সাম্প্রতিক সময়ে আপিলের রায়ে কাদের মোল্লার সাজা বৃদ্ধি করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া এবং সেই মৃত্যুদণ্ড ১২ ই ডিসেম্বর ২০১৩ এ কার্যকর করা নিয়ে সমালচনার এক নতুন ঢেউ তৈরি হয়েছে। সমালোচনার আগে, সমালোচকরা কী এই মামলার রায় গুলো গভীর ভাবে পড়েছেন; বিশেষ করে ৭৯০ পৃষ্ঠার আপীলের রায়? রায়গুলোর উপরে আমার সতর্ক পর্যালোচনা বরং সমালোচনার অন্তঃসারশূন্যতার পক্ষে প্রামানিক তথ্য খুঁজে পেয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিঃসন্দেহে একটি দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু সবাইকে একটা জিনিস উপলদ্ধি করতে হবে, কৌর্ট কোন মার্সি মিশন নয়। তাঁদের কাজ আইনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে উত্থাপিত প্রামানিক তথ্যের আলোকে একটি প্রস্তাবিত অবস্থার পর্যালোচনা করে সর্বোচ্চ ন্যায়পরায়তার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। মোল্লার মামলা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের বিচার ব্যবস্থার সকল জুডিসিয়াল রেমিডি এবং অপশন ব্যবহার করেছে, যার মধ্যে আছে রিভিউ, যা কোন অধিকার নয় বরং আপিলেট ডিভিশনের ইচ্ছাধীন দেয়া একটি সুযোগ। এই সুযোগ ১৯৭৩ সালের আইন যেই আইনের অধীনে এই মামলাটি পরিচালিত হয়েছে এবং আপীল বাস্তবায়িত হয়েছে।
আপীলের রায়ে দেখা যায় ৬ নম্বর অভিযোগের ভিত্তিতে যে রায় দেয়া হয়েছে তা বিচারকদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত; শুধু যেই রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে সেটা বেশীরভাগ বিচারকের মতামত ৪:১। যে প্রামানিক তথ্যের এবং আদালতের যুক্তি প্রমাণে (পৃষ্ঠা ২৪২-২৫৩, ২৭৬, ৪৬৫, ৫০৬-৫০৯, এবং ৭৩৬- ৭৩৮) সাজা হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে অভিযুক্তকে নিষ্পাপ দাবী করাটা এক ধরণের আহাম্মকি। এই অবস্থায় যে কোন আসামী পক্ষের জন্য সবচেয়ে কৌশলী পদক্ষেপ হতো রিভিউ আবেদনে আসামীকে নিষ্পাপ দাবী না করে, ফাঁসির আদেশ কে পরিমার্জনা করে যে কোন মাত্রায় কারাদণ্ডের আবেদন করলে- এমনকি সেই পূর্বতন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখার আবেদনও করা যেত। দুঃখজনক ভাবে রিভিউয়ে সেটা করা হয়নি।
মৃত্যুদণ্ড কারো কারো জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছে। ১৯৬১ সালের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ ধারা অনুসারে কূটনীতিবিদদের স্থানীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও, এবং যে দেশে কূটনৈতিক মিশনে তাঁরা কাজ করছেন সেই সার্বভৌম দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর কথা বলা থাকলেও; ঢাকায় কর্মরত কিছু কূটনীতিক বাংলাদেশের আইনি পদ্ধতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছেন। মৃত্যুদণ্ড মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসুখকর হলেও এখনো পর্যন্ত এটা বেআইনি ঘোষণা করা হয়নি। অনেক আইনি ব্যবস্থায় এটার প্রয়োগ আছে। শুধু ২০১২ সালেই অ্যামেরিকা সহ ২১ টা দেশে ৬৮২ টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ৪৩ টা হয়েছে অ্যামেরিকায় যেখানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক মাথাপিছু কারাদণ্ডের হার। ৭৯ টি হয়েছে সৌদি আরবে; আল জাজিরার ১০ ই অক্টোবর ২০১৩ র তথ্য অনুসারে ২০১৩ সালে ৩০,০০০ বন্দী পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় আছে।
বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান রক্ষার প্রশ্নটাও সমালোচকরা কখনো কখনো তুলেছেন। অতীত এবং বর্তমানের অনেক এড হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের কোন কন্সিস্টেন্ট সাধারণ প্রমিত রূপ তৈরি হয়নি। এটা এই কারনেই হয়নি যে, এই বিচারগুলো ভিন্ন, অনন্য এবং কেস স্পেসিফিক। এই আদালতগুলো অপরাধ পরবর্তী বিচার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিক্ষিপ্ত ভাবে এককালীন ভিত্তিতে একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক অপরাধ সংগঠনের কারণে তৈরি হয়েছে। সে কারণে স্টাটিউটস অব ম্যান্ডেট এবং ক্ষমতা একটি বিশেষ ঘটনার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়, তাই একটি ট্রাইবুনালের বিষয় আরেকটি ট্রাইবুন্যালে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে কোন যুক্তি নাই। নুর্যেইমবার্গ ট্রায়ালে আপীলের কোন সুযোগ ছিল না। একেক দেশের প্রেক্ষিত ভিন্ন রকম হওয়ার কারণে এই বৈচিত্র্যই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের একটি সাধারণ আন্তর্জাতিক প্রমিত রূপ তৈরি করতে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এর ফলেই একটি স্থায়ী আই সি সি তৈরি হয়েছে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রিসিডেন্সিয়াল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করবে।
মনুষ্য প্রণীত আইন হওয়ার কারণে, আন্তর্জাতিক অপরাধ সংক্রান্ত আইনের ব্যাখ্যা অপরাধের প্রকৃতি অনুসারে, বিচারকদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হতে পারে। একারনেই আমরা মানবতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের ICC (Art 7) এবং ICTY (Art 5) এ বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা দেখি। গণহত্যার সংজ্ঞায়ন ICTY, ICTR, সিয়েরা লিওনের বিশেষ আদালত, কসোভো কৌর্ট, পূর্ব তিমুর প্যানেল এবং কম্বোডিয়ান চেম্বারে ভিন্ন ভিন্ন। তাই যে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের একটি একটি অভিন্ন আন্তর্জাতিক মান আছে যা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল অনুসরণ করতে পারেনি, তা সর্বাংশে ভ্রান্ত।
সমসাময়িক যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিচারের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, একটি বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে বিচারের পদ্ধতিগত দিকগুলোকে ঠিক ঠাক করে নিতে হয় এবং এভাবেই এটা বিবর্তিত হতে থাকে। ১৯৯৩-৯৪ সালে শুরু হওয়া ICTY এবং ICTR এখনও নানাভাবে তার বিচারিক প্রক্রিয়াকে উন্নত ও পরিবর্ধিত করছে। বিচারিক ক্ষমতা সম্পর্কিত ICTY রুল ৭৩ Dusco Tadic ১৯৯৮ এ বিচারের পর রুল ৭৩ bis (B) (C) হিসেবে সংশোধিত হয়েছে, এরপরেও এই আইনের পরিধি আরো বিস্তৃত করার জন্য ২০০৩ এর জুলাইয়ে রুল ৭৩bis (D) যুক্ত করা হয়েছে, এবং মে ২০০৬ এ কারাগারে স্লবোদান মিলাসভিচের মৃত্যুর পরে আবারো এই আইনের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। ICTY তে বিচারিক ক্ষমতা বৃদ্ধির উদাহরণ আর কোন এড হক আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার প্রক্রিয়ায় দেখা যায়নি।
কম্বোডিয়ান চেম্বারের প্রসিডিংসে ভিক্টিমদের অংশগ্রহণের জন্য কোন এক্সপ্রেস প্রভিসন ছিল না কিন্তু ২০০৭ এর আভ্যন্তরীণ বিধি অনুসারে এই অংশগ্রহণ কে বৈধতা দিয়েছে। আইনে এমন কিছু বলা নাই যা প্রয়োজন অনুসারে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালকে বিচার চলাকালীন সময়ে তার নিজের পদ্ধতিগত স্ট্যান্ডার্ড আরো উন্নত করতে বাঁধা দেয়।
