থেকে আমিই তো এই কাজগুলি করছি। শোনেন, আপনার যদি কোনও মেয়ে পছন্দ থাকে, তার কাছে আপনি পাত্তা পাচ্ছেন না। আমি আপনাকে কামরুপ কামাখ্যার অরজিনাল গাছ দিয়ে একটা তাবিজ দিয়ে যাবো। দেখবেন, গছের কি গুণ! আপনার উপকারে গাছ আপনার হয়ে কথা বলবে আপনাকে কিছুই বলা লাগবে না।
লোকটির কথা শুনে সোহেল বিগলিত হয়ে বলল, আপনার তাবিজের দাম কত?
লোকটি দামের কথা শুনে চোখে মুখে আশ্চার্যের ভাব ফুটিয়ে তুলে জিব কেটে মাথা ডানে বামে ঝাকিয়ে বলল, আস্তাগ ফিরুল্লাহ। আমার দাদীর নিষেধ আছে, তাবিজের বিনিময়ে কোন দাম নেয়া যাবে না। আর কখনই কামরুপ কামাখ্যার তাবিজের দাম দেয়ার চেষ্টা করবেন না, তাবিজের দামের কথা বললে সেই তাবিজে কাজ হয় না।
লোকটি জিহ্বা কাটায় সোহেল যেন লজ্জাই পেল, আস্তে করে বলল, তবে কি নেন আপনি?
সোহেলের লজ্জাবনত মুখ দেখে লোকটি হাসি দিয়ে বলল, চিন্তা করবেন না, এই মুহুর্তে আপনার কাছে তাবিজের কোন দাম নিব না, কারণ কামরুপ কামাখ্যার গাছ গাছড়ার একটি শিকড়ের মূল্য লাখ টাকা দিয়েও পরিশোধ করতে পারবেন না। শুধু আপনাকে বিশ্বাস করানোর জন্য একটি তাবিজ দিয়ে যাবো, তাবিজে যদি উপকার পান তখন আপনি নিজেই আমাকে খুঁজে বের করে পুরুস্কার দিবেন। তবে তাবিজের বিনিময়ে দাম নিব না এই সত্য কথার পাশাপাশি আরেকটি সত্য কথা না বলে পারছি না, সেটা হলো-- যেহেতু আমার পেট আছে, আমাকে খেতে হয়, চলতে হয়, কাপড় পরতে হয়, সেই সব বিবেচনা করে আমার খরচ স্বরুপ খুশি হয়ে যা পারেন দিবেন। আরেকটি কথা হলো, টাকা পয়সা যাই দেন তাতে যেন আপনারও কোন কষ্ট না হয় আমারও মনটা বেজার না হয়।
তার কথার ম্যারপ্যাচ আর কথা বলার ভঙ্গি দেখে সোহেল টাকার পরিমাণ অনুমান করতে না পেরে সাধ্যের অতিরিক্ত টাকা দাবী করার অশংকায় মুখটা কাচুমাচু করে বলল, আপনাকে কত দিলে যে আপনি খুশি হবেন এটা আমি কি করে বুঝবো?
সোহেল কাচুমাচু মুখে কথা বলায় লোকটি সাহস দেয়ার জন্য হাসি দিয়ে বলল, আরে ভাই আমি কি দশ তলায় থাকি নাকি? আমাকে খুশি করতে তো লাখ লাখ টাকা লাগবে না। আমি গরীব মানুষ, চারটা ডাল ভাতের পয়সা হলেই আমি খুশি।
ডাল ভাতের পয়সা দিলেই খুশি হবে এমন কথায় সোহেলের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠল, মনে কিছুটা ভরসা পেল, আগ্রহ নিয়ে বলে-- তাই নাকি! তাহলে দেন।
সোহেল তাবিজ দিতে বলায় লোকটি তার দুর্বলতা বুঝতে পেরেই তাকে আরো দুর্বল করার জন্য গাছের অলৌকিক কিছু দেখানোর জন্য বলল, আপনার কাছে পানি আছে?
