সিঙ্গাপুর শব্দটি আমাদের কাছে এক ধরণের আর্কেডিয়া। সেই স্বপ্নের রুপকথার দেশ যেখানে ফাগুন কভু হয়না বুঝি শেষ। আমরা কমবেশি সবাই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের আলোচনায় কথায় কথায় সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির উদাহরণ দেই, আর সেই তুলনায় আমরা কত অপদার্থ তা নিয়ে হা পিত্যেশ করতে থাকি। কিন্তু সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির উদাহরণ দিতে গিয়ে যে ভু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সমৃদ্ধি ঘটেছে তা জানতে এবং তার ভিত্তিতে আলোচনা করতে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হই। আমাদের দুর্বল এবং ঝাপসা জানা বোঝা দিয়ে এই জটিল অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। যা সব সময় একটা অর্থহীন আলোচনায় পর্যবসিত হয়। এই জটিল প্রেক্ষাপটকে কিঞ্চিৎ বোধগম্য করে তুলে ধরার জন্যই এই লেখাটির অবতারণা।
খ্রিষ্টীয় প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শতাব্দীতে দক্ষিন-ভারতের পলহবী বংশ ইন্দোচীনের অদুরে সুমাত্রায় উপনিবেশ স্থাপন করে। সুমাত্রা পর্বতের শ্রীবিজয়া নগরী ছিল তাদের রাজধানী। শ্রীবিজয়া দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জন করতে থাকলো এবং ক্রমে বোরনিও, ফিলিপাইন, সেলিবিস, জাভা আর ফরমসা দ্বীপের অর্ধাংশ, সিলন এবং এমনকি ক্যান্টনের কাছে দক্ষিন চীনের একটা বন্দরও এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হল। ধারণা করা হয় ভারতের দক্ষিণ সীমার একটা বন্দরও তার দখলে ছিল। শ্রীবিজয়া একটি প্রবল আঞ্চলিক সামুদ্রিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠলো, যেখানেই তারা বাণিজ্যের সুযোগ পেয়েছে অথবা সমরনিতীর কারণে বিশেষত্ব খুজে পেয়েছে সেখানেই তার বন্দর গড়েছে। এই শ্রী বিজয়ার অধিবাসিরাই প্রথম সিঙ্গাপুরে বসতি স্থাপন করে। এই অঞ্চলের ম্যাপ টা ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যাকে বলা হয় আরকিপিলাগো তেমন ছোট ছোট অসংখ্য দ্বীপ সিঙ্গাপুরের আশে পাশে ছড়িয়ে আছে। সিঙ্গাপুরবাসির প্রথম জীবিকা ছিল দুটো কাছাকাছি দ্বীপের মাঝখানে মোটা লোহার শেকল টেনে ধরে জাহাজ আটকে মোটা রকম কর আদায় করা। শ্রীবিজয়ার সাম্রাজ্য ১৩৭৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ভাবে উন্নতি করতে থাকে, সিঙ্গাপুরও ক্রমে ঐশ্বর্যে পূর্ণ হতে থাকে। সিঙ্গাপুর শ্রীবিজয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
সমুদ্র বন্দর হয়ে ওঠার জন্য কিছু ভৌগলিক সুবিধা থাকতে হয়, যেমন, সমুদ্র তার পাড় পর্যন্ত গভীর হতে হয় যেন বিপুলায়তন জাহাজ নিরাপদে ভিড়তে পারে, থাকতে হয় সুপেয় পানির সরবরাহ, আর কাঠের জাহাজের সময়ে দরকার জাহাজ মেরামতের জন্য উন্নতমানের কাঠের সরবরাহ। এই তিনটি সুবিধা একসাথে সবসময় সিঙ্গাপুরের ছিল। সমুদ্রের গভীরতা বিষয়টা আরও ভালো ভাবে বোঝা যায় যখন দেখি যেখানে সমুদ্র সৈকত থাকে সেখানে বন্দর থাকেনা। সৈকতে অগভীর পানি থাকে তাই সেখানে জাহাজ ভিড়তে পারেনা। সেকারনেই আমরা সমুদ্র বাণিজ্যের জন্য গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা বলি। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ সরাসরি ভিড়তে পারেনা। চট্টগ্রাম বন্দরে ছোট ছোট জাহাজে করে মালামাল গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করে থাকা জাহাজ থেকে তীরে আনতে হয়।
