১।
হাসপাতালের ক্যাফেতে বসে নাস্তার অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি। সরকারি হাসপাতালের ক্যাফে, যথারীতি নাস্তাগুলো যুতের না। কিন্তু কিছুই করার নেই, মাত্র পেশাগত জীবন শুরু হয়েছে। পকেট বেশিরভাগ সময়েই গড়ের মাঠ হয়ে থাকে। ভালো নাস্তা করতে মন চাইলেও সেই বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। একসময় হয়ত টাকা পয়সা হবে কিন্তু তত দিনে খাওয়ার ইচ্ছা চলে যাবে কিংবা কোনো রোগ হয়ে খাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এমন সময় হঠাৎ দরজায় দেখি রফিক সাহেবকে। রফিক সাহেব এখানকার ডিবির অফিসার। পেশাগত কারণেই কারণেই পরিচয় আছে। আমি এই মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের লেকচারার। তাই এর আগেও লাশ কিংবা পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নিয়ে কথা হয়েছে। আমি উনাকে দেখে হাত নাড়লাম। উনিও হাসি মুখে এগিয়ে এলেন আমার টেবিলের দিকে।
- কি ব্যাপার, কেমন আছেন?
- আর থাকা, সবসময় থাকতে হয় দৌড়ের উপর। রাত দিন বলে কিছুই নাই।
- তাই নাকি? আমার কাছেতো ব্যাপারটা খুবই অ্যাডভেঞ্চারাস মনে হয়।
- অ্যাডভেঞ্চার না ছাই। নিজে থাকলে বুঝতেন।
আমি ক্যাফের ছেলেটাকে ডেকে নাস্তার অর্ডার ডাবল করে দিয়ে বললাম
- গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। সারা জীবনের সাধ ছিল গোয়েন্দা হওয়া কিন্তু পারলাম কই? আপনাদের দেখে তাই হিংসা হয়।
রফিক সাহেব হেসে দিয়ে বললেন,
- সারা জীবনতো সলভড কেস ই পড়েছেন। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ কেসই আনসলভড থেকে যায়। আবার বহু খেটে সলভ করতে পারলেও শেষমেশ আসামীর কিছুই হয় না। সাক্ষী গায়েব হয়ে যায়, উপর মহল থেকে চাপ আসে আরো কত কি? অনেক সময় নিশ্চিত জানি আসামী কে তারপরও তার বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিতে পারি না, অথচ লোকটা হয়ত চোখের সামনে দিয়েই ঘুরে বেড়ায়। গল্প আর বাস্তবে বহু তফাত। এত দৌড়াদৌড়ি তাই এখন আর ভালো লাগে না। আমারো আপনাদের দেখে হিংসা হয়। আপনাদের মত টেবিলের পিছনে বসে বসে টাকা গুনতে পারলেই বরং ভালো লাগত।
ডাক্তার মানেই এখন লোকে বোঝে টাকা, অথচ টাকাওয়ালা ডাক্তার মাথায় টাক পড়ার আগ পর্যন্ত হওয়া যায় না। আমি আর এ ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে গেলাম না। তাছাড়া নাস্তা চলে এসেছে, তাই সিঙ্গাড়ায় কামড় বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
- আজকে এদিকে কি উপলক্ষে?
- একটা আত্মহত্যার কেস। আপনারতো জানার কথা, কালকে বহদ্দারহাট থেকে একটা মহিলার লাশ এসেছে না? ওইটা।
- নাম কি?
- দিলারা পারভীন। এক ডাক্তারের বৌ।
নাম বলায় চিনতে পারলাম। ৩০/৩১ বছরের একটা মহিলা। চেহারাটা মনে আছে, কারণ মহিলা ভয়ানক মোটা। ফ্যানের সাথে ফাঁশ লাগিয়ে আত্নহত্যা করেছে। ফাঁশ দেওয়ার পর ফ্যানটা খুলে এসেছিল কিনা, এই নিয়ে একটু হাসাহাসি হয়েছিল, এখন অবশ্য খারাপ লাগছে।
- কোন ডাক্তার?
- ডাক্তার সেলিম। জেনারেল হাসপাতালে প্রাক্টিস করেন।
- হুম। কিন্তু মহিলাতো আত্মহত্যাই করেছে। খুন হয়নি। পোস্ট মর্টেমে তা-ই পাওয়া গিয়েছে।
- হুম, তা-ই তো দেখছি।
- কি ব্যাপার কেসটা খুনের না হওয়ায় মনে হয় বেজার হলেন?
রফিক সাহেব আবার হেসে দিলেন,
- তা বলতে পারেন, ইদানিং কারো অপরাধ প্রমাণিত না হলে কেমন যেন লাগে। বোঝেন-ই তো, এদের পিছে ঘুরতে ঘুরতে সবাইকেই একই ক্যাটাগরিতে ফেলে দেই মনের অজান্তেই। তাই নিজের ধারনা ভুল প্রমাণিত হলে খারাপতো লাগেই।
- তো এখন কি হবে? এই কেস তো ডিসমিস?
- হুম বাট পুরোপুরি না। আরো কিছু তদন্ত হবে। অনেক সময় শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করে। নাইলে একটা সুস্থ স্বাভাবিক মহিলা এই কাজ করবে কেনো? আপনি-ই বলুন।
- কিন্তু মহিলার গায়ে তো কোনো ফিজিক্যাল টর্চারের আলামত পাওয়া যায়নি।
- তা যায়নি কিন্তু মানসিক টর্চারওতো করা যায়। যৌতুকের জন্য মানুষের অমানবিকতার কিছুই এখনো আপনি দেখেননি। এই ডিপার্টমেন্টে থাকেন আরো কিছুদিন। দেখতে পাবেন।
- যৌতুকের ব্যাপার স্যাপার আছে নাকি এতে?