ন্যূনতম পদ্ধতিগত স্ট্যান্ডার্ড ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিমিত্ত মাত্র। কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রশ্নে পদ্ধতিগত স্ট্যান্ডার্ডই শেষ কথা নয়। সমালোচকরা যেমনটি দাবী করছেন; বিচারিক প্রক্রিয়ার বাইরে পদ্ধতিগত স্ট্যান্ডার্ডের তেমন কোন স্ব সংজ্ঞায়ন নেই বা স্ব আরোপিত বিশেষ মূল্য নেই। ন্যায় বিচার শেষ করার লক্ষ্যে একটা নিমিত্ত। পদ্ধতিগত স্ট্যান্ডার্ড সেটাকে মানবাধিকারের আঙ্গিকে যত আবেগের সাথেই গুরুত্ব আরোপ করা হোক না কেন অথবা যত নির্বিকার ভাবেই উচ্চারন করা হোক না কেন একটি নিমিত্ত বা অছিলা হয়ে তা ন্যায় বিচারকে সহজতর করতে পারে কিন্তু কখনোই ন্যায় বিচার শেষ করার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারেনা। যখন সেটা ন্যায় বিচারের পরিপুরক হওয়ার চাইতে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে অথবা যখন তা বিচারিক প্রক্রিয়ার দ্রুত নিস্পত্তির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তখন দ্রুত বিচারের স্বার্থে পদ্ধতিগত স্ট্যান্ডার্ড কে টেইলরড করে নেয়া প্রয়োজন। ঠিক একই কাজ করা হয়েছিলো ICTY এর ৭৩bis এ।
জনগনের কাছে উন্মুক্ত দলিলে দেখা যাচ্ছে আসামী পক্ষের কৌশুলি প্রথম থেকেই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করার জন্য ডায়ালেটরি ট্যাক্টিক গ্রহণ করেছে। আসামী পক্ষের কৌশুলিদের ব্যাখ্যাহীন এবং অযৌক্তিক অনুপস্থিতির জন্য জরিমানা করা হয়েছে। ICT-1 এ গোলাম আজমের মামলায় ২৯৩৯ জন সাফাই সাক্ষীর তালিকা দেয়া হয়েছে (প্যারা ৩৫) এবং ১১৫৩ জনের তালিকা দেয়া হয়েছে সা কা চৌধুরীর মামলায় (প্যারা ৪১)। ICT-2 এ কাম্রুজ্জামানের মামলায় ১০০০ জন সাফাই সাক্ষীর তালিকা দেয়া হয়েছে (প্যারা ৩৫) এবং ৩৩২৮ জনের তালিকা দেয়া হয়েছে আব্দুল আলিমের মামলায় (প্যারা ২৫)। ICT-1 গোলাম আজমের মামলায় আসামী পক্ষের কৌশুলিকে ব্যাখ্যা ছাড়া অনুপস্থিতির জন্য ১০০০ টাকা জরিমানা করেছে। ICT-2 আব্দুল আলিমের মামলায় আসামী পক্ষের কৌশুলিকে অযৌক্তিক অনুপস্থিতির জন্য ৫০০০ টাকা জরিমানা করেছে।(Daily Star, 23 July 2013).
“যথাযথ প্রক্রিয়া” (Due process) সরল বিশ্বাসে শুধু তাঁদের বিরুদ্ধেই প্রত্যাশা করলে হবেনা যারা এর অবমূল্যায়ন করে বরং তাঁদের বিরুদ্ধেও প্রত্যাশা করতে হবে যারা এর অপব্যবহার করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে দ্রুত শুনানি জবরজং মার্কা জটিলতা এবং অনাবশ্যক বিলম্ব প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় উপাদান। ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিচারককে দ্রুত শুনানির পদ্ধতিকে বাংলাদেশের বিচারককে স্ব প্ররোচিত হয়ে প্রবৃত্ত করতে হবে যেখানে বিচার হীনতার সংস্কৃতির কারণে দীর্ঘ দিন পরে শুরু হওয়া মামলার জীবিত সাক্ষী এবং অভিযুক্ত উভয়েই খুবই বৃদ্ধ।
যথাযথ প্রক্রিয়াতে শুধু অভিযুক্তেরই একচেটিয়া অধিকার নেই; ভিক্টিমরাও এর দাবীদার। যথাযথ প্রক্রিয়াতে অভিযুক্তের অধিকার কখনোই ভিক্টিমের ন্যায় বিচারের অধিকার থেকে বেশী গুরুত্ব পেতে পারেনা। বিচারকরা অভিযুক্ত এবং ভিক্টিম উভয়ের জন্যই ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত করবেন। তাঁরা তাঁদের কর্তব্যানুরোধে পদ্ধতিগত স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণের ছলে ন্যায় বিচার প্রাপ্তির পথে বাঁধা সৃষ্টির বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন এবং প্রকৃত ন্যায় বিচারকে নিশ্চিত করবেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধের গুরুত্ব এবং এই ধরণের অপরাধের পুনুরাবৃত্তি রোধ করার অমোঘ দাবী থেকে এটা বলা যায় পদ্ধতিগত ন্যায় বিচার এর ওজন কখনো প্রকৃত ন্যায় বিচারেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনা। বিচারের অভীষ্ট শুধুমাত্র কোন নিরাপরাধী যেন শাস্তি না পায় এটাই নয় আবার এটাও যেন কোন অপরাধী যেন পদ্ধতিগত ন্যায় বিচারের কচকচানির মধ্যে দিয়ে পার পেয়ে না যায়। পরিশেষে বিচারককেই দুই পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বী অধিকারের মধ্যে একটা ন্যায্য ভারসাম্য রক্ষা করা।
আরেকটি বিষয় এসেছে যে, সংসদ বিচারাধীন কোন মামলার আইন সংশোধন করতে পারে কিনা যার রেট্রোপেক্টিভ ইফেক্ট হয়। আইন প্রনয়ন এবং প্রয়োগ সাংবিধানিকভাবে বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, সংসদ কৌর্টে কী চলছে সেটা বিবেচনায় না নিয়েই কোন আইন প্রয়ন বা সংশোধন করতে পারে। আইনের জুরিসডিক্সনে অসংখ্য উদাহরণ আছে যেখানে সংসদ বিচারাধীন বিষয়ে আইন সংশোধন করেছে।
১৩ই সেপ্টেম্বর ২০১৩ এ আদালত ২৩ বছর বয়সী মেডিক্যাল ছাত্রীকে ১৬ ই ডিসেম্বর ২০১২ তে সঙ্গবদ্ধ ধর্ষণ ও পরিশেষে তে মৃত্যুর অভিযোগের ভিত্তিতে চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, অপরাধ সংগঠনের সময় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন। একটি জুডিশিয়াল কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারতীয় পার্লামেন্ট ধর্ষণের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে। এবং সেই শাস্তি প্রযুক্ত হয় ২০১২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বরে সংগঠিত অপরাধের শাস্তি হিসেবে।
আরো সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, কম্বোডিয়ান চেম্বারের নতুন আর্টিকেল ৩৬ যার মাধ্যমে অভিযুক্ত, ভিক্টিম এবং কো প্রসিকিউটর সবার আপীল করার ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে তা ২০০৪ সালের মুল আইনের একটি সংশোধনী, কিন্তু এই সংশোধনী আরোপিত হবে ১৯৭০ এ কৃত অপরাধের ক্ষেত্রে।
সুপ্রিম কৌর্ট ৭ জন প্রথিতযশা আইনজীবীর মতামত জানতে চেয়েছিল (এমিকাস কিউরি) এই বিষয়ে যে সংসদের এই সংশোধনী কাদের মোল্লার এই মামলার আপীলের ক্ষেত্রে রেট্রোস্পেক্টেভলি প্রযুক্ত হবে কিনা? এমিকাস কিউরির দুজন ছাড়া বাকী সবাই রেট্রোস্পেক্টেভলি প্রযুক্ত করার পক্ষে বলেছেন। কারণ, এই ধরণের সব ট্রায়ালগুলো সব সময়েই পোস্ট ফেক্টো যার চার্টার/স্টাটিউটস অপরাধ সংগঠনের পরেই গৃহীত হয়। এই সংক্রান্ত সব আইন এবং সংশোধন সব সময়েই পরবর্তী সময়ে গৃহীত এবং প্রয়োগের বিচারে তা সব সময়েই রেট্রোস্পেক্টিভ। যদি এই তর্ক করা হয় যে সংশোধনীর রেট্রো অ্যাকটিভ প্রয়োগ যথাযথ হয়নি, তবে এটাও বলতে হবে, আপীলের অধিকারেরও অসমতা ছিল, যেই অধিকারের দাবী বিজয়ী পক্ষ অবশ্যই করতে পারে, সেটাও যথাযথ ছিল না ।
প্রত্যেকটি মামলায় একজন অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত থাকে, দুই পক্ষই সমান অধিকার দাবী করে এবং এই সংশোধন সমঅধিকার নিশ্চিত করে ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করেছে যেমন করেছিল কম্বোডিয়া। আপীল কৌর্ট কি ট্রায়াল কৌর্টের দেয়া দন্ড বর্ধিত করতে পারে? অবশ্যই পারে। Duch কেইস 001 এ কম্বোডিয়ান সুপ্রিম কৌর্ট চেম্বার Duch এর দণ্ড ৩৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩ রা ফেব্রুয়ারি ২০১৩ এ যাবজ্জীবন করা হয়েছিলো।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল একটি পুরোদস্তর জাতীয় ট্রাইবুন্যাল। একটি জাতীয় ট্রাইবুন্যালের বিচারিক প্রক্রিয়াকে কখনোই আন্তর্জাতিক এবং মিশ্র ট্রায়ালের অভিজ্ঞতা থেকে মূল্যায়ন করতে যাওয়াটা সঠিক নয়। ট্রাইবুন্যালের সকল বিচারক সুপ্রিম কৌর্টের প্রাজ্ঞ, সিনিয়র এবং পেশাদার বর্তমান বিচারক (একজন ছাড়া)।