শ্রী বিজয়রা সমৃদ্ধির সময় পূর্ব জাভায় গড়ে ওঠে আরেকটি সমুদ্র বাণিজ্য নির্ভর রাজত্ব। তাদের সাথে প্রথমে শ্রী বিজয়ার প্রতিযোগিতা পরে রেষারেষি এবং শেষে ভীষণ শত্রুতা শুরু হল। পূর্ব জাভার মুল ঈর্ষা ছিল সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধি। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে পূর্ব জাভা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে ১৩৭৭ সালে এক ভীষণ যুদ্ধে শ্রী বিজয়া পূর্ব জাভার কাছে পরাজিত এবং বিধস্ত হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয় সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর অঙ্গিভুত হয় আরেক পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের তার নাম মাজপাহিত সাম্রাজ্য। এর কিছু পরে সিঙ্গাপুর মালাক্কা সুলতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সিঙ্গাপুর আবারো অন্যতম প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে আবার গড়ে ওঠে।
১৫০৯ সালে মালাক্কা প্রণালীতে উপনিবেশ গড়তে আসে পর্তুগীজরা। মালাক্কা সুলতানাত ১৫১১ সালে পর্তুগীজরা দখল করে নিলে মালয় অ্যাডমিরাল সিঙ্গাপুরে পালিয়ে আসেন এবং জহর লামাতে নতুন রাজধানী গড়ে তোলেন। সিঙ্গাপুর সমুদ্র বন্দর হিসেবে তার অবস্থান অব্যাহত রাখে। তবে পর্তুগীজরা ১৫৮৭ সালে আবারো সিঙ্গাপুরকে বিদ্ধস্ত করে দেয়। এর পর প্রায় দুইশ বছর সিঙ্গাপুরের কোন উন্নতি ঘটেনি।
১৭ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে আগমন ঘটে ডাচদের। এবং দ্রুতই মালয় উপদ্বীপগুলোর কর্তৃত্ব ডাচদের হাতে চলে আসে। তাঁরা ব্যবহার করতো পেনাং বন্দরকে ইউরোপিয়ানরা এই অঞ্চলে এসেছিলো মশলা, চীনা সিল্ক আর চীনে আফিমের ব্যবসার জন্য। এই ব্যবসায় মুল কর্তৃত্ব ছিল ব্রিটিশদের কিন্তু এই অঞ্চল দিয়ে পেনাং এর মধ্যে দিয়ে পণ্য পরিবহন করতে হলে ডাচদের বিপুল কর দিতে হতো, তাতে পণ্য মূল্য বেড়ে যেত বহুগুন। ব্রিটিশরা সেকারণে এই অঞ্চলে তাদের একটা নিজস্ব বন্দর প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করছিলো।
১৮১৯ সালে বেঙ্কলেনের গভর্নর র্যা ফেলস অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত বন্দর সিঙ্গাপুরকে খুজে পায়। সিঙ্গাপুরের বড় বন্দর হয়ে ওঠার মতো সব ভৌগলিক এবং অবকাঠামোগত সব সুবিধা ছিল। উপরি হিসেবে ছিল বসবাসরত জনগোষ্ঠীর বন্দর চালনার ঐতিহাসিক চিরায়ত দক্ষতা।