- হুম। সেটাই এখন ভালমত খতিয়ে দেখা হবে। ডাক্তারের বৌ যখন, এ ধরনের ব্যাপার না থাকারই কথা। তারপরও দেখা যাক। মানুষকে বিশ্বাস নেই।
ততক্ষনে নাস্তা শেষ হয়ে গেছে। রফিক সাহেব উঠে পড়লেন। যাওয়ার আগে জোর করে বিলটাও দিয়ে দিলেন। আমি বললাম,
- কি হয় আমাকে প্লীজ জানাবেন। এসব ব্যাপারে আমার ভীষণ আগ্রহ বললাম-ই তো। তার উপর ব্যাপারটায় একজন ডাক্তার জড়িত।
উনি সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিলেন।
২।
দু’দিন পর রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরছি। এখানকার এক বেসরকারি হাসপাতালে কিছু প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করি। গেটের সামনে রিকশার জন্য দাড়ানো। হঠাৎ সামনে একটা মাইক্রোবাস থামল। জানালা নামানো হলে দেখি রফিক সাহেব,
- কি পিয়াস সাহেব, কোথায় যান?
- কোথাও না, বাসায় ফিরছি। আপনি?
- আরে আপনার সেই কেসটার ব্যাপারে যাচ্ছি। আপনাকে দেখে থামলাম। হাতে কাজ না থাকলে আসতে পারেন। আপনার গোয়েন্দাগিরির কৌতুহল মিটবে।
এই প্রস্তাবেতো আমি সানন্দে রাজি। বলামাত্র উঠে পড়লাম মাইক্রোতে। বেশ একটা ভাব এসে গেল, মনে মনে থ্রিলিং সব সাউন্ডট্রাক বাজতে লাগলো।
- আসলেন কোত্থেকে আর যাচ্ছি কোথায় আমরা?
- দিলারা পারভীনের বাবার বাড়ি থেকে ফিরলাম, যাচ্ছি ডাক্তার সেলিমের বাসায়।
- ওখানে কি জেরা করবেন সবাইকে?
- হ্যাঁ, ডাক্তার সাহেবের মা, দুই বোন, ছোট ভাই আর কাজের মেয়েটাকেও থাকতে বলেছি।
- আমি থাকলে সমস্যা হবে না?
- নাহ, এই মূহুর্তে আপনি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আপনার ডাক্তার পরিচয় ভুলে যান।
- আমি কি দুয়েকটা প্রশ্ন করতে পারবো?
- কেন পারবেন না? লোকটা ডাক্তার, তাকে আপনি আরও ভালো বুঝতে পারবেন। বলতে পারেন অনেকটা সেজন্যই আপনাকে সাথে নেয়া।
- তারপর কি সাসপেক্ট করছেন। আসামী কি দোষী? মহিলার বাবার বাড়ীর লোকজন কি বলল?
- সম্ভবত না, আমরা যা খোজ খবর করেছি তাতে লোকটার ভিতর সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। মহিলার বাবার বাড়ীর পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ নেই। জাস্ট একটা রুটিন ইনভেস্টিগেশনের জন্য যাচ্ছি। দেখা যাক উনাদের সাথে কথা বলে কিছু পাওয়া যায় কিনা?
- যৌতুক বা লোকটার অবৈধ কোন সম্পর্ক নিয়ে উনারা কিছু সন্দেহ করেন নাকি?
- নাহ, একদম ক্লীয়ার।
- উনাদের মধ্যে কি খুব ঝগড়া ঝাটি হতো?
- নাহ, মহিলার বাবার বাড়ীর লোকজনতো সেলিম সাহেবের খুব প্রশংসা করলেন।
- তাহলে মহিলা এই কাজ করলো কেন?
- সে জন্যই তো মনটা খচখচ করছে। দেখা যাক।
রফিক সাহেবের একটা ফোন আসায় উনি কথায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তবে আমার হাতে একটা ফাইল গুজে দিলেন। ডাক্তার সেলিম এর জীবন বৃত্তান্ত। ভদ্রলোক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। ছয় বছর আগে দিলারা পারভীনের সাথে বিয়ে হয়। প্রাক্টিস করেন জেনারেল হাসপাতালে আর একটা বেসরকারি মেডিকেলে পড়ান। চেম্বার টাইম বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা। এরকম আরও কিছু টুকিটাকি তথ্য জানলাম। পড়তে পরতেই ডাক্তারের বাসায় পৌঁছে গেলাম।
ডাক্তারের বাসায় পৌঁছে দেখি সবাই উপস্থিত। ড্রয়িং রুমে আগে থেকেই ছিলেন সবাই। পুলিশ দেখে খুব বেশি অস্বস্তি দেখলাম না কারো মধ্যে। সম্ভবত গত কয়েক দিন অনেক বারই এদের মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে এখন তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রফিক সাহেব আমাকে উনার সহকারি হিসাবেই পরিচয় দিলেন। জেরা করা হবে তাই একজন একজন করে আসতে বলা হল।
ডাক্তার সাহেবকে দিয়েই শুরু হলো। অবশ্য নতুন কিছু জানা গেল না।
তিনি জানালেন যে, স্ত্রীর সাথে তার খুবই চমৎকার সম্পর্ক ছিল। স্ত্রীর খুবই প্রশংসা করলেন। তাদের বিয়েতে যৌতুকের কোন ব্যাপার ছিল না। দুই পরিবারের আয়োজনে এবং তাদের উভয়ের সম্মতিতেই বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের আগে তার স্ত্রীর আর কারো সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক ছিল না, এ ব্যাপারে তিনি পুরো নিশ্চিত। কিন্তু তার স্ত্রী কেন এমন করলো, তার ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না।
ঝগড়াঝাটির কথা জিজ্ঞেস করায় বললেন, শেষ কবে কথা কাটাকাটি হয়েছে তা-ই তিনি মনে করতে পারছেন না।
ঐদিনের ঘটনার বিবরণ জানতে চাইলে তিনি বললেন যে, ঘটনার সময় তিনি বাসায় ছিলেন না। ছিলেন চেম্বারে। রাত ৮টার দিকে বাসার কাজের বুয়া তাকে ফোন করে জানায় যে, ম্যাডামের ঘরের দরজা বন্ধ এবং উনি কোন সাড়া শব্দ করছেন না। শুনেই তিনি দ্রুত বাসায় ফেরেন। বাসায় ফিরে তিনিও অনেক ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে তার ভাইকে খবর দেন। ভাই আসলে তার সহায়তায় দরজা ভেঙ্গে দেখা যায় যে তার স্ত্রীর লাশ ফ্যানের সাথে ঝুলছে। তারপর লাশ নামিয়ে যা যা করা দরকার তা তিনি করেন। উনার বলা শেষ হলে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- আচ্ছা আপনাদের বিয়ে হয়েছে ছয় বছর কিন্তু বাচ্চা কাচ্চা নেননি কেন?
