দরজার বাইরে পা রাখতেই একঝাক বেয়াড়া বাতাস তার সারামুখে লুটিয়ে পড়ে; সেই সাথে বিশেষ এক ধরনের বায়ুতরঙ্গ ঢেউ খেলে যায়। মাবুদ আলীর মনটা তখন বিষাদে ভরে ওঠে। এই বাতাসটাও যেন অপয়া; পরতে-পরতে শৃঙ্খল মুক্তির গান।
বাইরের পৃথিবীতে মাবুদ আলীর নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয়, এর চাইতে জেলখানার চার দেওয়ালের মধ্যেই বরং ভাল ছিল। একঘেয়ে জীবন; তবু হতাশাময় মুহূর্তে যখন লোহার শিক ধরে দাঁড়াতো তখন সম্মুখে দৃশ্যমান হয়ে উঠতো একচিলতে আকাশ। ক্ষণভেদে তাতে কখনো মেঘ, কখনো জ্যোৎস্না, কখনো বা রৌদ্রের প্লাবন বইতো। অন্ধকার আকাশ তার একদণ্ড ভাল লাগতো না। বুকের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হতো। মনে হতো, এই বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে! অথচ ওখানেই কেটে গেল জীবনের এতগুলো বছর। দিনগুলো নেহায়েৎ মন্দ কাটেনি; চরমপন্থীদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল; গড়ে তুলেছিল অন্য আরেক ভুবন।
চলমান জীবনের অস্থিরতা সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিত। কারো অসুখ-বিসুখ হলে তার রেশ ছড়িয়ে পড়তো অন্য সবার মধ্যে। মনে হতো, বিশাল এই পৃথিবীতে অসুস্থ মানুষটিই তাদের একমাত্র আতœার আতœীয়। মৃত্যুর ওপারে যেতে না দেওয়ার অভিপ্রায়ে দিনরাত সেবা করতো। এক-একজন পালাক্রমে নিঘগুম রাত কাটাতো।
মাবুদ আলীর বিদায়মুহূর্তে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। কান্নার আকাশে জমা হয়েছিল ঘন কালো মেঘ। তাকে জড়িয়ে ধরে অনেকে কান্নাকাটি করেছে। সে নিজেও খুব কেঁদেছে। বুকের মধ্যে তখন তীব্র হাহাকার, স্বজন হারানোর ব্যথা; তথাপি চোখের জল মুছে দু’একজনের পিঠ চাপড়ে মাবুদ আলী সান্ত্বনা দিয়েছে, ধৈর্য ধরার মন্ত্র শিখিয়েছে, আরে রশিদ মিয়া, ভয় কিসের; দেখতে-দেখতে কখোন যে সময় গড়িয়ে যাবে বুঝতেই পারবে না!
রশিদ তথাপি বিক্ষুব্ধ। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। গলা ফুঁড়ে বাতাসের বুকে ঢেউ তুলেছে।
আর যাইহোক, তাদের কাছে মাবুদ আলী ছিল বটবৃক্ষের ছায়া। আড্ডাবাজ মানুষ; অবসর সময়ে সবাইকে নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিত; সুখ-দুঃখের গল্প করতো।
মালতি তার কেউ না- সমান্য একজন ঝাড়–দার; অথচ বিদায় পর্বে সেও এসেছিল। হাতে করে খাওয়াতে এনেছিল নিজের গাভির দুধ। কিন্তু ঐ দুধ মাবুদ আলীর গলা দিয়ে নামেনি। মালতির চোখের মধ্যে হঠাৎই মা’র মুখখানা ভেসে উঠেছিল। বহুদিন পর মা যেন ফিরে এসেছে! হুবহু একই রকম; জলভরা চোখে মায়ের আকৃতি নিয়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। অথচ কি আশ্চর্য্য, ঘোরলাগা চোখেও মূহুর্তের জন্য অভিমান এসে উকি দিয়েছিল। সেই যে বাবা হাত ধরে টানতে-টানতে নিয়ে গেছে, তারপর আর দেখা হয়নি। এক-এক করে পেরিয়ে গেছে ১৪ টি বসন্ত অথচ মা আসেনি; মাবুদ আলীর অপেক্ষার প্রহর কেবলই দীর্ঘ হয়েছে। মনে হয়েছে, ক্ষোভে-দুঃখে তারা বোধ হয় ছেলের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলেছে।
