# তোতা পাখি #
আমি একটি তোতা পাখি কিনেছিলাম তিন-চার বছর আগে। সাধারণ কোনো তোতা পাখি নয়, একেবারে শান্তি নিকেতনি ঢংয়ে বাংলায় কথা বলা তোতা পাখি। দেখতেও বেশ সুন্দর। একদিন কি কারণে যেন কাটাবন পাখির দোকানে ঢুকেছিলাম। আমাকে ঢুকতে দেখেই পাখিটি এত সুন্দর করে স্বাগতম...স্বাগতম বলছিল যে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পাখি পালা, পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা একদম পছন্দ নয় আমার। তারপরও অনেক দাম দিয়ে কিনে এনেছিলাম তার সুন্দর করে কথা বলার ভঙ্গি দেখে। তবে কথায় মুগ্ধ হলেও পাখিটি কিনে চরম একটা শিক্ষা পেয়েছি আমি। মানুষের মিষ্টি কথা শুনে যেমন বোঝা যায় না মানুষটি খারাপ নাকি ভালো। পাখির বেলায়ও দেখলাম সেই রকম অবস্থা। পাখিটি খুব সুন্দর করে কথা বলতে জানলেও আগে বুঝতে পারিনি এটা যে একটা বিরাট বদ পাখি। একে রাজাকার সমর্থক তোতা পাখিও বলা যেতে পারে। সম্ভবত এই পাখির আগের মালিক ছিল রাজাকার কিংবা বিএনপি-জামায়াতের কোনো নেতা। আমি উগ্র জাতীয়তাবাদী তোতা পাখির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম কিছু দিনের মধ্যেই!
তিন বছর আগেও ঢাকাতে ছিল প্রচণ্ড লোডশেডিং। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে দুই ঘণ্টা থাকত না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিন দিন উন্নতি হচ্ছিল বটে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, যখনই আমার বাসায় বিদ্যুৎ চলে যেত, ঠিক তখনই তোতা পাখিটি আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ.....ডিজিটাল বাংলাদেশ’। স্বাভাবিকভাবে বললে কিছু মনে করতাম না। কিন্তু পাখিটি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচিয়ে যেভাবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলত, তা দেখে যে কারো গা জ্বলে যেত। মেজাজও মারাত্মক খারাপ হয়ে যেত। ইচ্ছে হতো পাখিটির গলা টিপে ধরি কিন্তু যেহেতু অনেক টাকা দিয়ে কিনেছি, তাই কিছু বলতাম না। মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতাম।
ডিজিটাল অত্যাচার চলল দীর্ঘদিন। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ....ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করতে করতে আমার কান ঝাঝড়া করে দিল পাখিটি। প্রতিদিন আমাকে দেখলেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলে খেপাত। বেয়াদপ তোতা পাখিকে এক আছাড় দিয়ে মেরে ফেলতে পারতাম। তবু সবকিছু সহ্য করে গেলাম। আশায় থাকলাম হয়তোবা কোনো একদিন পাখিটি উত্যক্ত করা বন্ধ করবে। তার ভুল বুঝতে পারবে। কাউকে উত্যক্ত করা যে চরম অভদ্রতা সেটা বুঝতে পারবে।
দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হওয়ার পর হঠাৎ একদিন আশার আলো দেখতে পেলাম। লোডশেডিংও কমল, পাখিটিও কেমন যেন লাজুক হয়ে গেল। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তার লজ্জা এতো বেড়ে গেল কেন বোধগম্য হলো না! আমাকে দেখলেই যে পাখি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলে গলা ফাটাত, সে পাখিই হঠাৎ মাথা নিচু করে বসে থাকল, কোনো কথা বলত না। গ্রামের নতুন বউ লজ্জায় যেমন ঘোমটা দিয়ে বসে থাকে, পাখিটিও পারলে সেই রকম ঘোমটা দিয়ে বসে থাকে। আমি খুব অবাক হলাম, আবার আনন্দিতও হলাম। লক্ষ্য করলাম, পাখিটি আর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলে আমাকে খেপাচ্ছে না।