- আসলে আমার স্ত্রীর সমস্যা ছিল, এ জন্য আমাদের বাচ্চা হয়নি।
- এ জন্য কি উনি খুব ডিপ্রেসড ছিলেন?
- তা তো একটু ছিলই।
- আপনি বা আপনার ফ্যামিলীর কেউ কি এ ব্যাপারে উনাকে খুব বেশি ব্লেম করতেন?
- ছি ছি। না। এ খবরে সবারই মন খুব খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ কখনো দিলারাকে কিছু বলেনি। তাছাড়া আমি চিকিৎসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। সামনের বছর বিদেশ যাব এ পরিকল্পনাও ছিল।
আমি আর কিছু না বলে রফিক সাহেবের দিকে তাকালাম। উনার ঠোটের কোণে মৃদু হাসি।
এরপর বাকী সবাইকে জেরা করা হলো। এবার সবাইকে এই বাচ্চা হওয়ার পয়েন্টটায় জোর দেওয়া হলো। কিন্তু সবাই বললো এই ব্যাপারে কখনোই মহিলাকে কষ্ট দেওয়া হয়নি বরং পরিবারের সবাই পুরো সাপোর্ট দিত তাকে। ডাক্তার সাহেবের মা অবশ্য দুঃখ করলেন যে, তার এমন লক্ষী বৌ যে এমন একটা কাজ করতে পারে তা তিনি কল্পনাও করেন নি। কিন্তু জীবিত অবস্থার এমন লক্ষী বৌ মরার পরে এমন তাদের এমন বিপদে ফেলেছে বলে তাকে বেশ বিরক্ত মনে হলো।
কাজের মহিলাকে সবচে ভালো ভাবে জেরা করা হলো। কারণ সে পরিবারের বাইরের লোক আর এদের সবচে কাছাকাছি এ-ই ছিল। সে ও আগের সবার মতই একই কথা বললো। প্রায় পাঁচ বছর এখানে আছে। সাহেবের সাথে ম্যাডামের ঝগড়া হতে সে কখনো দেখেনি। বাচ্চা না হওয়ার কারণে এই ফ্যামিলীর কাউকে মহিলাকে কখনো কিছু বলতে শোনেনি। যদিও এই কারণে উনার মন খারাপ থাকতো। ঘটনার দিন রাতে কি রান্না হবে জানার জন্য সন্ধ্যার দিকেই সে ম্যাডামকে ডাকতে গিয়েছিল, কিন্তু কোন জবাব না পেয়ে ফিরে আসে। ভেবেছিল হয়ত ম্যাডাম খারাপ লাগায় ঘুমাচ্ছেন বা রেস্ট নিচ্ছেন। পরে আরও কয়েকবার ডাকাডাকি করেও সাড়া না পেয়ে সে সাহেবকে ফোন করে। তবে শেষ মুহুর্তে একটা নতুন তথ্য দিল সে, মহিলার শরীর আর মন দুটোই নাকি গত কয়েক মাস একটু বেশিই খারাপ ছিল। প্রায়ই নাকি তার নাক দিয়ে রক্ত পড়ত। নাক মুখ শুকিয়ে যেত। সারাক্ষণ একাকী থাকতো। সবার সাথে খিটমিট করতো। তবে সাহেব ভালো মানুষ বলে কিছু মনে করতো না।
জেরা শেষ হলো, অস্বাভাবিক কোন কিছুর আলামতই পাওয়া গেল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেলিম সাহেব পুরোই নির্দোষ। রফিক সাহেবও একমত হলেন। কিন্তু এত ভালো থাকার পরও মহিলা এই কাজ কেন করলেন, তার ব্যাখ্যা মিলল না।
মন একটু খারাপই হল, সত্য কথা। আসার সময় সারা রাস্তা চিন্তা করেছি ঝানু গোয়েন্দাদের মত জেরায় কাবু করে অপরাধী সনাক্ত করে ফেলব। তা আর হলো না।
যাই হোক সেলিম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরুতে যাব এমন সময় হঠাৎ আমার মনে হলো গোয়েন্দাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েণ্ট আমি মিস করেছি। ক্রাইম সীনটাই আমি দেখিনি। রফিক সাহেবকে সেটা বলতেই উনি বললেন, আপনি চাইলে একবার দেখে আসতে পারেন। আমি কয়েকবার দেখেছি। আর এখন ওখান থেকে সব এভিডেন্স সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
আমি তাও যেতে চাওয়ায় রফিক সাহেবের অনুরোধে সেলিম সাহেব তাদের বেডরুমে আমাকে নিয়ে গেলেন। একদম নর্মাল বেডরুম। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আর একটা ওয়ার্ড্রোব। ফ্যানের সাথে ফাঁশ লাগিয়ে ড্রেসিং টেবিলের টুলটা ব্যবহার করা হয়েছে আত্মহত্যা করতে। সব ছিমছাম। ঘটনার দিন আসলেও হয়ত কিছু চোখে পড়ত। আমিতো আর প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা না যে, এখান থেকেও কিছু বের করে ফেলব। তাই হতাশ হলাম আরেকবার। ওয়ার্ড্রোবের উপর বাধানো একটা ছবি দেখে এগিয়ে গেলাম। ডাক্তার সাহেবের সাথে এক মহিলা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাতেই বললেন,
- আমাদের হানিমুনের ছবি। তখন ও চিকন ছিল।
- এত মোটা হলেন কিভাবে?