মাথায় হাত বুলিয়ে মালতি আশির্বাদ করে বলেছিল, ভাইরে, আজ তিকি আবার তোর নোতুন জীবন আরাম্ব হলু, ইবার যেন আর মাতা খারাপ করিস নি। বাপ-মার কোলে ফিরি যা, বিয়ি-থা করি ঘর-সংসারী হ।
সংসারের ভাবনা বড়বেশি জটিল; মাবুদ আলী ঐ ভাবনাটা নিজের মধ্যে ঠাই দিতে চায় না। তাছাড়া, বাইরের পৃথিবীতে ঠিকঠাক মেলাতে পারে না। নিজেকে অনাহুত মেহমান মনে হয়; যে-বা ঠিকানাবিহীন খাম।
কমরেড শরিফ ডাক্তারের স্মৃতি মনের মধ্যে ওঠানামা করে। অনেকদিন আগে তার কাছে লেখা চিঠিখানা সাথেই ছিল। নতুন করে আর একবার চোখ বুলায়-
‘কমরেড,
সারাক্ষণ মাথা ঠাণ্ডা রাখবে। তোমার ব্যাপারে হাইকমান্ডের অবশেষে টনক নড়েছে। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। আশা করি খুব শীঘ্রই বেরিয়ে আসবে। ততদিন তোমার বাবা-মা আর ভিটেমাটি রক্ষার দায়িত্ব আমার। মোকিম গাজীকে আমরাই সামলাবো। আমাদের আন্দোলন বৃথা যাবে না। মেহনতি মানুষের জয় একদিন হবেই হবে।’
চিঠিটা পড়ে চোখের কোণে যে আলোর আভা ফুটেছিল উঠেছিল দপ করেই তা আবার নিভে যায়। চিঠিটা পুলিশের হাতে এলো কিভাবে; নাকি প্রতারণার নতুন কোন ফাঁদ!
পরে কনস্টেবল নিজেই বিষয়টি পরিস্কার করে দিয়েছিল, ভয় নেই কমরেড; এখানেও তোমাদের লোকজন আছে।
কথাটা শুনে মাবুদ আলী সেদিন তার হারানো আতœবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল। মনে হয়েছিল, বেশিদিন হয়তো ভুগতে হবে না। তার আগেই কমরেডের ক্ষমতার পিঠে ভর করে মুক্ত বাতাসের স্বাদ নেবে; শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ হবে নতুন মাত্রা; হয়তো ভুবনডাঙার মাটিতে একদিন মোকিম গাজীর বিচার হবে; প্রতিটি কৃষক-শ্রমিক ফিরে পাবে তাদের নায্য অধিকার। কিন্তু তার স্বপ্নের ফানুস শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে পারে না, অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। পুলিশের মুখে কিছুদিন পরে জানতে পারে, কমরেড শরিফ ডাক্তার আর নেই; দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
শুধু শরিফ ডাক্তার নয়; জেলখানায় বসে আরো অনেক কমরেড হত্যার কথা শুনেছে। দল ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে। এরকম আশংকা মাবুদ আলীর মনের মধ্যে আগে থেকেই উকিঝুকি দিয়েছিল। এর জন্য পার্টির কতিপয় নেতার নৈতিক অধঃপতনই দায়ী। মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললে হবে কি; মূলত তারা ছিল পুজিবাদের অন্ধ প্রতিভূ। দলীয় আদর্শ ভুলে বিলাসীতার অন্ধকার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া দলের সদস্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন প্রকার বাছ-বিচার পর্যন্ত ছিল না। চারু মজুমদার কিংবা আব্দুল হকের শ্লোগান মুখে নিয়ে ছ্যাছড়া চোর-ডাকাত পর্যন্ত দলে ভিড়ে গিয়েছিল। দলভাঙার ক্ষেত্রে এটা ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের নীলনকশা।
তবু কোন কোন কমরেড হয়তো এখনো বিশ্বাস হারায় নি; মাঠে ময়দানে রয়ে গেছে, দুর্বল মুহূর্তে সুদিনের স্বপ্ন দেখে।
