শামচুল হক
স্যারের পেটন খাওয়ার পরে ওর সাথে যে দু’দিন কথা বলেছি তাতেই ওর প্রতি আমার একটা আন্তরিকতা এসে গেছে। তবে সে আন্তরিকতায় অন্য কোন দুর্বলতা ছিল না, স্কুলের সহপাঠি হিসাবে কথার খুনসুটির মাধ্যমে যতটুকু পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতা হওয়া দরকার তাই। ঐ বয়সে দুষ্টুমী করতে গিয়ে ঝগড়া শুধু দিপালীর সাথেই নয় এরকম ঝাগড়া অন্য মেয়েদের সাথেও হয়েছে। মুখে কুলোতে না পারলে দূরে থেকে হাত তুলে কিল দেখাতাম। তাতে ওরা আরো ক্ষেপে যেত। ওরা ক্ষেপে গেলে নিজের কাছে খুব খুশি খুশি লাগত। সবার চক্ষু ফাঁকি দিয়ে আড়ালে আবডালে কিল দেখানোর কারণে জোরে চিল্লাতেও পারতো না, আবার অপমানবোধ করে স্যারের কাছে বিচারও দিতে পারতো না। ঝগড়া এমনি এমনি বাঁধলেও দোষ ত্রুটি ওদেরও থাকতো। ওরা এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চেষ্টা করতো, অনেক সময় সুযোগ পেত অনেক সময় সুযোগ পেত না। সে সব কথা মনে হওয়ায় ইচ্ছা ছিল স্কুলের মাঠে বা ক্লাসে আমার দিকে তাকালে আমি দিপালীকে কিল দেখাবো। এতে ও হয়তো আরো ক্ষেপে যাবে। কিল দেখে ক্ষেপে গেলে আমার কাছে খুব আনন্দ লাগবে। কিন্তু স্কুলের মাঠে ওকে পেলাম না, ক্লাসে বসে ওর দিকে দু’তিনবার তাকালাম ও আমার দিকে একবারও তাকালো না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ও যখন সামান্য বড়ই নিয়ে ঝগড়া করে আমার সাথে কথা বলছে না আমিও আর ওর সাথে কথা বলবো না। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে দিপালী অনেকদিন স্কুলেই আসল না। অন্য মেয়েরা সবাই আসতো শুধু দিপালী আসতো না। ওকে খ্যাপনোর জন্য মনে মনে যে পরিকল্পনা করেছিলাম তা কোন কাজেই লাগাল না।
গ্রীষ্মের ছুটি তখনও শুরু হয়নি। মর্নিং ক্লাস চলছে। এগারোটার দিকে ক্লাস শেষ করে আমি স্কুলের পূর্বদিকে নদীর তীরে বেড়াতে গিয়েছি। নদীর পাড় থেকে মেয়েলী কণ্ঠে গানের কলি ভেসে এল।
মনের ভুলে নদীর কুলে হাটছি একা একা
এদিক ওদিক বৃথাই খুঁজি নাই তো বন্ধুর দেখা
কৃষ্ণ হেথায় নাইরে কোথাও আছে শুধু রাধে
কোন বিরহে দক্ষিণ বাতাস হুহু করে কাঁদে
এই ছিল কি বিরহিনীর কপালে গো লেখা
এদিক ওদিক বৃথাই খুঁজি নাই তো বন্ধুর দেখা।
দুপুর রোদে তমাল তলে কে বাজায় গো বাঁশি
বাঁশির সুরে টিকতে নারি মন হয় উদাসী
বুকের মাঝে বাড়ায় জ্বালা-- কপাল জুড়ে রেখা
এদিক ওদিক বৃথাই খুঁজি নাই তো বন্ধুর দেখা।
(সংক্ষিপ্ত গান)
কণ্ঠটি চেনা চেনা মনে হলো। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি নদীর দিক থেকে দিপালী ভিজা কাপড়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে আসতেছে। পিছনে আরেকজন মাঝবয়েসি মহিলা ভিজা সাদা শাড়ী পরনে। দিপালী প্রথমে আমাকে লক্ষ্য করে নাই। যখন আমাকে দেখতে পেল তখন সে গান গাওয়া বন্ধ করে দিল। আমার কাছাকাছি এসে বলল, কিরে তোর ক্লাস নাই?
