আমার জানাযা হবে কবিতার অন্তিম মিছিলে'
‘আগুনে রেখেছি হাত’ এমন উত্তপ্ত বাক্যবানে যার কাব্যযাত্রা শুরু, সেই তিনি অন্তিম ইচ্ছাটিও শুনিয়ে দিলেন সূচনাতেই ‘আমার জানাযা হবে কবিতার অন্তিম মিছিলে’। প্রথম সাক্ষাতে সাদামাটা সাধারণ একজন মানুষই মনে হবে। আবার পরক্ষণেই ভুল ভেঙ্গে যাবে সাক্ষাতপ্রার্থীর। ‘জাফরীকাটা’ রোদের মতো বহুমাত্রিক কথার পসরা আর কবি ও কাব্য ভাবনার নানাবিধ প্রসঙ্গ-অনুসঙ্গ শোনে তন্ময় হবেন আগন্তুক যার সান্নিধ্যে তিনি কবি মোহাম্মদ সাদিক। এক বিকেলের সংক্ষিপ্ত আড্ডায় তার অসাধারণ বাগ্মিময়তায় আমাদেরতো তা-ই মনে হয়েছে। সময় তাড়া করছে অথচ তিনি বলে চলেছেন কবি ও কবিতার বিবর্তণ বিষয়ে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে অধুনালুপ্ত নাগরীলিপিসহ বাংলা সাহিত্যের ইতোবৃত্তি। ইতোমধ্যে অবশ্য এই কবি সিলেটী নাগরী লিপির উপর পিএইচডি সমাপ্ত করেছেন, প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থ। রবীন্দ্র-নজরুল কাব্যের রূপ-রহস্য থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশের অসামান্য কাব্যলাবণ্য এবং বাংলাদেশের প্রধানতম দুই কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের সাথে আড্ডার স্মৃতি-সান্নিধ্য কোনকিছুই বাদ পড়েনি তার বিশ্লেষণ থেকে। সম্প্রতি এক রৌদ্রজ্জ্বল বিকেলে কবি শাহনাজ সুলতানার ঘরে কবি মোহাম্মদ সাদিককে ঘিরে জমে ওঠে এক অভূতপূর্ব সাহিত্য আড্ডা।
সমাপ্তিহীন এক আড্ডার সূচনা :[/sb[/sb
সত্যি এ ছিলো এক ব্যতিক্রমী আড্ডা। যেখানে প্রচলিত নিয়মে কোনো সূচনা বা সমাপ্তি ছিলো না। পথ চলতে চলতে শুরু এবং বলা যায় একইভাবে সমাপ্তি। মধ্যেখানে অনেক কথা, অনেক স্মৃতির সরোদ বেজে ওঠে প্রসঙ্গ-অপ্রসঙ্গে। শুরুতেই শোনা গেল আশাবাদী কথা। তবে আড্ডার মধ্যমনির সরাসরি কণ্ঠে নয়। টিভির স্ক্রিনে। পূর্বে ধারণকৃত সাক্ষাৎকারের অংশটুকু ছয়টার সংবাদে প্রচারিত হচ্ছিল। বাংলা টিভির সংবাদ পাঠক নাজমুল হোসেইনের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভবিষ্যত সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ সাদিক বলেন, যতোদিন মায়া-মমতা, ভালোবাসা থাকবে ততোদিন সাহিত্য-সংস্কৃতির কদর থাকবে।
আড্ডাস্থল আমাদের বহু পরিচিত ইস্টহামের মার্কেট স্ট্রিট। ছয়টার আগেই অতিথিসহ আমরা গিয়ে পৌঁছলাম কবি শাহনাজ সুলতানার ঘরে। তখনো অন্য কেউ আসেননি। সন্ধ্যায় ‘মেম সাহেবে’ কবিকে ঘিরে রয়েছে আরেকটি অনুষ্ঠান। তাই সময়ের বেত্রাঘাতের কাছে আমাদের হার মানতেই হবে। অন্যদের অপেক্ষা না করেই মোহাম্মদ সাদিকের উদ্দেশ্যে কবি ও কাব্যভাবনা বিষয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে শুরু করলেন কবি ও কলামিস্ট ফরীদ আহমদ রেজা। উত্তরে নিজের কাব্যভাবনাসহ অন্যান্য কবিদের একের পর এক কবিতায় উদাহরণ দিয়ে চললেন মোহাম্মদ সাদিক। একরকম পিনপতন ছন্দমোহতার মধ্যে কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়েই আড্ডায় এসে যোগ দিলেন সাপ্তাহিক সুরমার সাহিত্য সম্পাদক আহমদ ময়েজ ও কবি শাহ শামীম আহমেদ। অতৎপর একে একে এসে যোগ দিলেন কবি মুজিবুল হক মনি, কবি তাবাসসুম ফেরদৌস, কবি ইকবাল হোসেন বুলবুল, কবি উদয় শঙ্কর দুর্জয় ও কবি শাহীন রশিদ। কবি বন্ধু শেখ আখলাক আহমেদ সেই সূচনা থেকেই সাথী হয়ে আছেন। কোনো রকম সমাপ্তি ছাড়াই এই আড্ডাস্থল ছেড়ে আমাদের ছুটতে হলো অন্য আড্ডায়, টেমসের তীর ঘেঁষে দাঁড়ানো আইল অব ডকের ‘মেম সাহেব’এ। উল্লেখ্য, কবি মোহাম্মদ সাদিক ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের সিনিয়র অফিসারদের প্রশিকক্ষণ কোর্সের ন্যাশনাল প্রোজেক্ট ডাইরেক্টর হিসেবে এক সংক্ষিপ্ত সফরে বৃটেনে এসেছিলেন।
কবি ও কবিতা বিষয়ক সাতকাহন :
সবার হয়ে সঞ্চালকের ভূমিকায় কবি ফরীদ আহমদ রেজার বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে কবি মোহাম্মদ সাদিক তার লেখালেখির খবর জানিয়ে বলেন, বর্তমানে ভিন্নধর্মী কবিতা লিখছেন ‘কেমন ভিন্ন?’ তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তা ঠিক অন্যদের চেয়ে ভিন্নতা নয়, আমাদের পূর্বেকার কবিতা থেকে ভিন্ন। তার মতে, গদ্য কবিতা লেখা কঠিন, তাই গদ্য কবিতা লিখতে ট্রায়ার্ট অনুভব করেন তিনি। তাছাড়া এ কবি আর মাত্রাবদ্ধও থাকতে চান না। তিনি মনে করেন, এতে করে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে অগ্রসর হতে হয়। ইচ্ছে মতো অগ্রসর হওয়ার তাগিদ থেকে তা আর করতে চান না বলে জানিয়ে দিলেন। তিনি আরো মনে করেন, মানুষ যেভাবে বলতে ভালবাসে সেভাবে বলা ভাল। তাই বলে কবিতায় যা ইচ্ছে তাই করলে তা কবিতা হবে কি? ফরিদ আহমদ রেজার এমন প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদ সাদিক রবীন্দ্র, জীবনানন্দসহ বিভিন্ন কবিদের উদাহরণ তুলে ধরলেন। দার্শনিক প্লেটোর কবি ও কবিতা বিষয়ক বিরূপতার কথা জানিয়ে বললেন ‘প্লেটোতো কবিদের রাষ্ট্র থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন। মধ্যখানে একটু পুরণ কেটে কবি বন্ধু আাখলাক বললেন, পবিত্র কোরআনে কবিদের নামে সুরা আছে কিন্তু ম্যাজেস্টেটদের নামেতো কোনো সুরা নেই। বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব এ কবি এক সময় ম্যাজেস্ট্রেট ছিলেন সেদিকেই সাংকেতিক জৌক করলেন তিনি।
আড্ডার সিংহভাগ আলোচনাই ছিলো কবিতা বিষয়ক। এবার আরেকটু এগিয়ে তিনি বললেন, কবিতা কী তা সংজ্ঞায়িত করা যায় না বলেই তা কবিতা। তবে যে কবিতা কারো হৃদয়েই দাগ কাটলো না তা কবিতা হবে কিভাবে? তার প্রতিত্তরে মোহাম্মদ সাদিক ত্রিশের দশকের কবি সুধীন দত্তের ‘পাঠকের আলস্যের জন্য কবিতাকে দুর্বোধ্য বলা যায়না’ দুর্বোধ্য বিষয়ক অভিযোগের এমন উদাহরণ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে পাঠককেও এগিয়ে আসতে হবে। এ কবির মতে, মাইকেল যে কারণে মহাকবি, লালনও সেই কারণে মহাকবি। এবার কাব্য জগতের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলেন ফরিদ আহমদ রেজা। ‘উত্তরাধুনিকতা যেহেতু আধুনিকার পরে তাই আমরা বলতে পারবো না উত্তরাধুনিকতার সূচনা’ সোজাসাপ্টা এমন উত্তর দিয়ে কবি মোহাম্মদ সাদিক বেশকিছু সংস্কৃত কবিতার উদাহরণ তোলে ধরলেন। পাশে বসা কবি বন্ধু আখলাক বলে উঠলেন ‘কবি কি সেই আলো যার উপস্থিতি ছাড়া আমরা কবিতা বুঝিনা?’ অতঃপর নিজেই বিভিন্নভাবে তার ব্যাখ্যা দিলেন। মধ্যখানে কবি আহমদ ময়েজ যোগ করলেন ‘কবিতাকে কবিতা দিয়েই বুঝতে হয়’।
কাব্য সমালোচনা ও কবিতার প্রকারভেদ :