- বছর তিনেক আগে টাইফয়েড হয়েছিল। তারপর থেকেই ও মোটা হয়ে গেছে।
- এই বিষয়ে উনি কী উনি আপসেট ছিলেন?
- নাহ, আমাকে অন্তত কখনো বলেনি।
মহিলার অসুখের আগে পরে পুরো দুই রূপ। আগে বেশ সুন্দরী ছিলেন কিন্তু এখন আসলেই কুৎসিত হয়ে গেছিলেন।
ওয়ার্ড্রোবের উপর কয়েক বাক্স ওষুধ। ট্রায়াঙ্গেল কোম্পানির isotretinoin।
এতগুলো ওষুধ একসাথে দেখে এমনি জিজ্ঞেস করে বসলাম, আচ্ছা এগুলো কার ওষুধ? প্রশ্নটা শুনে উনি কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। দ্রুত বললেন, আরে এটা প্রেসারের ওষুধ। দিলারা মোটা হওয়ার পর ওর প্রেসার ও হয়েছিল, তাই খাওয়া লাগত।
শুনে খুব অবাক হলাম কারণ এটা প্রেসারের ওষুধ না। একজন ডাক্তারের প্রেসারের ওষুধ ভুল হওয়ার কথা না। তাহলে উনি মিথ্যা বলবেন কেন?
কিন্তু আমিতো এখানে ডাক্তার হিসাবে আসিনি, তাই অবাক হলেও আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
সেদিনের মত বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
রফিক সাহেব বললেন, মন খারাপ নাকি? দেখলেন তো নিজের ধারণা না মিললে সব সময়ই এমনটা হয়।
আমি শুকনো একটা হাসি হাসলাম। কিন্তু আমার মনের মধ্যে তখন অন্য চিন্তা। ব্যাপারটা আগে সিওর হতে হবে। তারপর দেখা যাবে।
৩।
রফিক সাহেবই বাসায় পৌঁছে দিলেন। পৌঁছেই হামলে পড়লাম বইয়ের উপর, মনের ভিতর যা উকিঝুকি মারছিল তার সত্যতা মিলল, নেটও ঘেটে দেখলাম, আসলেই তাই। তখনই রফিক সাহেবকে জানাতে মন চাইল, পরে ভাবলাম থাক। আমার অনুমানের কোন প্রমাণ নেই। একজন ডাক্তারের বাসায় ওষুধ থাকতেই পারে। আর, যদি আমার অনুমান সত্য হয় তবে এতক্ষণে ঐ ওষুধ আর ওখানে পাওয়া যাবে না। অনেকগুলো ব্যাপার নিশ্চিত হতে হবে। তারপরেই উনাকে জানাবো।
পরদিন হাসপাতালের রেজিস্টার থেকে নাম্বার নিয়ে দিলারা পারভিনের বাবার বাসায় ফোন দিলাম, এখানে নিজের পরিচয়ই দিলাম। উনার মার সাথে কথা বলতে চাইলাম। প্রথমে অবশ্য উনারা আপত্তি করলেন যে, উনি এখনো শোকের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেননি। কিন্তু মাত্র একটা প্রশ্ন করব বলে শেষে উনাকে দেওয়া হল। উনাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, উনার মেয়ে বিগত কয়েক মাস কোন ওষুধ নিয়মিত খেতেন কিনা, তা কি উনি জানেন? উনি জানালেন যে, হ্যাঁ। চিকন হওয়ার জন্যে ও অনেক চেষ্টা করছিল। তাই একটা ওষুধ উনার মেয়ে গত কয়েক মাস নিয়মিত খেতেন।
ওষুধটা কে প্রেসক্রাইব করেছে তা অবশ্য উনি বলতে পারলেন না। তবে জানালেন যে জামাইয়েরই এনে দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কারণ গত ৪/৫ মাস উনার মেয়ে ডাক্তারের কাছে যে যাননি, সে ব্যাপারে উনি নিশ্চিত। গেলে উনি জানতেন।
আমার সন্দেহই সত্য হল। এখন এই সন্দেহের সত্যতা আমাকে প্রমাণ করতে হবে।
রফিক সাহেবকে বললে অবশ্য সহজেই হয়ে যেত। কিন্তু মাথার ভিতর গোয়েন্দাগিরির রোখ চেপে গিয়েছে। যা করার করে তারপরেই উনাকে জানাবো বলে ঠিক করলাম। আরেক স্যারকে জরুরী কাজের অজুহাতে আমার ক্লাসটা একটু প্রক্সি দিতে বলে বেরিয়ে এলাম। প্রথমে আমাকে জানতে হবে ঐ ওষুধটা সেলিম সাহেব কি গত কয়েক মাস ধরেই
কিনছেন, নাকি ঐ এক প্যাকেট কাকতালীয়ভাবে ওখানে ছিল। সেলিম সাহেবের বাসার কাছে কয়েকটা ফার্মেসী আছে। ওখান থেকেই কিনতেন কিনা কে জানে? সেটা যাচাই করতেই উনার বাসার কাছে চলে এলাম। এই ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেওয়া নিষেধ কিন্তু বাংলাদেশে এসব মানার বালাই নাই। তাই প্রথম দোকানটার দিকে এগুলাম।
- ভাই, ট্রায়াঙ্গেল কোম্পানির isotretinoin ওষুধটা আছে?