সোহেলের কাছে পানির বোতল ছিল বলল, হ্যাঁ।
-- আমাকে একটু পানি দেন, গাছের কি ক্ষমতা সেটা আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।
বোতল এগিয়ে দিতেই লোকটি বলল, ডান হাতটা এগিয়ে দেন।
সোহেল ডান হাতটা তালু খুলে মেলে ধরল। লোকটি ব্যাগের ভিতর থেকে একটি কৌটা বের করল। কৌটা খুলে চিকন চিকন দু’টি একই রকমের শিকড় বেড় করে সোহেলের হাতের তালুর উপর রেখে কৌটার মুখ বন্ধ করে দিল। শিকর দু’টি পাশাপাশি কয়েক মিলিমিটার ফাঁকে রেখে বোতল খুলে সামন্য পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিল। পানিতে ভিজে যাওয়ার একটু পরেই শিকড় দু’টি মোচড়া-মুচড়ি করতে করতে একটা আরেকটার সাথে জড়িয়ে গেল। সোহেল নিজেও দেখে আশ্চার্য হলো। জড়ানো শিকড়টি হাতে তুলে নিয়ে লোকটি বলল, আপনি নিজের চোখেই তো দেখলেন? এখানে আর কোন সন্দেহ আছে কি? দু’টি আল্লার সৃষ্টি গাছের শিকড়ে আল্লার রহমতের সামান্য পানি দেয়া হয়েছে, এছাড়া আর কি কিছু দেয়া হয়েছে?
সোহেল বলল, না।
-- আপনি নিজের চোখেই তো দেখলেন, দু’টি শিকড় কেমন করে মিল মহব্বতে জড়াজড়ি করে নিজে নিজেই প্যাচালো। এইরকম আপনিও যাকে পছন্দ করেন আমার দেয়া তাবিজ হাতে নিয়ে নিয়ম পালন করে তার সাথে দেখা করবেন, আল্লাহর রহমতে আপনাদের মধ্যেও মিল মহব্বত হয়ে পরস্পর পরস্পরের বন্ধনে জড়িয়ে যাবেন। এক সময় মহাব্বত এমন হবে কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেই পারবেন না। বলেই শিকড় দু’টি জড়ানো অবস্থায় একটি লোহার তাবিজের খোলের ভিতর ভরে মম দিয়ে মুখ আটকিয়ে দিল।
তাবিজটি সোহেলের ডান হাতে দিয়ে কিছু নিয়ম বলে দিল। তাবিজ ধারনের নিয়ম বলা শেষ হলে সোহেল তবিজটি সার্টের উপর পকেটে রেখে দিল। প্যান্টের পকেট থেকে একশ’ টাকার একটি নোট বের করে লোকটির হাতে দেয়ায় লোকটি খুশি হয়ে বলল, আপনি নিয়ম মেনে মেয়েটার সাথে দেখা করেন। আপনার একশত ভাগ কাজ হবে। যদি কাজ না হয়, তাহলে সামনের মাসে এখানেই আমার দেখা পাবেন, আমি এর চেয়েও কড়া তাবিজ দিব। তবে নিয়ম মতো মেয়েটার সাথে দেখা করলে ইনশআল্লাহ এই তাবিজেই কাজ হয়ে যাবে, বলেই সোহেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
সোহেল লোকটির কথায় দুর্বল হলেও ছোট থেকেই তার তাবিজ কবচের উপর বিশ্বাস কম। তারপরও একশত টাকা দিয়ে তাবিজ নেয়ার কারণ হলো কামরুপ কামাখ্যার গল্প তার কাছে খুব ভাল লেগেছে। গল্প ভালো লাগার কারণেই টাকা দিয়েছে তাবিজের জন্য নয়।
রাতে সোহেল শুয়ে শুয়ে নানা রকম চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তার তাবিজের কথা মনে পড়ে গেল। ছোট থেকেই কামরুপ কামাখ্যার অনেক কাহিনী শুনেছে। কামখ্যায় নাকি তান্ত্রিকেরা যাদু মন্ত্র দিয়ে অনেক কিছু করতে পারে। তাবিজ দিয়ে অবাধ্য মানুষকে বাধ্য করতে পারে। এসব যাদু-মন্ত্র তাবিজ কবচের কথা শুধু মুখেই শুনেছে কখনও বাস্তবে চোখে দেখে নাই। যদি সত্যি সত্যিই তাবিজ দিয়ে মানুষকে বাধ্য করা যায় তাহলে সে সেটা পরীক্ষা করে দেখবে। আর যদি সত্য না হয় তাহলে ঐ লোকটাকে সামনের মাসে পেলে গাছের সাথে বেঁধে পিটাবে।