লিখিত রায়সমুহে অন্যান্য ট্রাইবুন্যালের অতীত জুডিশিয়াল প্রিসিডেন্স থেকে প্রাসঙ্গিক অসংখ্য উধৃতি দেয়া হয়েছে এবং সুনিশ্চিত ভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের বিষয়ে উল্লেখ করেছে এবং এই ধরণের মামলায় যথাযথ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত যে আবশ্যিক শর্ত গুলো মানতে হয়, এই ধরনের বিচারের ক্ষেত্রে প্রচলিত গাইডলাইন International Covenant on Civil and Political Rights 1966 তা মানা হয়েছে।
সকল রায়েই প্রতীয়মান হয়েছে, ট্রাইবুন্যালের সামনে অভিযুক্ত, দণ্ডিতের পক্ষ থেকে যে পরিমানে পাল্টা তথ্য প্রমাণ হাজির করা হয়েছে তা বিশাল। এই প্রামাণিক সুবিধার কারনেই প্রসিকিউসনের পক্ষে কেইস টি প্রমাণ করা সহজ হয়েছে আর আসামী পক্ষের কেইস টি অপ্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। আসামী পক্ষের রেসপন্স অভিনব, নতুন বা গ্রাউন্ড ব্রেকিং হতে পারেনি। অরক্ষণীয় বিষয়কে রক্ষার মতো একই ধরণের যুক্তি আসামী পক্ষ পরপর সব কয়টি মামলাতেই তুলে ধরছে যখন আই সি টির ব্যাখ্যা সহ আগেই এই ধরণের যুক্তিগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশের জঙ্গি মতবাদ উপজাত অপরাধের এই অভিজ্ঞতার নজির স্বরূপ মূল্য লুকিয়ে আছে এর সামাজিক এবং আইনি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। অনুভূতিহীন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফলে জন্ম নেয়া ১৯৭১ এর বীভৎস অপরাধের অসাম্প্রদায়িকিকরনের বর্তমান সময়ে একটি বিশাল ভুমিকা আছে বিশেষ করে সহিংস সন্ত্রাসবাদ আর র্যা ডিক্যাল আইডিয়ালিজমের যুগে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে ১৯৭১ এ অভিযুক্ত এবং দণ্ডিতদের ১৯৭১ এ ও বর্তমানে তাঁদের অনুসারীদের সহিংস ভুমিকা বাংলাদেশের একটি উদ্বেগের বিষয়। জামাত এবং তাদের অনুসারীরা তাদের দণ্ডিত নেতাদের বিচারের আওতার বাইরে আনার জন্য মরিয়া এবং সহিংস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা আইনত অসম্ভব।
এতদসত্ত্বেও এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার মানবতার উদ্দেশ্যে এক অগ্রযাত্রা যেন এই ধরণের অপরাধকে মোকাবেলা করা যায় এবং এই ধরণের অপরাধের হোতাদের শাস্তি নিশ্চিত করে মর্যাদার সঙ্গে মানবসত্তার অস্তিত্ব নিশ্চিত করে। এই বিচারের অসম্পূর্ণতা কে প্রবর্ধিত করে দেখানটা এবং সেটার ভিত্তিতে এই বিচারকার্যকে মূল্যায়ন করাটা অন্যায্য। সমালোচকরা যেন বিচারহিনতার সংস্কৃতিকে ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে অনেক অপরাধীর বিরুদ্ধে ভিক্টিমদের প্রাপ্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করেছে যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতদিন করতে ব্যর্থ হয়েছে আই সি টি র সেই অর্জনের দিকে চোখ বন্ধ করে না রাখেন।
সমালোচকরা যদি এড হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে না জানেন তবে তাদের সমালোচনা গুলো হবে, বাগাড়ম্বরপুর্ন, অবাস্তব এবং ভাসাভাসা।
[১৭ ই ডিসেম্বরে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রফেসর এম রফিকুল ইসলামের Reviewing The Views The execution of Quader Mollah A legal response to critics এর অনুবাদ।]মুল লেখার লিঙ্ক