--- ক্লাস শেষ করেই তো আসলাম।
--- এগারোটার সময় ক্লাস শুরু হয়, তোর আবার ক্লাস শেষ হলো কেমনে রে?
--- আজ থেকে যে মর্নিং ক্লাস শুরু হয়েছে তুই জানিস না?
--- জানবো কি করে রে, আমি তো অনেক দিন হলো স্কুলে যাই না।
--- কেন, যাচ্ছিস না কেন?
দিপালী কি যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পিছন থেকে মহিলাটি এসে বলল, এ দিপালী, এ ছেলেটা কে রে?
দিপালী মহিলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ও আমাদের সাথে পড়ে মা।
দিপালী আমার সাথে ওর মাকে পরিচয় করে দিল, ইনি আমার মা হয়।
আমি দিপালীর মাকে নমষ্কার দিয়ে বললাম, কাকী, ওকে স্কুলে পাঠান না কেন?
দিপালীর মা একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, বাবা-- স্কুলে তো পাঠাতে চাই, কিন্তু আমার তো স্কুলে পাঠাবার সামার্থ নাই।
-- কেন, কাকা কি করেন?
দিপালীর মা আরেকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, তোমার কাকা থাকলে কি আর ওর লেখা পড়া বন্ধ হয় বাবা!
-- কেন কাকী, কাকা কোথায় গেছে?
-- তোমার কাকাকে একাত্তরের যুদ্ধে পাক সেনারা বাসা থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে মেরেছে বাবা।
এ কথা শোনার পর আমি চুপ হয়ে গেলাম। দিপালীর বাবা সম্পর্কে না জেনে প্রশ্ন করায় নিজেকে অপরাধী মনে হলো। আমার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ করেই পুরো পরিবেশটা বিষাদে ভরে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর দিপালীর মা কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, তুমি ওর বইগুলো বিক্রি করে দিতে পারবে বাবা--?
দিপালীর মায়ের কথা শুনে দিপালীর মুখের দিকে তাকালাম, ওর চোখ দিয়ে তখন টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। স্বামীহারা স্ত্রীর কান্না আর বাপ হারা মেয়ের চোখের জল দেখে ব্যথিত হলাম। নিজের ভিতেরও কেমন কান্নার আবেগ চলে এলো। নিজেকে সামাল দিতে পারছিলাম না। আমার চোখে জল আসার আগেই সরে যেতে ইচ্ছে হলো। মাথা নিচু করে বললাম, ঠিক আছে কাকী, আমি চেষ্টা করে দেখব। চেষ্টা করে দেখব কথাটি বলেই বললাম, তাহলে কাকী আমি এখন যাই।
দিপালীর মা মুখে ভেজা আঁচল গুজে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে বাবা যাও, আশির্বাদ করি বাবা, তোমরা ভাল ভাবে লেখাপড়া কর।
কিছুদূর যাওয়ার পরে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তখনও দু’জন মুখে কাপড় গুঁজে নিচের দিকে মাথা দিয়ে আস্তে আস্তে যাচ্ছে। বাবা হারা দিপালীর দুরাবস্থা আমার কাছে খুব খারাপ লাগল। মনে পড়ে গেল ২৬শে মার্চের গাওয়া দিপালীর সেই গান। গান গাওয়ার সময় দিপালী কাঁদলো কেন সেদিন না বুঝলেও আজকে বুঝতে পেলাম। সেই দিনের কান্না জড়িত কন্ঠে গান গাওয়ার দৃশ্যটি বার বার চোখে ভাসতে লাগল। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেলাম। আমি আর নদীর দিকে না গিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। এই দিনের পর থেকে দিপালীর সাথে অনেক দিন আর দেখা হয়নি।
(ছবি ঃ ইন্টারনেট)
আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন- - -- - -
গল্প ঃ দিপালী
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৫৫