শামচুল হক
দাদাকে দাদী প্রথম দেখেই ভালোবেসেছিল কিন্তু প্রকাশ করে নাই। কারণ দাদী তাকে ভালোবাসে এই কথা প্রকাশ করলে সৎমায়েরা দাদাকে মেরে ফেলতো।
দাদাকে সবাই মিলে নজর বন্দী করে রেখেছে। দাদার যখন হুশ ফিরে আসে তখন বাড়ির কথা মনে পড়ে। দাদা প্রতিদিনই জঙ্গল থেকে বের হওয়ার জন্য চেষ্টা করতো কিন্তু বের হতে পারতো না। জঙ্গল থেকে বের হওয়ার জন্য সারাদিন ঘোরাঘুরি করে শেষে সন্ধা হলে দেখতো সেই বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
দাদীর সৎমায়েরা দাদীকে দিয়ে বাড়ির রান্নাবাড়ার সব কাজ করাতো আর দাদাকে দিয়ে ক্ষেত খামারের কাজ থেকে শুরু করে কাঠ কাটা, লাকরী চেরা, গরুর ঘাস কাটা ইত্যাদি কাজ করাতো। এমনি করে দাদার ছয়মাস কেটে যায়। দাদী সুযোগ বুঝে চুপে চুপে এসে দাদার সাথে মাঝে মাঝে কথা বলতো। চুপে চুপে কথা বলতে বলতে দাদী দাদাকে ভালোবাসে। দাদীও দেখতে মোটামুটি সুন্দরী ছিল, এক পর্যায়ে দাদাও দাদীকে ভালোবাসে। তাদের এই ভালোবাসাবাসির খবর দাদীর বাড়ির লোকজন জানে না। যদি জানতো তাহলে নাকি দাদাকে যাদু টোনা করে মেরে ফেলতো।
আসামের জঙ্গলে কার্তিক মাসে বড় একটা পুজা হয়। দাদীর কাছে শুনেছি সেই পুজায় আসামের তান্ত্রিকেরা মানুষ বলি দিয়ে গুণমন্ত্রের বড় সাধনা করে। দাদীর বাড়ির লোকজন ঠিক করেছে দাদাকে সামনের পুজায় বলি দিয়ে সেই রক্ত দিয়ে পুজা করবে। দাদাকে বলী দেয়ার কথা গোপনে বলাবলি করলেও দাদী চুপে চুপে শুনে ফেলে। দাদীর ভালোবাসার মানুষকে বলী দিবে এটা দাদী মেনে নিতে পারে না। যাকে মনে প্রাণে ভালোবেসেছে তাকে কিভাবে বাঁচাবে সেই চিন্তা করতে থাকে। অবশেষে দাদাকে নিয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। দাদী দাদাকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও কোনভাবেই তাদের নজর এড়িয়ে পালানোর সুযোগ পায় না। ঠিক বড় পুজার একমাস আগে অমাবস্যা রাতে আরেকটি পুজা হয়, সেই পুজায় সবাই মিলে সন্ধ্যা রাতে মন্দিরে পুজা দিতে গেছে। বাড়িতে কেউ ছিল না। শুধু দাদা আর দাদী ছিল। এই সুযোগে দাদী দাদাকে নিয়ে পালিয়ে আসে।
দাদী পালিয়ে আসার সময়ও অনেক ঘটনা ঘটে। দাদীর যে দাদা আছে তার ঘরে বুড়োর সংগৃহীত যাদুমন্ত্রের অনেক জিনিষ পত্র ছিল। জিনিষগুলো কাঠের বাক্সে রাখাছিল। সেই বাক্স ভেঙ্গে দাদীর জানামতে যেগুলি সে কাজে লাগাতে পারবে সেই যাদুর জিনিষপত্র নিয়ে পালিয়ে আসে। দুইজনে বাড়ি থেকে পালিয়ে নদীর পাড়ে এসে পড়ে বিপদে। রাতের অন্ধকারে নদী পাড় হবে কি দিয়ে। পাড় হওয়ার মত কোন নৌকা ভেলা কিছুই নাই। পরে দাদী ফল ধরে না এমন একটা গাছে দাদাকে সাথে নিয়ে উঠে গুণমন্ত্রের মাধ্যমে শূন্যে উড়াল দিয়ে এক রাতেই ময়মনসিং চলে আসে। খুব ভোরে বেলা উঠার আগেই দাদা দাদীকে নিয়ে বাড়িতে এসে হাজির। দাদার বাবা মা তো দাদীকে দেখেই চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দেয়। দাদী আসামী ভাষায় কথা বলে, মন প্রাণ দিয়ে সে দাদার বাবা মাকে বুঝনোর চেষ্টা করে কিন্তু তার কথা কেউ বুঝতে পারে না। দাদা কিছু বলতে চাইলেও দাদার বাবা লাঠি নিয়ে মারতে আসে, সে কিছু বলার চেষ্টা করলেও কোন সুযোগই পায় না। তাকে না জানিয়ে বিয়ে করে এনেছে এটা তারা কোন ভাবেই মেনে নিতে চাচ্ছে না। দাদী তার শ্বশুর শ্বাশুরীর কথা বুঝতে না পারলেও তাদের রাগারাগি বুঝতে পারে। তাদের চিৎকার চেচামেচির ভাবসাব দেখে দাদী কি এক মন্ত্র পড়তেই বাড়ির সব লোকের জবান বন্ধ হয়ে যায়। কেউ নড়াচড়াও করে না কথাও বলে না। এ অবস্থা দেখে দাদা তো দাদীর কর্মকান্ড বুঝতে পেরেছে। পরে দাদার অনুরোধে দাদী মন্ত্র উঠিয়ে নিলে তাদের জবান খুলে যায়।