কিন্তু তাবিজের সত্যতা পরীক্ষা করবে কিভাবে? প্রয়োগ করার মত তো কাউকে না কাউকে লাগবে? ক্লাসে যে কয়জন মেয়ে আছে তারা সবাই কারো না কারো সাথে জুটি বাঁধা। তাদের উপর এই তাবিজের প্রয়োগ করতে গেলে গন্ডগোল বাঁধতে পারে। ইউনিভার্সিটির ছেলেরা কেউ কারো চেয়ে কম নয়। নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে আরেকজন ঘুরে বেড়াবে এটা তারা কেউই মেনে নিবে না। ইউনিভার্সিটির মেয়েদের নিয়ে চিন্তা করতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল সাদিয়ার কথা। সাদিয়া মনে হয় কারো সাথে মন দেয়া নেয়া করে নাই। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দরী নয় তবে খারাপও নয়। মাঝারী ধরেনের গড়ন। শ্যামলা চেহারা। মাথায় লম্বা চুল। ক্লাসের অনেকের চেয়ে ভাল। চুপচাপ থাকে। কারো সাথে আড্ডা দেয়া তো দূরের কথা বিনা প্রয়োজনে কথাও বলে না। ইয়ার্কী ঠাট্টার ধারে কাছেও নাই। মনোযোগ দিয়েই ক্লাস করে, নিজের নোট নিজেই তৈরী করে। অনেকেই তার কাছে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। সোহেল মনে মনে চিন্তা করল, যে মেয়েকে কেউ প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে রাজী করাতে পারে নাই তার উপরেই তাবিজটি প্রয়োগ করা দরকার, তাহলেই না বোঝা যাবে কামাখ্যার তাবিজ সত্য না মিথ্যা। যদি সত্যি সত্যি তাবিজ দিয়ে মানুষের মন ফেরানো যায় তাহলে এটাই হবে তার জন্য উপযুক্ত পরীক্ষা। কালকেই সে তাবিজসহ নিজে গিয়ে সাদিয়ার কাছে প্রেমের প্রস্তাব দিবে।
পরদিন ক্লাসে গিয়ে সাদিয়ার পাশের সিটেই বসল। সোহেল ক্লাসে সবসময় সামনের বেঞ্চিতে বসে। আজ ইচ্ছা করেই একটু পরে এসেছে যাতে সামনের সিটগুলো আগেই পূর্ণ হয়ে যায়, সামনের সিট পূর্ণ হলে বিনা কৈফিয়তে সাদিয়ার পাশে বসতে পারবে। সাদিয়া সবসময় পিছনের সিটে বসে। বেশির ভাগ সময় একা একা বসে। ক্লাসের অনেকে অনেক কথা বললেও কারো কথায় সে কান দেয় না। তার মত সে নিরবে সব কথা সয়ে যায়। সোহেলকে পিছনের সিটে বসতে দেখে সাদিয়া কিছুটা আশ্চার্য হয়েই জিজ্ঞেস করল, কি রে সোহেল, তুই আজ পিছনে কেন?
সোহেল মনে মনে খুুশি হয়েই কৌশলে জবাব দিল, বাসা থেকে আসতে দেরি হয়েছে তো এই জন্য পিছনে বসলাম। কেন তোর কি কোন সমস্যা আছে?
-- নাহ, আমার আবার কি সমস্যা, কোনও দিন তো তোকে পিছনে বসতে দেখিনি, এইজন্য জিজ্ঞেস করলাম।
সোহেলের গায়ে হাফ হাতা সার্ট। ডান হাতে কালো সুতা দিয়ে তাবিজ বাঁধা। কবিরাজের নিয়ম অনুযায়ী তাবিজটি বের করে রেখেছে। হাতের দিকে তাকিয়ে তাবিজ দেখে সাদিয়া কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, হাতে তাবিজ বেঁধেছিস কেন রে?
সোহেল এমন একটি প্রশ্নের আশাই করেছিল, সেই প্রশ্নই যেন সে করেছে, সাদিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এমন একটা ভাব নিয়ে জবাব দিল, যেন সাদিয়ার কথার উত্তর না দিলেও পারতো তারপরেও অনিচ্ছা সত্বেও উত্তর দিচ্ছে, হাতে তাবিজ কেন বেঁধেছি ব্যাখা করতে পারবো না, তাবিজ দেখতে ভাল লাগলে তুই দেখতে থাক।
সোহেলের এ কথাটি বলার উদ্দেশ্য হলো-- কবিরাজ বলেছে, কাঙ্খিত মহিলা যদি হাতে বাঁধা তাবিজের দিকে একবার নজর দেয়, তা হলেই তার মন নরম হয়ে যাবে। পর পর সাতদিন তাবিজ দেখলে আস্তে আস্তে আসক্ত হয়ে প্রেমের প্রস্তাবে সারা দিবে। কবিরাজের এই কথার উপর বিশ্বাস করেই সোহেল সাদিয়াকে কৌশলে তাবিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে বলল। তার বিশ্বাস, সাদিয়া তাবিজের দিকে যত তাকাবে তার মন তত দুর্বল হবে।
চলবে--
ছবিঃ গোগুল
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচে ক্লিক করুন---
প্রেমের কামাখ্যা তাবিজ
প্রেমের কামাখ্যা তাবিজ (২)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৮ রাত ১২:৪০