- আছে, কয়টা লাগবে?
- এক বক্স দেন।
দোকানী এক বাক্স ওষুধ এগিয়ে দিল। হাতে নিয়ে বলি,
- আমাকে ডাক্তার সেলিম পাঠিয়েছেন। দামটা উনিই দেবেন। জরুরী দরকার তাই আমাকে বলেছেন দ্রুত ওষুধটা নিয়ে ফিরতে। আপনার দোকান থেকে নাকি প্রায়ই এই ওষুধ বক্স ধরে কেনেন?
- কই নাতো!
- ও আচ্ছা, আমি বোধহয় দোকান চিনতে ভুল করেছি।
বলে দ্রুত সটকে পড়লাম। বাকী দোকানগুলোতেও একই কাহিনী।
হতে পারে চেম্বারের কাছে কোন দোকান থেকেই ওষুধটা কেনেন। তাই ওখানে চলে এলাম। কিন্তু ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না। কোন দোকানেই প্রমাণ মিলল না। লোকটা খুবই ধুরন্দর বোঝা যাচ্ছে। হয়তো এমন কোন দোকান থেকে কেনে যেখান থেকে কেউ সন্দেহই করবে না। হতে পারে বাড়ী ফেরার পথে রাস্তায় কোথাও গাড়ি থামিয়ে কিনে নেন।
হতাশ হয়ে গেলাম। এখনতো আর আমার কিছুই করার থাকল না। রফিক সাহেবকে না বলে তো আর থাকতে পারব না মনে হচ্ছে। এখন উনার পক্ষেই সম্ভব দোকানটা খুঁজে বের করা। কিন্তু ভদ্রলোক চিলের পিছে ছুটবেন কিনা কে জানে?
সেদিনের মত রুমে ফিরলাম। বিকেলে আবার আমার নিজের প্র্যাকটিসে ছুটতে হলো। ব্যস্ততায় ডিসিশন নিতে পারলাম না, জানাবো কি জানাবো না।
রাতে রুমে ফিরে আবার চিন্তায় বসলাম। অনেক দোটানার পর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি নিজেই এর শেষ দেখে ফিরব। প্রিয় একটা গোয়েন্দা উপন্যাসের নায়কের একটা উক্তি মনে পড়ল “খড়ের গাদাতেও একটা সুঁই খুঁজে পাওয়া সম্ভব যদি ধৈর্য ধরে সব খড় একটা একটা করে সরান হয়।”
ডাক্তার সাহেবের বাড়ী ফেরার রাস্তার প্রতিটা দোকান আমি খুঁজে দেখব।
কালই তাকে ফলো করে বাড়ি কোন পথে ফেরেন দেখে নিতে হবে। কারণ উনার চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরার তিনটা রাস্তা।
পরদিন খোজ নিলাম ডাক্তার সাহেব চেম্বারে আসবেন কিনা? বলা হল, না। স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে এক সপ্তাহ উনি চেম্বারে আসবেন না। আবার গেল মেজাজটা খারাপ হয়ে। এখন তিনটা রাস্তাই খুঁজে দেখতে হবে।
কারণ আরো এক সপ্তাহ বসে থাকা যাবে না। এতদিন পর রহস্য উদ্ধার করে আর কি লাভ হবে?
শেষে বন্ধুর মোটর সাইকেল ধার করে ডাক্তারের বাড়ি ফেরার সবচে কমন যে রুটটা হতে পারে সেটা ধরে এগুলাম।
না, কোন খোজ পেলাম না। প্রথম দিন নষ্ট হল।
দ্বিতীয় দিন আরেকটা রাস্তা ধরে এগুলাম। কিন্তু ফলাফল একই। প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম।
আর একদিন দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। কাল যদি কিছু না হয় তো এখানেই আমার গোয়েন্দাগিরির ইতি।
৪।
পরের দিন গেলাম শেষ রাস্তায়। এটা একটা আবাসিক এলাকা। ওষুধের দোকান বেশি নেই। বাসাবাড়ির ফাঁকে ফাঁকে সবই কনফেকশনারীর দোকান। বহু খুঁজে একটা দোকান পেলাম। কিন্তু বরাবরের মত কোন লাভ হল না।
প্রচণ্ড বিরক্ত আর হতাশ হয়ে রাস্তায় পার হচ্ছি। বাইকটা একটু দূরে দাড় করিয়ে রেখেছি। আর কোন দিকে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ গাড়ির হর্ণে চমকে সরে গেলাম। একটা প্রাইভেটকার গা ঘেসে সামনের বাড়িটার সামনে থামল। আমি পাশ কাটাতে গিয়ে, গাড়ির ড্রাইভারকে দেখে থমকে গেলাম।
ডাক্তার সেলিম । এখানে কেন? বেশ সেজেগুজেই এসেছেন দেখছি। স্ত্রীর শোকে উনি চেম্বারে যাচ্ছেন না, কিন্তু সেজে গুজে এখানে কি? কোন আত্মীয়ের বাসা এটা?
গাড়িটা ভিতরে ঢুকতেই আমি দৌড়ে গেলাম। কিন্তু দারোয়ান আটকে দিল।
- কই যান? কার বাসায়?
কি যে বলি, মাথা চুলকাতে গিয়ে চোখে পড়ল ‘to-let’ এর বিজ্ঞাপনটা।
- বাসা ভাড়া নিতে আসছি।
লোকটা সন্দেহের চোখে আমাকে দ্যাখে।
- ব্যাচেলর নাকি?
- নাহ, নতুন বিয়ে।
- বাড়িওয়ালার বাসা তিনতালায়। আপ্নে যান, আমি ফোন করে দিচ্ছি।
- আচ্ছা, এই মাত্র যেই ভদ্রলোক আসলেন, উনিই কি বাড়িওয়ালা নাকি?