এই ঘটনায় বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে যায়। দাদীর উপরে আর কেউ রাগ করে নাই কারণ যদি দাদী ক্ষেপে গিয়ে মুখের জবান বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে পুরো বাড়ির লোকজন দাদীর ভক্ত। আর কোনদিনও কেউ দাদীর উপর দিয়ে কথা বলে নাই। দাদীর এই কাহিনী শুনে পুরো গ্রামের লোকজন দাদীকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, দাদীর গুণের কথা যতদূর পর্যন্ত প্রচার হয়েছিল, ততদূর পর্যন্ত লোকজন এসে বাড়ি ভরে গিয়েছিল। এরপর থেকেই নানা রোগের চিকৎসা করানোর জন্য মানুষ লাইন ধরে থাকতো। কারো পানি পড়া, কারো ঝাড়ফুক, কারো তাবিজ-কবচ, কারো ভুত-পেতœীর আছড়, কারো জ্বীন-পরীর আছড় ইত্যাদি চিকিৎসায় দাদী সারাদিন ব্যস্ত থাকতো।
দাদী আসাম থেকে দাদার সাথে ওই যে পলিয়ে এসেছিলো আর কোন দিনই আসামে যায় নাই। মরার পূর্ব পর্যন্ত দাদার ভিটাতেই ছিল। দাদী দাদাকে খুব্ ভালোবাসতো আবার দাদাও দাদীকে খুব ভালোবাসতো। তাদের এরকম ভালোবাসার দম্পতি দুই চার দশ গ্রামের মধ্যে আর একটাও ছিল না। আমার বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দাদা দাদীর মধ্যে কখনও ঝগড়া হতে দেখি নাই।
আমাদের ছোটবেলার যত চিকিৎসা সব দাদীই করতো। আমরা কখনও ডাক্তারের কাছে যাই নাই। দাদী বেঁচে থাকতে আমাদের সাথে নিয়ে মাঝে মাঝে জঙ্গলে যেতো। জঙ্গল থেকে নানারকম গাছগাছড়া তুলে আমাদের মাথায় দিত, আমরা দাদীর গাছগাছড়া মাথায় বহন করে বাড়ি নিয়ে আসতাম। সেই গাছগাছড়ার ঔষুধ বানিয়ে মানুষকে দিত। দাদীর সাথে সাথে থেকেই তো কিছু গুণমন্ত্র গাছগাছড়ার কাজ শিখেছি। দাদী তো অনেক কিছু দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তখন বুঝতে পারি নাই। যদি দাদীর গুণমন্ত্র সব শিথে রাখতাম তাহলে আমার আর এখন ঘুরে বেড়ানো লাগতো না। ঘরে বসেই হাজার হাজার টাকা রোজগার করতে পারতাম। সেই বুঝতে পেলাম দাদী মরে যাওয়ার পর।
সোহেল এতক্ষণ তন্ময় হয়ে লোকটির কথা শুনছিল। সময় কিভাবে কেটে গেছে বলতেই পারে না। লোকটি চলিত ভাষায় সুন্দর করে কথা বলতে পারে। তার কথা বলায় রস আছে। যে কোন লোক একটু মনোযোগ দিলেই তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠতে পারবে না। কথা বলার সময় হাত নাড়ানো আর মুখের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি দেখলে মনে হয় বাস্তবেই যেন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। লোকটির কথা বন্ধ হলেও তার কাছে কাহিনী অসম্পূর্ণ মনে হলো। আরো অনেক কিছু জানার আগ্রহ জন্মালো। লোকটিকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা আপনার দাদীর তো সৎমা ছিল। তারা তাকে অত্যাচার করত, সারাদিন তাকে দিয়ে কাজ করাতো তাহলে তিনি গুণমন্ত্র শিখলো কার কাছে?