ভেবেছিলাম অত্যাচারী পাখির হাত থেকে বেঁচে গেছি, পাখিটি হয়তো মানুষ হয়ে গেছে। কিন্তু রাজাকার যে সারাজীবন রাজাকারই থাকে সেটা আমার জানা ছিল না। পাখিটি আবারো আমাকে নির্যাতন করা শুরু করল। এবং এই নির্যাতনের মাত্রা আগের চেয়েও অনেক ভয়াবহ হলো। পাখিটি আগে শুধু বলত ডিজিটাল বাংলাদেশ। এবার আর ডিজিটাল বাংলাদেশ বলল না। তবে নতুন করে বলা শুরু করল ‘হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজার’। দিন দিন অবস্থা আগের চেয়েও করুণ হয়ে গেল। আবার সারাদিন কানের কাছে শুনতে লাগলাম, ‘হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজার’। তোতাটি যখন ঘুম থেকে উঠত, তখন বলত হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজার। তাকে যখন খাবার দিতাম, তখন বলত হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজার। যখন হাগু করত, তখনও বলত হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজার। সারাদিন একই কথা, আর কোনো কথা নেই। মেজাজ আরো খারাপ হতো, কারণ পাখিটি আমাকে দেখলেই তিড়িংবিড়িং করে ব্রেক ড্যান্সের মত একটা পাখি-নৃত্য দিত, আর বলত হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ারবাজার।
তার বিরামহীন ও নির্মম এই অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আর না, যথেষ্ট হয়েছে। এইবার এই রাজাকার-আলবদর তোতা পাখিকে আমি পাকিস্তানে পাঠিয়ে ছাড়বই।
অনেক টাকা দিয়ে কিনেছি, তবু পাখিটিকে আমি ছেড়ে দিলাম। ছেড়ে দেওয়ার সময় বললাম, ‘যা, তোর বাপের দেশ পাকিস্তানে চলে যা। ওইখানে সুখে থাকবি। আমার স্বাধীন বাংলাদেশে আমাকে বিরক্ত করিস না।’ পাখিটি আমার কথা শুনে উড়ে চলে গেল বটে কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আবার চলে আসল বাসায়। ঠিক তার খাঁচার ভেতর। আমি মনে মনে খুশিই হলাম। ভাবলাম আমার প্রতি তার ভালোবাসার টানেই হয়তো আবার ফিরে এসেছে। তার ভুল বুঝতে পেরেছে। আমাকে হয়তো আর অত্যাচার-নির্যাতন করবে না।
দুঃখজনক ব্যাপার যে, পাখিটির অত্যাচার কমল না। বরং বেড়ে গেল। ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের পর নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করল। এবার 'হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজারের' সঙ্গে যোগ হলো ‘আড়াই হাজার’। সারাদিনই ‘হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজার-আড়াই হাজার’ স্লোগান দেওয়া শুরু করল তোতা পাখিটি। পাখির এই রকম ফ্যাসিস্ট ও অনৈতিক আচরণে আমি খুব কষ্ট পেলাম। সারাদিন তাকে আমি খাওয়াই, যত্ন করি, গোসল করিয়ে দেই। তারপরও সে এরকম আচরণ কেন করছে বুঝতে পারলাম না। অবশেষে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘আরে ভোদাই, আড়াই হাজার লোক মারা যায়নি। তুই শুধুই আড়াই হাজার-আড়াই হাজার করছিস কেন? বল তুই কি দেখেছিস আড়াই হাজার লোক মারা যেতে? বল? পৃথিবীর কেউ কি দেখেছে? ঢাকা শহর ভেঙেচুরে তছনছ করে দিল হেফাজত আর তোরা গলা ফাটাচ্ছিস আড়াই হাজার...আড়াই হাজার বলে। কি ভয়াবহ মিথ্যা কথা বলতে পারিস তোরা! বল আওয়ামী লীগ কোনো দিন কি এ রকম মিথ্যা বলেছে? বল?
