মিশরের গণবিপ্লব : বিপ্লবীদের স্বপ্ন পুরণ হবেতো?
কাইয়ূম আবদুল্লাহ
মিশর বিপ্লব শেষ পর্যন্ত আরব বিপ্লবে রূপ লাভ করতে শুরু করেছে। আজকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তিউনিসিয়া হয়ে মিশরে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে ইয়েমেন, জর্ডান, আলজেরিয়া, স্কান, সিরিয়া কিংবা লিবিয়ায়। মিশরের বিপ্লবীরা সফল হলে অন্যান্য স্থানে শুরু হওয়া সুপ্ত বিপ্লবও সফলতা পাবে। মঙ্গলবার মিশরের তাহরির স্কয়ার থেকে চূড়ান্ত পর্যায়ে শুরু হওয়া স্বতঃস্ফুর্ত মিলিয়ন মানুষের গণবিক্ষোভ রাতের আধারে হাইজ্যাক না হলে সপ্তাহান্তের যেকোন দিনের আবর বিশ্বের ভোরের আকাশ নতুন এক আলোর আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। দীর্ঘ দিন থেকে নিজ দেশে অনেকটা পরদেশী, কোনঠাসা আরব্য জনপদের স্বকীয়তা ও প্রকৃত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মুক্ত হবে। পরাশক্তিদের সমর্থনপুষ্ট স্বৈরশাসকদের নির্যাতনে কোনঠাসা হয়ে পড়া মিশরের জনগণ এখন রাজপথকেই ঘরের চেয়ে নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এমনই স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য শোনা যাচ্ছে কয়েকদিন থেকে চলা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিবাদী জনতার মুখে। আরবদের বুকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার সম্পন্ন ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে পারলেও নিজেদের ভূমিতে প্রকৃত অর্থে কোনো মুসলিম রাষ্ট্র কিংবা ইসলামি কোনো শক্তিকে ক্ষমতায় যেতে দিচ্ছে না বিশ্বের পরাশক্তিগুলি। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে বার বার পরাস্ত হয়ে যাচ্ছে তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক চেষ্টা-প্রচেষ্ঠা। আমেরিকা সারা বিশ্বকে গণতন্ত্রের সবক দিলেও আরব বিশ্বের খোদ সৌদি আরব থেকে শুরু করে সকল রাষ্ট্রেই গণতন্ত্রের পরিবর্তে কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও বা গণতন্ত্রের আবরণে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রকে সবরকমের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। স্বৈরাশাসকদের বিরুদ্ধে বিপ্লব তিউনিসিয়া থেকে শুরু হল্ওে মিশরের মতো আমূল পরিবর্তনের এমন নজিরবিহীন জোরালো গণবিপ্লব ইরানের পর আরব বিশ্বে এই প্রথম। মঙ্গলবার মিশরের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ অভিমুখে মার্চে মিলিয়ন জনতার উপস্থিতি আশা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তার বিস্তৃতি দ্বিগুণ রূপ লাভ করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের গগণবিদারী শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হলেও একজন নতুন মোবারকের সন্ধান না পাওয়ায় আমেরিকাসহ বিশ্বের পরাশক্তিগুলো জনতার ইচ্ছার প্রতিফলনকে বাস্তবায়নে কিংবা স্বাগত জানাতে কালবিলম্ব করছে। তিউনিসিয়ায় সূচনা হওয়া গণবিপ্লবের যে ধাক্কা মিশরে এসে আরো বৃহদাকারে বিস্ফোরিত হয়েছে তার ঢেউ সমগ্র আরব বিশ্বকে ঝাকি দিতে শুরু করেছে। তাইতো আরববিশ্বের বক্ষ বিদীর্ণ করে গড়ে ওঠা ইসরাইল আরেকটি ইরান বিপ্লবের আশংকায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এমনকি বিস্ময়করভাবে মুসলমানদের ক্বেবলার বৈশ্বিক দাবীদার এবং গর্বিত সংরক্ষক সৌদি আরব ‘আল্লাহ আকবর, আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি তুলে অগ্নিস্ফুলিংয়ে ফেটে পড়া বিপ্লবীদের পরিবর্তে স্বৈরশাসক মোবারকের প্রতিই সমর্থন পুনঃব্যক্ত করে যাচ্ছে।