ব্রিটিশরা দ্রুততার সাথে সিঙ্গাপুরকে গড়ে তোলে ফ্রি পোর্ট বা শুল্কমুক্ত বন্দর হিসেবে, যার মানে এই বন্দরে ভিড়লে বহন কৃত পণ্যের জন্য বন্দরকে কোন শুল্ক দিতে হবেনা। ডাচদের বিপুল করের বন্দরের পাশাপাশি আরেকটি সম সুবিধার এই ফ্রি পোর্ট সবাই লুফে নিল। ছয় বছরের মধ্যেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দর পেনাংকে ব্যস্ততা আর আয়ের দিক থেকে ছাড়িয়ে গেলো সিঙ্গাপুর। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সিঙ্গাপুরকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সিঙ্গাপুর অক্ষত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশরা ইংল্যান্ডের বাইরে প্রথম বড় নৌ ঘাঁটি তৈরির কাজে হাত দেয় এই সিঙ্গাপুরে। সেই সময়ের ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে নৌ ঘাঁটি নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৯৩৯ সালে। এই বিশাল বিনিয়োগ কী বিপুল অর্থনৈতিক সামর্থ্য আর প্রণোদনা তৈরি করতে পারে তা বলাই বাহুল্য।
এই বহুমুখী অর্থনৈতিক তৎপরতায় সিঙ্গাপুরের টাকার বাজার বা ফাইনান্সিয়াল হাব হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ফাইনান্সিয়াল ক্যাপিটাল ছিল ইংল্যান্ড। বিশ্বযুদ্ধের পরে সেই রাজধানী দখলে চলে যায় আমেরিকার। এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইনান্সিয়াল ক্যাপিটাল গড়ে ওঠে তার মধ্যে অন্যতম সিঙ্গাপুর। যে পূর্বশর্ত গুলো একটি ফাইনান্সিয়াল ক্যাপিটাল তৈরির জন্য দরকার তা হচ্ছে, ব্যাপক এবং বিচিত্র রকমের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ঋণ বা পাওনা শোধের জন্য সব ধরণের টাকা, হুন্ডি, সোনা, সরকারী বা আধা সরকারী সংরক্ষিত ঋণপত্র সেখানে পাওয়া যায়। বন্দর নির্মাণের বপুল বিনিয়োগ, বিচিত্র এবং বহুমুখী সমুদ্র বাণিজ্যের ফলে এই সব শর্ত আর সক্ষমতা গড়ে ওঠে সিঙ্গাপুরের।
অনেকেই সিঙ্গাপুরের এই বিস্ময়কর উন্নয়নের জন্য তার প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ানের দূরদর্শিতা আর বিচক্ষণ নেতৃত্তের কথা বলেন কিন্তু এই উন্নয়নের জন্য এক চিরায়ত ভু রাজনৈতিক সুবিধা সব সময় সিঙ্গাপুর পেয়ে এসেছে। এই উন্নয়ন ছিল ঐতিহাসিকভাবে অবশ্যম্ভাবী। কোন একক ব্যাক্তির কারণে এটা ঘটেনি। লি কুয়ানের রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে তেমন চমৎকৃত হবার মতো কিছু চোখে পড়েনা। আর আজকে সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ হয়ে আছে বহুজাতিকদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এই বিনিয়োগের সুরক্ষার জন্য এক ধরণের সুশাসন দরকার যা সিঙ্গাপুর তার বিদেশী বন্ধুদের সাহায্যে করে চলেছে। বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ হলেও পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ২৫০ জনের তালিকায় কোন সিঙ্গাপুরের নাগরিকের নাম নেই, কারণ এই সমৃদ্ধির ফল নিয়ে যায় অন্যরা।
বাংলাদেশের সিঙ্গাপুরের মতো অর্থনৈতিক শক্তি হবার মতো কোন ভু রাজনৈতিক সক্ষমতা নেই, কোনদিন ছিলও না। যারা কথায় কথায় বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর মডেলের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখান তারা দুঃখজনকভাবে উন্নয়ন, ইতিহাস বা অর্থনীতি কোনটাই বুঝতে পারেননি।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:১৭