- নাহ, উনি মেহমান।
- কোন বাসার মেহমান?
লোকটার চোখে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। আমি আমতা আমতা করে বলি,
- না মানে আমার এক পরিচিত লোকের মত লাগল। তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি। তাছাড়া উনার কোন আত্মীয় এখানে থাকলে, এই বাড়ি সম্পর্কে আমাকে কিছু বলতে পারতেন, তাই আরকি! এখানে উনার কে থাকে?
- এই লোকরে আমি চিনিনা। মাসে দুইমাসে একবার আসেন। এইখানে উনার কে থাকেন কইতে পারিনা আর এই বাড়িওয়ালা খুব ভালো মানুষ। বাসার ভাড়াটিয়াদের উনার সম্পর্কে কোন কমপ্লেন নাই।
- আচ্ছা আমি বরং দেখা করে আসি।
বলে উপরে উঠে এলাম। জানি লাভ হবে না, তারপরেও কোন বাসায় ঢুকেছে বের করার চেষ্টা করলাম। পায়ের ছাপ বা পারফিউমের গন্ধ কিছুই পাওয়া গেল না কোন দরজার সামনে।
বেরিয়ে এলাম বিল্ডিং থেকে। দারোয়ানের উৎসুক চোখের জবাবে বললাম, বাসার ফিরে বৌয়ের সাথে আলাপ করে জানাবো।
ধুর! বারবার এমন কেন হচ্ছে। অভিজ্ঞতার অভাব? হতে পারে।
বাইকটা আড়ালে সরিয়ে এনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কখন বেরুবে কে জানে? আর বেশিক্ষন তো থাকতে পারব না। সরকারি হাসপাতালের ডিউটি ফাকি দিতে পারলেও, প্রাইভেটেরটাতো পারব না। গোসল খাওয়া কিছুই হয়নি।
কেটে গেল আরও ঘণ্টা খানেক। অধৈর্য হয়ে যে মূহুর্তে চলে যাব ভাবলাম, তখনই বেরিয়ে এলো গাড়িটা। সামনের সীটে তখন একজন ভদ্রমহিলা।
পিছু নিয়ে চলে এলাম শহরের অভিজাত একটা রেস্টুরেন্টে। ভিতরে ঢুকে আড়াল থেকে মহিলাকে দেখলাম। খুবই সুন্দরী।
দুজনকে একসাথে দেখে মনে হল খুবই ঘনিষ্ট এরা। শুধু শুধু না থেকে লাঞ্চ সেরে নেব ভাবলাম। এতো দামি রেস্টুরেন্টে বেশি কিছু অর্ডার দেওয়ার সাহস হল না। খাওয়া শেষে ওয়েটারকে একটু বেশি বখশিশ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে ঐ ভদ্রমহিলাকে চেনে কিনা?
সে বলল যে চেনে। কিন্তু নাম ধাম পরিচয় জানে না। এনারা দুজন প্রায়ই আসেন এখানে সেই সূত্রেই মুখ চেনা।
উনারা আলাপে মত্ত। আমার আর থাকা হল না। এমনিতেই ঘণ্টাখানেক দেরী করে ফেলেছি। রুমে না ফিরে ঐ অবস্থায়ই হাসপাতালে গেলাম। সারাদিনের ধকলে মাথা ব্যথা করছিল। হাসপাতালের ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনতে গেলাম। তা দেখে দোকানের লোকটা হেসে বলল, ডাক্তারেরাও আজকাল ওষুধ কিনে খাচ্ছে নাকি? এম. আর.রা কি নাই নাকি দেশে?
আরে তাইতো। এই সহজ জিনিসটা মাথায় আসেনি কেন?
দ্রুত রিসেপশনে ছুটলাম। ট্রায়াঙ্গেল কোম্পানির এম.আর. এসেছে কিনা খোজ নিলাম। না আসেনি। ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন দিলাম। আমরা এদেরকে ভালো মত না চিনলেও এরা আমাদের ভালই চেনে। নাম বলতেই তাই চিনে ফেললেন। কুশল জানার পর বললেন,
- তারপর বলেন কি খেদমত করতে পারি?
- আরে তেমন কিছু না, আসলে আমার একটা ওষুধ দরকার।
- কি ওষুধ বলে ফ্যালেন।
- আমার কিছু isotretinoin দরকার।
- কতগুলো?
- এই ধরেন এক বাক্স।
- এতগুলো!
- হুম।
- ওকে। পেয়ে যাবেন।
সেলিম সাহেবের কথা পাড়তে যাব, কিন্তু তার আগে উনিই জিজ্ঞেস করলেন
- আচ্ছা হঠাৎ এই ওষুধটার এতো চাহিদা এত বেড়ে গেল কেন বলুন তো?
- কেন? কি হয়েছে?
- সেলিম সাহেবকেও দেয়া লাগে মাসে ৩ বাক্স। চিনেছেন তো? জেনারেলে বসেন।
- হুম চিনি। উনি কি করেন এত?