ও এই কথা, এইটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ছোট থাকতে দাদীর মা মরে গেলে দাদীর দাদী তাকে লালন পালন করেছে। দাদীর দাদী মারা যাওয়ার সময় দাদীকে তার দাদার হাতে তুলে দিয়ে বলে গেছে, যত দিন বেঁচে থাকবেন আমার নাতনীর যেন কষ্ট না হয়। এই কারণে বুড়ো দাদীকে খুব আদর করতো। এই বুড়োই দাদীকে গুণমন্ত্র শিখিয়েছে। ওই বাড়ির মধ্যে সবাই গুণীন কিন্তু দাদীর দাদাই ছিল সব চেয়ে বড় গুণীন এবং সবার ওস্তাদ।
আপনার দাদী কি কি গুণ মন্ত্র জানতো?
আরে ভাই সে কথা কি বলবো, আমার দাদী অনেক কিছু জানতো। আমি নিজ চোখে দেখেছি-- যত বিষাক্ত সাপে কামড়াক না কেন দাদীর কানে খবরটা দিতে পারলেই সেই রুগী আর মরতো না। দাদী বাঘের মুখ বন্ধ করতে পারতো। মারামারি করার সময় যদি লাঠি পড়া দিতো, সেই লাঠি দিয়ে যাকে পেটন দেয়া হতো এবং যেখানে পেটন পড়তো সেখানকার চামড়া লাঠির সাথেই উঠে আসতো। শুধু তাই নয় শরীরের যেখানে চামড়া উঠে যেত সেখানেই মরিচের মত জ্বলতো। জুলুনির চোটে চামড়া উঠা লোক ঘোড়ার মত চিৎকার করতো।
বলেন কি? লাঠির সাথে চামড়া উঠে আসতো! এটা কি করে সম্ভব?
ভাই, দাদীর লাঠি পড়ার রহস্য আমিও তো বলতে পারছি না। কি করে যে এমন হতো সেটা দাদী, দাদীর ওস্তাদ আর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে দাদী ছাড়া এসব মন্ত্র আর কেউ জানে না।
কেন এসব আপনাদের শিখায় নাই?
না ভাই, এসব শিখতে চাইলেই দাদী বলতো, দাদারে-- আরো বড় হ, বড় হলেই শিখাবো। বড় হওয়ার পরে যখন বললাম, তখন বলল, আরো বয়স হতে হবে। এই বয়সে তোদের মধ্যে ভারত্ত আসে নাই। এখন এসব শিখাইলে যখন তখন মাথা গরম কইরা নানান অঘটন ঘটায়া ফালাইবি।
কারণ?
কারণ হলো-- অল্প বয়সে শিখালে রক্তের গরমে যখন তখন কারো সাথে ঝগড়া হলেই যদি এসব মন্ত্র খাটিয়ে ফেলি, তাহলে তো যখন তখন যে কোন মানুষের ক্ষতি হয়ে যাবে, এইজন্য ধৈর্য ধারনের ক্ষমতা না আসা পর্যন্ত বড় বড় মন্ত্রগুলো কাউকে দেয় নাই। আমার বাবার মেজাজ গরম ছিল, যখন তখন রেগে যেত, সেই কারণে দাদী মা হওয়ার পরও তাকে কিছুই শিখাই নাই।
আপনার দাদীর কি খুব ধৈর্য ছিল?
বলেন কি, খুব ধৈর্য ছিল মানে! আমরা ছোট বেলায় দাদীকে কত উৎপাত করেছি। দাদী কখনই আমাদের সাথে রাগ করে নাই। শুধু তাই নয়, গভীর রাতে মানুষ চিকিৎসার জন্য এসে দাদীর ঘুম নষ্ট করতো, তারপরেও দাদী কারো উপর রাগ করতো না। রাতেই তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো। দাদীর পক্ষে দাদা মানুষের সাথে রাগারাগি করতো কিন্তু দাদী রাগ করতো না। বরঞ্চ দাদাকে মানুষের সাথে খরাপ ব্যবহার করতে নিষেধ করতো। দাদী দাদাকে বলতো, আল্লা সবার কাছে সব রকম ক্ষমতা দেয় না। আবার সবার দ্বারা সবার উপকার হয় না। আমি জেনে শুনে যদি মানুষের উপকার না করি, তাহলে আল্লাহ বেজাড় হবে।
চলবে--
ছবিঃ গোগুল
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচে ক্লিক করুন---
প্রেমের কামাখ্যা তাবিজ
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:০৫