পাখিটি কোনো উত্তর দিল না। বরং এক চোখ টিপ মেরে আমাকে আরো খেপিয়ে তুলল।
আমি এবার চিৎকার করে বলে উঠলাম, বল হারামজাদা, হলমার্ক থেকে আওয়ামী লীগের কোন নেতা কত টাকা নিয়েছে? একটা নেতার নাম বল? হলমার্কের মালিক কি আওয়ামী লীগ করে? তাকে আওয়ামী লীগ বিচার করার জন্য ধরেছে, এটাই কি তাদের দোষ? হলমার্কের মালিককে না ধরলে তোরা কয়জন হলমার্ককে চিনতি? পদ্মাসেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের কত টাকা আওয়ামী লীগ খেয়েছে বল? যে বিশ্বব্যাংক একটা টাকাও দেয়নি, সেখানেই তোরা বলছিস দুর্নীতি...দুর্নীতি। আর শেয়ার বাজারের টাকা আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দল মিলেই মেরেছে। দোষ দিলে শুধু একদলকে দিবি কেন শুয়োরের বাচ্চা? বিএনপির নামটা তো একবারও উচ্চারণ করলি না!
আমি পাখিটির কানের সামনে আরো জোরে চিৎকার করে বললাম, ‘খানকির পোলা, তোর গলায় কত শক্তি আছে দেখব আমি। বল, বাংলা ভাই।
বল, শায়খ আবদুর রহমান।
বল, তারেক রহমান।
-আরাফাত রহমান।
-ফালু।
-হারিছ চৌধুরী।
-১৭ আগস্ট বোমা হামলা।
-২১ আগস্ট শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা।
-জজ মিয়া নাটক।
- ১০ ট্রাক অস্ত্র।
-ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতের ওপর বোমা হামলা।
-ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা হামলা।
-উদীচি হত্যাকাণ্ড।
-সার কেলেঙ্কারি।
-খাম্বা কেলেঙ্কারি।
-বিদ্যুৎ কেলেঙ্কারি।
-নাইকো কেলেঙ্কারি।
-মন্ত্রী মোশরারফের দুই কোটি টাকার গাড়ি কেলেঙ্কারি।
-হাওয়া ভবন।
-বিদ্যুতের কারণে কানসাটে ২৪ জনের মৃত্যু।
-সারের কারণে কৃষক হত্যা।
-সারা দেশে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের তীব্র ভোগান্তি।
-দৌড় সালাহউদ্দিন।
-এমপি কিবরিয়া হত্যা।
-এমপি আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা।
-আইভি রহমানকে হত্যা।
-অসংখ্য কমিশনার হত্যা।
-গকুল চন্দ্র মহুরী।
-হুমায়ুন আজাদ।
-শিশু নওশিন।
-তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেলেঙ্কারি।
-প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেলেঙ্কারি।
-ফালুর প্রহসনের উপনির্বাচন।
-ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।
-আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়া গেছে।
-উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।
আরো বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার ভয়ঙ্কর চিৎকারে তোতা পাখিটি হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। তীব্র কষ্টে ছটফট করতে থাকল। আমি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম, তার সেবা করতে থাকলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, অনেক অত্যাচার করলেও পাখিটির ওপর কেন যেন মায়া জন্মে গেছে আমার। হয়তো অবুঝ কিংবা
নিম্ন বুদ্ধির প্রাণী বলেই। অবুঝ প্রাণীর ওপর কি রাগ করা যায়? কষ্ট পেলেও আমি তো তাদের ওপর রাগ করতে পারি না!
সর্বশেষ : আমার তোতা পাখিটি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি পাখিটি আর নেই, শুধু শূন্য খাঁচাটি পড়ে আছে। ভেবেছিলাম সে আবার ফিরে আসবে, কিন্তু আসেনি। অনেক দিন হয়ে গেল বাসায় পাখির অত্যাচার আর নেই। কিন্তু বাসা থেকে বেরুলেই দেখি, কোটি কোটি তোতা পাখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা চিৎকার করে মুখ ভেংচিয়ে বলছে, হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজার......হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ার বাজার.....হলমার্ক-পদ্মাসেতু-শেয়ারবাজার।
ভয়ঙ্কর চিৎকারে আমার কানের পর্দা ফেটে যায়, শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। আমি দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরি। তবু তোতা পাখিরা চিৎকার করতেই থাকে...করতেই থাকে...
ফাহিম সাদিকীন ভাইয়ের লেখা ।