- তা তো জানিনা।
- আচ্ছা ঠিক আছে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আমার যা জানা দরকার তা জানা হয়ে গেছে। রফিক সাহেবকে ফোন দিলাম। বললাম যে, উনাকে সাথে নিয়ে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। আজই।
উনি জানালেন ব্যবস্থা করছেন। তবে দেখা করার কারণ জানতে চাইলে জানালাম ওখানেই বলব।
৫।
রাত ১০টার দিকে আমরা ডাক্তার সাহেবের বাসায় পৌঁছলাম। আজ অবশ্য ডাক্তার একাই আছেন।
রফিক সাহেবকে বললেন,
- আজ হঠাৎ আবার কি মনে করে? আমিতো জানতাম তদন্ত শেষ। এবং আমি ক্লীন প্রমাণিত হয়েছি, অ্যাজ আই অ্যাম।
- তেমন কিছু না। একটু বিরক্ত করতে এসেছি। আমার এই বন্ধুটি আপনাকে কিছু কথা বলতে চান।
বলে আমার দিকে তাকালেন। ডাক্তার সাহেবও আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, বলুন।
আমি একবার কেশে নিলাম। তারপর শুরু করলাম,
- ডাক্তার সাহেব, আমি রফিক সাহেবের সহকারী হলেও, আমার আরও একটা পরিচয় আছে।
একটু থেমে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললাম, আমি একজন ডাক্তার।
ডাক্তার সাহেবের মুখের একটা পেশিও নড়ল না। শুধু বললেন, তো?
আমি আবার বললাম, সেদিন আপনি আমাকে আপনার বেডরুম দেখাতে নিয়ে গেছিলেন মনে আছে? ওখানে ওয়ার্ড্রোবের উপর আমি এক বাক্স ওষুধ দেখেছিলাম। ওষুধগুলো ছিল isotretinoin।
আমি আবারো একটা পজ দিলাম। ডাক্তারের ভ্রূ সামান্য উচু হল।
- আমি জিজ্ঞাসা করায় আপনি আমাকে বললেন ওগুলো প্রেসারের ওষুধ। আমার ঐ মুহুর্তে ওগুলো কিসের ওষুধ মনে না থাকলেও, নিশ্চিত ছিলাম যে ওগুলো প্রেসারের ওষুধ না। ওগুলো চর্মরোগের ওষুধ। সাধারণত ব্রনের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- এসব আমাকে না শোনালেও চলবে। আপনার চে আমি সম্ভবত আমি আরও ভালো জানি। আপনি এসব দ্বারা কি বলতে চাইছেন, তা বলুন।
- আমি বলতে চাইছি যে, আপনি আপনার স্ত্রীকে খুন করেছেন। খুব ঠাণ্ডা মাথায় এবং সুচারুভাবে।
- কিভাবে? ঐ ওষুধ দিয়ে? আমি চর্মরোগের ডাক্তার আমার বাসায় এই ওষুধ থাকতেই পারে।
- পারে অবশ্যই। কিন্তু বিগত তিন মাস ধরে তিন বাক্স ওষুধ কি একটু বেশি বেশি না, সেলিম সাহেব? আপনি কি ফ্রী এই ওষুধ আপনার রোগীদের দান করেন?
- তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। isotretinoin তো আর পয়জন না।
- ডাক্তার সাহেব, আপনি ড্রাগ আর পয়জনের সংজ্ঞা ভুলে গেছেন মনে হয়। দুটোর মধ্যে পার্থক্য কিন্তু খুব সামান্য। একটু এদিক ওদিকেই ড্রাগ পয়জনে পরিণত হতে পারে। যাক আপনাকে এখন ফার্মাকোলজী পড়াতে চাই না। যা বলতে চাচ্ছি তা হল, isotretinoin সিম্পল একটা ওষুধ কিন্তু এর অনেকগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এর মধ্যে সবচে মারাত্মক হলো গর্ভপাত। অন্যান্যগুলোর মধ্যে একটা হল এটা সুইসাইডাল টেণ্ডেন্সী সৃষ্টি করে। আপনার কথামত এ ওষুধগুলো আপনার স্ত্রীর কিন্তু তার মুখে কোন ব্রনের ছাপ আমি দেখিনি। এবং আপনার শ্বাশুড়ীর কথামত আপনি আপনার স্ত্রীকে ওজন কমানো বা চিকন হওয়ার জন্য একটা ওষুধ এনে দিতেন। আমার ধারণা এটাই সে ওষুধ। isotretinoin এর ডোজ হল ০.৫ থেকে ২ মিলি গ্রাম পার কেজি বডি ওয়েট। কিন্তু আপনার ওষুধ সংগ্রহের মাত্রা দেখে আমার মনে হয় আপনি আপনার স্ত্রীকে আরও অনেক বেশি ডোজ দিয়েছিলেন।
- তাতে কি প্রমাণ হচ্ছে? isotretinoin খেয়েই যে তার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সী হয়েছে সেটা তো এ থেকে প্রমাণ হয় না।
- না হয় না, কিন্তু এই একটা মাত্র সাইড ইফেক্ট না, আপনার স্ত্রীর আরও কিছু উপসর্গ ছিল, যেগুলো সবই isotretinoin এর সাইড ইফেক্ট। আপনার বাসার বুয়ার ভাষ্য মতে তার প্রায়ই নাক দিয়ে রক্ত পড়ত, নাক মুখ খুব শুকিয়ে যেত। সবকিছু মিলিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, আপনার স্ত্রী নিয়মিত isotretinoin খেতেন কিন্তু তার উপযুক্ত কোন কারণ ছিল না। তিনি খেতেন আপনার কথায় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কারণে। আপনি ইনডাইরেক্টলী আপনার স্ত্রীকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। যেটাকে খুন বলতে আমার আপত্তি নেই।
- কিন্তু আমি কেন কারণ ছাড়া আমার স্ত্রীকে আত্মহত্যা করতে ঠেলে দেব?