ফারাওদের দেশ মিশর। সম্রাটদের দেশে গণবিপ্লব এ যেন এক বিস্মরকর অবিশ্বাস্য বিশ্ব ঘটনা। প্রসঙ্গত সারা আরব বিশ্বইে প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগের মতোই গণতন্ত্রের আদলে রাজতন্ত্র তথা প্রাচীন যুগীয় ফারাওদের আদলে শাসন ব্যবস্থা চলে আসছে। সেখানকার একেকজন রাষ্ট্রনায়ক একেকজন অঘোষিত ফারাও। এসময়কার ফারাও আর সেসময়কার ফারাওদের মধ্যে ব্যবধান শুধু আগেরকার ফারাওরা সরাসরি স্রষ্টার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। কিন্তু এসময়কার ফারাওদের সেই দুঃসাহস নেই। কিন্তু তারা জনগণের উপর তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে কখনো পিছপা হন না। তাদের মধ্যে আরেকটি দৃশ্যতঃ পার্থক্য হলো তাদের কারো গায়ে আরব্য পোষাক দেখা গেলেও অধিকাংশেরই গায়ে শোভা পায় পাশ্চত্যের পোষাক। আর তার মাধ্যমে তারা তাদের আসল প্রভুদের প্রতি দৈহিক ও আত্মিকভাবে সার্বক্ষণিক পরিশুদ্ধ আনুগত্যেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটান। আমার কাছে কেন যেন তাদের প্রায় জনেরই চেহারার মিলটা হিটলারের চেহারার সাথে মিলে যায়। হয়তো সেটা আমার ভ্রমও হতে পারে। আরব উপত্যকার এসব রাষ্ট্রপ্রধানদের বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ কোনো অংশের সাথে সেখানকার জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার কোনো মিল নেই। তবু তারা যুগের পর যুগ সেসব রাষ্ট্র এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন একমাত্র বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণের বিশ্বস্থ প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু শেষ বলে যে একটা কথা আছে, তারই প্রমাণ সাম্প্রতিককালের তিউনিসিয়া থেকে শুরু হওয়া গণভুত্থানের রেশ শেষ হতে না হতে মিশরের অগ্নিগর্ভা গণজাগরণের অবিশ্বাস্য গণবিপ্লব। যে গণবিপ্লবের প্রকাশ্য বিরোধীতা করার সাহস খোদ পরাশক্তিগুলোর পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না। তাইতো বাহ্যত হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তব্যে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মিশরের জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার মূল্যায়নের গুরুত্ব প্রাধান্য পেয়েছে।
তথাকথিক আধুনিক মিশরের জন্মদাতা জামাল আবদেল নাসেরের আমল থেকে মিশরের শহীদ হাসান আল বান্নার ইখওয়ানুল মুসলিম (বর্তমানে যা মুসলিম ব্রাদারহুড হিসেবে পরিচিত) একটি শক্তিশালি ও সুসংঘটিত রাজনৈক দল। শুধু ইসলামি মূলনীতির ধারক হওয়ার কারণে তারাতো ক্ষমতায় যেতে পারছেই না উপরোন্তু দলটির নেতৃত্বদানকারীরা চাপিয়ে দেয়া স্বৈরশাসকদের দ্বারা বার বার অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নানাভাবে। গণতান্ত্রিক পন্থায় যখন রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের পথরুদ্ধ হয়ে পড়ে তখন সেখানে বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের বিভিন্ন সময়ের বিপ্লবকে রুখে দাঁড়াতে সমর্থ হলেও তাদের নেতৃত্বে এবারকার সর্বসাধারণের সর্বাত্ম বিপ্লবকে আর রুখে দেবার কোনো পন্থা কাজ দেবে বলে মনে হয় না। জামাল আবদেল নাসেরের মৃত্যুর পর তারই প্রিয়ভাজন সেনাবাহিনীর লোক আনোয়ার সাদাত ক্ষতমতায় আরোহণ করেন। ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই আনোয়ার সাদাত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে আমেরিকার প্রতি সর্বাত্মক আনুগত্যের পাশাপাশি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানের খেসারত হিসেবে ১৯৮১ সালে সামরিক প্যারেড পরিদর্শনকালে আইন করে নিষিদ্ধকৃত রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদাহুডের হাতে নিহত হন। সেই থেকে আজকের হোসনী মোবারক দুর্দান্ত দাপটের সাথে প্রায় তিন দশক পূর্বসূরীদের অনুসরণে এবং আমেরিকানদের পূর্ণ সমর্থনে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে সমর্থ হলেও অবশেষে গণবিপ্লবের কাছে মাথা নত করতে হচ্ছে। কিন্তু তবুও দীর্ঘদিন থেকে বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারীরা প্রকৃত ক্ষমতার স্বাদ পাবেন কিনা তা এখন বুঝা যাচ্ছে না। কারণ ইতোপূর্বে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন হামাস গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা পেয়ে সেই ক্ষমতার মসনদে তারা আরোহরণ করতে পারেনি শুধুমাত্র পরাশক্তিদের অপচ্ছন্দের কারণে। তারও পূর্বে আলজেরিয়ার ইসলামি মুভমেন্টকে বৈদেশিক শক্তি এবং রাষ্ট্রযন্ত্র মিলে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। লেবাননের হিজবুল্লাদের স্বাধিকার আন্দোলনকেও বার বার দমিয়ে রাখা হচ্ছে। গণতন্ত্র কিংবা গণবিপ্লব কোনটাই কারো অধিকার আদায়ে যখন কার্যকর হয়না তখন তাদের আত্মহুতি ছাড়া আর কি উপায় থাকতে পারে! যার কারণেই হয়তো অব্যক্ত আক্রোশে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও অনাকাংখিত ঘটনার জন্ম হয় অহরহ। আর সন্ত্রাস দমনের নামে তাকে পূঁজি করেই চলতে থাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিধিবদ্ধকৃত সন্ত্রাস।
স্বতঃস্ফুর্ত এই গণজাগরনে প্রাণ বিসর্জনকারীদের স্বপ্নও যে শেষ পযন্ত বাস্তবায়িত হবে তারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মুসলিম রেনেসাঁর স্বর্ণযুগে শিক্ষাক্ষেত্রে স্পেনের কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ আলোটুকু ধারণ করে মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় যখন পূণর্বার ইসলামি শাশ্বত শিক্ষা ও সংস্কৃতিকর বিভা বিশ্বজুড়ে বিচ্ছুরণের চেষ্টা করছে, অসংখ্য স্কলারের জন্ম দিতে শুরু করেছে তখন মুসলিম পূণর্জাগরনে ভীত পরাশক্তিগুলোর সেদেশীয় দুসর তথা রাষ্ট্রনায়করা শক্ত হাতে তা দমিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। এসব শাসকরা কখনো সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কখনো আমেরিকার একনিষ্ট তাবেদারি করলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ট তথা মুসলিম জনগোষ্টির ক্ষতিই করেছে এবং তাদের নেতাদের উপর চালিত লোমহর্ষক নির্যাতনের ইতিহাস হালআমলের গোয়েন্তানামো বন্দিশালার নির্যাতনকেও হার মানায়। মিশরে সুগঠিত রাজনৈতিন দল বলতে বরাবরই ইখওয়ান তথা মুসলিম ব্রাদারহুডেরই নাম উচ্চারিত হয়ে আসছে। আজকের এই গণবিপ্লবের স্বার্থক সাহসিক নেতৃত্বের অগ্রভাগেও সেই মুসলিম ব্রাদারহুড। আর এ জন্যই আমেরিকা তথা বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর যতো মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রকাশ্য গণবিস্ফোরণকে তারা অস্বীকার করতে না পারলেও হোসনী মোবারকের পরিবর্তে তাদের বিশ্বস্থ স¦ার্থসংরক্ষক কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না বলেই বিপ্লবের সমাপ্তিতে এতো কালক্ষেপন হচ্ছে।
বিশ্ব নেতৃত্বের অদৃশ্য কারসাজিতে অলৌকিক কিছু না ঘটলে তিন দশকের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতন এখন ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে। মিশরের এ গণবিপ্লব সমগ্র আরব বিশ্বের গণজাগরনেরই বহিঃপ্রকাশ। এ বিপ্লবের যথাযথ সমাপ্তিই সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম অধ্যুষিত সমগ্র মধ্যএশিয়ার শান্তি-স্বস্থি, সমৃদ্ধি তথা স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার নবযাত্রা। তা না হলে পৃথিবী ধ্বংসের পূর্বাহ্নের মুসলিম পুনঃজাগরনের প্রহর পর্যন্ত তসবিহ হাতে প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে হবে বতর্মান বিশ্বে টেরোরিষ্ট জঙ্গি হিসেবে লেবেল এঁটে দেয়া বিশ্ব মুসলিমদের।
০১/০২/২০১১
লন্ডন।