ভুবনডাঙার মাটিতে পা দিয়ে মাবুদ আলী আরেক-দফা অবাক হয়। এটাই কি সেই ভুবনডাঙা! নিজের গ্রামটাকে চিনতে তার কষ্ট হয়। আগে দেখা দৃশ্যের সাথে কোন মিল নেই। হারিয়ে গেছে দিগন্ত-জোড়া মাঠ আর ঝোপঝাড়। সেখানে নির্মিত হয়েছে ঘিঞ্জি কুঁড়েঘর। প্রায় প্রতিদিনই ঘ.এ.ঙ কর্মীগুলো বর্গীর মতো হানা দেয়, রক্তচোষা বাদুড়ের মতো নিরীহ মানুষকে শোষণ করে, কিস্তির টাকা শোধ করতে না পারলে ঘরের চালা, হালের বলদ পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়।
মাবুদদের ভিটার উপর দাঁড়ালে চোখের সম্মুখে সোনাকান্দরের বিল ছবির মত ভেসে উঠতো। চারদিকে অথৈই জলরাশি। পানির ওপর শাপলা-শালুক আর কলমিলতার মেলা। সাদা-শাপলাগুলো যেন অন্ধকার আকাশে নামহীন নক্ষত্র! গভীর রাতে ভেসে উঠতো কাউন পাখির ডুব, ডুব, ডুব শব্দ। উত্তরের বাতাসে মিশে থাকতো বুনো ফুলের গন্ধ। শীতকালে বিলের পানি চারদিক থেকে গুটিয়ে প্রায় তলানিতে ঠেকতো। উপরে জমা হত দুধের সরের মত শ্যাওলার আস্তরণ। অথচ ঐ বিলের কোন অস্তিত্বই আজ আর অবশিষ্ট নেই, সব ভরাট হয়ে গেছে।
পথের বাঁকে-বাঁকে রকমারি দোকানঘর। টিভিতে চলছে অশ্লীল বাংলা সিনেমা। যে যার মতো ব্যস্ত; মাবুদ আলীর প্রতি কারো কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। বোধ হয় চিনতে পারেনি। অবশ্য না চেনারই কথা; ১৪ বছর তো আর কম সময় নয়! মেঘে-মেঘে অনেক বেলা গড়িয়েছে, খুলে গেছে শরীরের আঁটসাট বাঁধন।
মাবুদ আলী নিজেও কাউকে চিনতে পারে না। পুরাতন স্কুল বিল্ডিঙের সামনে এসে মুহূর্তের জন্য তার পা’দুটো থেমে যায়। এলাকাটি এখনো তার মুখস্ত এইখানে, ঠিক এইখানে পুলিশ তার হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে মারধর করেছিল। আপনাআপনি তার চোখের পাতাদুটো বুজে আসে। টুকরো-টুকরো কিছু দৃশ্য তার মনের মধ্যে ওঠানামা করে। পরপর সফল কিছু অভিযানের ফলে হাটবোয়ালিয়া, গাঙনী, আলমডাঙা, চুয়াডাঙা, মালিহাদ, আমলাসহ অনেক এলাকা বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। কমরেডদের তোপের মুখে জোতদাররা এলাকা ছাড়তে শুরু করেছিল। আর সবার মতো মাবুদ আলীর মধ্যেও বিশ্বজয়ের হাতছানি; দলের শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু বিধিবাম, ভারতীয় সীমান্ত ক্রস করে মাবুদ আলী অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়।
মাবুদ আলীকে সেদিন একনজর দেখার জন্য হাজার-হাজার জনতার ঢল নেমেছিল। গ্রামের বৌ-ঝিরাও ঘোমটার আড়ালে দেওয়ালের ওপার থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল। তার করুণ চাহনি দেখে সবাই ব্যথিত হয়েছিল। দাঁতে দাঁত চেপে বাবা সহ্য করলেও মা পারেনি। পুলিশের পা জড়িয়ে ধরে বিলাপ করেছিল, আমার বুকির মানিককে তুমরা আর মারুনা গো; ও যে মরি যাবেনে!
পুলিশের কাছে ঐ কান্না নিরর্থক; মূল্যহীন। ঘুরে-ফিরে তাদের শুধু এককথা, কোথায় কোথায় অস্ত্র আছে, বল শালা; তা না হলে জানে খতম করবো, কেউ বাঁচাতে পারবে না।
শরীর কেটে লেবুর রস দেওয়া, নাকের মধ্যে গরম পানি ঢালা, নখের মধ্যে সূচ ফোটানোসহ বহুমুখী সব অত্যাচার। মাবুদ আলী তবু মুখ খোলেনি। শ্রমজীবী মানুষের কথা ভেবে নীরবে সব অত্যাচার হজম করেছে। সেদিন ভিড় ঠেলে মোকিম গাজীও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছিল, হয় গো বাপ, কনে-কনে অস্ত্ররপাতি রয়িছে সব কয়ি ফেলো; তালি আমরা না হয় তুমার জন্যি ইট্টু চিষ্টা কত্তি পারি, কি কন দারোগা সাব?