- অনেকগুলো কারণ আছে। আপনার স্ত্রী বন্ধ্যা। মুখে যা-ই বলুন, মনে মনে নিশ্চয়ই আপনি কষ্ট পাচ্ছিলেন। আবার সামাজিকভাবে মহান সাজতে গিয়ে তাকে ছাড়তেও পারছিলেন না। টাইফয়েড হওয়ার আগে পরে আপনার স্ত্রীর ছবি আমি দেখেছি। আগে আপনার স্ত্রী বেশ সুন্দরী ছিলেন কিন্তু অসুস্থতার পর আসলেই তার চেহারা কুৎসিত হয়ে গিয়েছিল। সেটাও একটা কারণ হতে পারে। এবং সর্বশেষ হলো, আপনি বেশ কিছুদিন ধরেই আরেকজন মহিলার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছেন। আজ দুপুরেও আপনাদেরকে একসাথে লাঞ্চ করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে শেষেরটাকেই আমার প্রধান কারণ মনে হচ্ছে।
আপনার একটা প্লাস পয়েণ্ট ছিল যে, বাচ্চা না হওয়া এবং মোটা হওয়া দুটো কারণেই আপনার স্ত্রীর মন সবসময় খারাপ থাকতো। এ কারণেই এই সাইড ইফেক্টটা আরো ভালভাবে কাজ করতে পেরেছে। মহিলার মন এমনিতেই বাচ্চা না হওয়া আর নিজের কুৎসিত চেহারা নিয়ে আপসেট ছিল। আর সেই সুযোগটাই আপনি ঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন। আগাগোড়াই আপনি নিখুঁত ছিলেন। ভুল করলেন মিথ্যা বলে। আপনি যদি ঐদিন ওষুধটার সত্য ব্যবহার জানাতেন, তাহলে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও জাগত না, আমিও ভাবতাম যে আপনার বাসায় এ ওষুধ থাকতেই পারে, যেহেতু আপনি চর্মরোগের ডাক্তার।
অবশ্য এর আগেও একটা ভুল করেছেন। মূলত ওটাই বড় ভুল। তা হল ঘটনার পরও ঐ ওষুধগুলো ওখানেই রেখে দেয়া। লাশ সৎকারের ঝামেলায় ভুলে গেছিলেন নাকি সব ঝামেলা শেষ মনে করে আবার ওখানে রেখে দিয়েছিলেন?
রফিক সাহেব মুখ খুললেন এতক্ষণে, না ঘটনার দিন ওখানে কোন ওষুধের বাক্স ছিল না। আমার খেয়াল আছে।
সেলিম সাহেব কিছু বললেন না। উনি ঘামতে শুরু করেছেন। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে উনার প্রেসার বেড়ে গেছে। আমি বিদ্রুপের লোভ সামলাতে পারলাম না,
- আপনার প্রেসারতো বেড়ে গেছে। ডাক্তার সাহেব। ওষুধ খান একটা। প্রেসারের ওষুধ কোনটা জানা আছে তো? নাকি বলে দিতে হবে?
সেলিম সাহেব এর ও কোন জবাব দিলেন না। অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিলেন। ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
- আই আপ্রেশিয়েট ইয়োর ইমাজিনেশন। ইট মে বি ট্রু বাট ইউ ক্যাণ্ট প্রুভ ইট। এতকিছুর পরও একটা জিনিস আমার পক্ষে আছে এবং এই একটা যুক্তি দিয়েই আপনার সব তথ্য উপাত্ত প্রমাণ উড়িয়ে দেয়া যায়। যুক্তিটা আপনিও জানেন। আমি একজন চর্মরোগের ডাক্তার। আমার বাসায় চর্মরোগের ওষুধ থাকতেই পারে। আর ওষুধটা যে আমার বাসায় ছিল কখনো, সেই প্রমাণই বা কোথায়? এম.আরের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে আমি যে বাসাতে আমার স্ত্রীকেই দিয়েছি সেই সাক্ষী কই?
ভ্রূ উঁচিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। এবার আমার মুখ শুকিয়ে গেল। আসলেই তো। কী মারাত্মক ভুলটাই না আমি করেছি। সেইদিনই যদি ওষুধের বাক্সটা জব্দ করা যেত, তাহলেও কিছু হয়ত করা যেত। আমার এত পরিশ্রম পুরোই বৃথা গেল। চুপচাপ কেটে গেল অনেকক্ষণ। ডাক্তার সাহেবই আবার মুখ খুললেন,
- রাত অনেক হয়েছে। আপনারা এখন উঠলেই আমি খুশি হই।
কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালাম। রফিক সাহেবও কিছু বললেন না।
সেলিম সাহেব বললেন, আমি আশা করছি আমাকে আর কোন ধরনের হয়রানি করা হবে না।
রফিক সাহেব কিছু না বলে শুধু হেসে চলে এলেন।
৬।
গাড়িতে আমি কোন কথা বললাম না। রফিক সাহেবও আমার মনের অবস্থা বুঝলেন, তাই তিনিও আর কিছুই বললেন না। বাসার সামনে নামতে, উনিও নামলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,
- মন খারাপ কেন করছেন? একজন অ্যামেচার গোয়েন্দা হয়েও আপনি কিন্তু যথেষ্ট ভালো কাজ দেখিয়েছেন। গোয়েন্দাদের কাজ অপরাধী সনাক্ত করা। তাদের বিচার করা না। আপনার কাজটা তো আপনি ঠিকমতই করেছেন।
- কোনোভাবেই কি এটা যে খুন তা প্রমাণ করা যাবে না?
- আমি কোন রাস্তা দেখছি না। তাছাড়া আপনি একটা ভুল করেছেন, বুঝতে পেরেছেন তো?
- হুম্ম
- এভিডেন্স কখনোই হাতছাড়া করতে হয় না। ওষুধের বাক্সটা হাতে থাকলেও আমরা কিছু আশা করতে পারতাম।
আমি কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। রফিক সাহেব আবার বললেন,
- দেখলেন তো গোয়েন্দাগিরির কত জ্বালা। আশা করি আপনার শখ মিটেছে। রাত অনেক হয়েছে। আজ যাই।
রফিক সাহেবের গাড়ি বিদায় নিলেন। অপরাধীর বিচার না হোক অপরাধী ধরতে তো পেরেছি, মনকে এই স্বান্তনা দিয়ে আমিও রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
ফেসবুক