দারোগা বাবু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, উনি ঠিক বলেছেন; তুমি মুখ খোলো মাবুদ আলী, প্রশাসনকে সাহায্য করো; এতে তোমার সাজার মেয়াদ কমলেও কমতে পারে।
মাবুদ আলী তথাপি মুখ খোলেনি। ঘাড় কাঁত করে মোকিম গাজীর চোখে চোখ রেখেছিল মাত্র- যে চোখে ছিল শুধু শিকারীর ইঙ্গিত।
এসব উপহাস সেদিন মাবুদআলীর বাপের সহ্য হয়নি, স্ত্রীর হাত ধরে টান-ে টানতে স্থান ত্যাগ করেছিল; অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেছিল, উর লাগি তুমি কান্দু না; ও শালা মানুষ নাকি, অমানুষ। তা না হলি আমার সাত-পুরুষির মুখি চুনকালি মাকাতি পাত্তু না।
গ্রামের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে মাবুদ আলী ক্লান্ত। শরীর দিয়ে ঘাম ছুটতে শুরু করে। অথচ এত খোজাখুজি করেও নিজেদের ভিটেবাড়ি চিনতে পারে না। বার-বার ভুল হয়। সাহস করে অল্প বয়সী একজন ছেলেকে গলার স্বর নিচু করে কাছে ডাকে, এই যি বাবা শুনচু?
ছেলেটি তার চারপাশে তাকায়; অন্য কাউকে দেখতে না পেয়ে আগন্তকের কাছে জানতে চায়, আমাকে ডাকচেন?
মাবুদ আলী এবার কয়েক পা সম্মুখে এগিয়ে যায়। ডানে-বায়ে আরেক দফা তাকিয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, আইচ্চা, একেনে মাবুদ আলীর বাড়িডা কুনদিকে?
নিজের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে মাবুদ আলী বার-কয়েক ঢোক গেলে। মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা সরতে চায় না। ছেলেটি খানিক ভেবে-চিন্তে বলে, এই গিরামে মাবুদ আলী নামে কেউ থাকে না।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মুরুব্বী গোছের অন্য একজনকে ছেলেটি ডাক দেয়, মাবুদ আলীর বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। লাঠি ভর দিয়ে কাপতে-কাপতে বৃদ্ধটি এগিয়ে আসে। বিরক্ত মুখে মাবুদ আলীকে অবলোকন করে। বৃদ্ধের চোখে-চোখ পড়তেই মাবুদ আলীর বুকের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। লোকটিকে চিনতে তার খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। বয়সের কাছে যৌবণ হার মানলেও বাহার চাচার কণ্ঠটা আগের মতোই-একটুও হেরফের হয়নি। মাবুদ আলী নির্বিকার; চাচার কাছে নিজের পরিচয় ফাস করতে পারে না। তাছাড়া কিই বা বলার আছে!
ঝাপসা চোখে বাহার মণ্ডল জিজ্ঞেস করে, আপনি কিডা গো; কনে আসিছূ?
অনেকদিনবাদে মাবুদের নাম শুনে বাহার মণ্ডল কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। খুবই বিস্মিত হয়। একদলা থুতু ফেলে মাথা কাপিয়ে আহত স্বরে আক্ষেপ করে, আর মাবুদ আলী; তার কি কুনু খবর আচে! বাচি আচে নাকি মরি গিচে তাই বা কিডা জানে!
জীবনের এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা! বেঁচে থেকেও সে আজ মৃত। চেনাজানা মানুষের মন থেকে কমরেড মাবুদ আলী হারিয়ে গেছে।
চাচার মুখে বাবা-মা’র মৃত্যুর কথা শুনে মাবুদ আলী চোখের জল সংবরণ করতে পারে না। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো অসাড় হতে শুরু করে। এতদিনে বুঝতে পারে, কেন তারা দেখা করেনি; কেন খোঁজ-খবর নেয়নি!
অনেকদিন আগের সেই মৃত্যুদৃশ্য বৃদ্ধ যেন অবিকল দেখতে পায়। থরে-থরে সাজানো ছবির মতো পাতা উল্টায়, বুজলিগো ভাই, তকুন জাড়কাল। মানষির হৈ-চৈ শুনি নিশিরাতি ঘুম ভাঙি গেল। দেকি, সারা আকাশে আগুনির হলকা। ঘরডা হা-হা করি জ্বলছে। আহাঃ, অনেক চিষ্টা করিউ বুড়– বুড়িক বাইর করা গেলো না। আগুনির মদ্দি পুড়ি মলু।
মাবুদ আলীর শরীরের লোমগুলো শিউরে ওঠে। হাত-পাগুলো থর-থর করে কাপতে থাকে। মনে হয়, এই বুঝি মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যাবে! কিছুক্ষণ থেমে বৃদ্ধ পুনরায় বলতে শুরু করে, সপ ষড়যন্ত্রর, কুন শালা বোদহয় আগুন ধরি দিচুলু। আইচ্ছা, উরা কি মানুষ; না পশু! মানুষ হলি কি এরাম কাজ কত্তি পাত্তু!
মাবুদ আলীর মুখে টু-শব্দ নেই। ভাসা-ভাসা চোখে হতাশার অথৈই সাগরে উজান বেয়ে চলে। অনুশোচনার চাবুক আষ্টেপিষ্টে শপাং-শপাং করে আঘাত হানে। তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে রক্তের কনায়-কনায়।
বাহার চাচা পুনরায় জিজ্ঞেস করে, তা উরা তুমার কি হয় গো, কুটুম নাকি?
মাবুদ আলী নিজের পরিচয় দিতে পারে না। এই সমাজে নিজেকে তার শিকড়বিহীন বৃক্ষ বলে মনে হয়; যার কোন কূল নেই, কিনারা নেই। তবু মনে হয় পোড়া-ভিটার উপর গড়াগড়ি দিলে বুকের কষ্ট বোধহয় প্রশমিত হতো, বাবা-মা’র কোমল স্পর্শ পাওয়া যেত।
একটা পাকা দালান দেখিয়ে বৃদ্ধ বলে, উই যে, বিরাট একখান বাড়ি দেকা যাচ্ছে, ওকেনেই তাগেরে ভিটি ছিলু।
ভুবনডাঙার ঝোপেঝাড়ে যেভাবে জ্বোনাকি জ্বলতো, ঐ বাড়িটাতেও সেভাবে বিজলী বাতি জ্বলছে-নিভছে । গ্রামের অন্যসব বাড়ির তুলনায় এই বাড়িটি সম্পূর্ণ আলাদা। কোন সৌখিন জমিদার হয়তো সাধের জলসাঘর সাজিয়েছে। মাবুদ আলী জিজ্ঞেস করে, ্ ঐ বাড়িটা তাহলে কার?
মালিকানা বিষয়ক কৌতুহল বোধ হয় বাহার মণ্ডলের চোখ এড়ায় না; এক নিঃশ্বাসে উত্তর দেয়, ক্যান, আমাগো মোকিম গাজীর! মাবুদ আলীর কাচ তি নাকি কিনি নিচে; পাকা দলিলও রয়িচে!
কথাটা তার হৃদয়ের অতলান্তে বার-বার প্রতিধ্বনিত হয়।
অনেক রাত পর্যন্ত গ্রামের শেষ মাথায় যে গোরস্থান আছে তার পাশঘেঁষে মাবুদ আলী দাঁড়িয়ে থকে। মা-বাবা’র স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। কবরের পানে তাকালে বুকের মধ্যে হাহাকার ওঠে। মনে হয়, পিছন থেকে মা তাকে নাম ধরে এক্ষুনি ডাক দেবে। বহুদিন পর ফিরে আসার আনন্দে দু-হাত বাড়িয়ে দেবে কিংবা জীবনের ভুলগুলো শুধরে দিয়ে নতুন পথের ইঙ্গিত দেবে।
মগ্নতার সিঁড়ি ভেঙে আরো বেশি মগ্নতায় হারিয়ে গেলে এ জাতীয় ভাবনা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে। রাতজাগা পাখিদের পাখা ঝাপটানিতে এক-একবার বাস্তবের টৌকাঠে ফিরে এলে না সূচক কাধ ঝাকায় তখন। নিজের ভিতরে প্রচণ্ড দ্বিধা; পরাজয়ের গ্লানি। মুখে কথা না থাকলেও চোখের পাতায় জলের ধারা। কিন্তু ঐ জলও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। কয়েক মূহুর্ত চিন্তা করে মাবুদ আলী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাজায় জড়ানো গামছাটি খুলে ফেলে খানিকটা হালকা বোধ হয়। সমিকরণও সহজবোধ্য- যা ছিল হারিয়ে গেছে, নতুন করে আর কিছু হারানোর নেই।
কমরেড মাবুদ আর অপেক্ষা করে না, বুকভরে শ্বাস নিয়ে জলশূন্য চোখে লোকালয় অভিমুখে যাত্রা করে। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই তাকে গন্তব্যে পৌছাতে হবে।
বাতাসের বুকে কেবলি পা চালানোর আওয়াজ, ধপাধপ, ধপাধপ, ধপাধপ........