অর্বাচিন কাব্য সমালোচকদের সম্পর্কে মোহাম্মদ সাদিক কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমি ঘটির জলে স্নান করিনি, সমুদ্রের জলে স্নান করেছি।’ এমন উদাহরণ তোলে ধরে বলেন, কথিত এসব সমালোচকের কাছে ভিড়তে আমরা সাহসই পাইনা। তার মতে, বাংলা কবিতার মূলধারা হলো বাউল, ফকিরী বা মরমী ধারা। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা করে বলেন, তিনিতো একধরণেন ফকির বা বাউল। লালনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে রবীন্দ্রনাথ কবি হয়ে উঠেছেন।
‘কবিতা নানা রকম’ এই সত্য স্বীকার করেই মোহাম্মদ সাদিক কবিতার প্রকারভেদ প্রসঙ্গে স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, কবিতা দু’রকম- সত্য কবিতা ও মিথ্য কবিতা। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, যে কবিতা জোর করে লেখা হয় তা-ই মিথ্যা কবিতা এবং সেই মিথ্যা কবিতাই আজকাল বেশী লেখা হচ্ছে। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন কবিদের নিরীক্ষার নামে সস্তা পরিচিতি পাবার কসরত সম্পর্কে বলেন, ‘যারা নতুন লিখবো, ব্যতিক্রম লিখবো’ ভাবছেন তারা আকাশকুসুম কল্পনা করছেন। কারণ মানুষ তার পূর্ব পুরুষদের ‘জীন’ বহন করে আসছে শুরু থেকে। এসম্পর্কে তার দ্ব্যার্থহীন ঘোষণা, আমি আমার পূর্ব পুরুষ কবিদের ধারাবাহিকতা বহন করছি। তিনি মনে করেন, যুক্তি যেখানে শেষ, উপলব্দির সেখানে শুরু।
কিছু কবির তথাকথিত নিরীক্ষা প্রবণতার জবাবে বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি আল মাহমুদের উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আল মাহমুদ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এক সভায় এসম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, প্রথম প্রথম সবাই এরকম নিরীক্ষা লেখে, তারপর কবিতায় ফিরে আসতে হয়।’ মোহাম্মদ সাদিকের মতে- কবিকে, কবিতাকে সনাক্ত করতে হবে। এখন কেউ কাউকে সনাক্ত করেনা।
কবিতা বিষয়ক অভিযোগ-অনুযোগ :
হাতে প্রচুর সময় থাকলে হয়তো কবি ও কবিতা সম্পর্কিত অনেককিছুই শোনা যেতো এ কবির কাছ থেকে। সময়ের কাছে অসহায় এ কবি তবু কবিতা বিষয়ক নানা কথা বলে চললেন। তার অভিযোগ, কবিতা এখন সঙ্গীহীন এবং সঙ্গী-সাথীহীন চললে যা হয় তাই হচ্ছে। কারণ কবিতা শুরু হয়েছিল তার সঙ্গী-সাথী- ঢোল, সুর, বাঁশি ইত্যাদি সাথে নিয়ে। মূলধারা তথা ফকিরীধারার কবি ও কবিতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি সব্যসাচী লেখক কবি শামসুল হকের ‘পরাণের গহীন ভিতরে’র উল্লেখ করে বলেন, তার কবিতা রক্ত ভেজা।
কবিদের মধুর মল্লযুদ্ধ এবং একটি দামী সিগারেট :
হাল আমলের বাংলা সাহিত্যের দুই পুরোধা কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। শামসুর রাহমান নিয়তির অমোঘ নিয়মের কাছে ধরা দিলেও এখনো সময় সায়হ্নে দাঁড়িয়ে আছেন আল মাহমুদ। এ দু’কবির যেমন আছে অতুলনীয় খ্যাতি, বন্ধু ও ভক্ত ভাগ্য তেমনি নিন্দুকেরও অভাব নেই। কবিতা দু’জনকে বন্ধু বানালেও ভিন্ন কাব্য ভাবনা, কবিতার স্টাইল-প্যাটার্ন এবং স্ব-স্ব বিশ্বাস দু’জনকেই নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ভিন্ন প্লাটফরমে। কাব্যে নগর জীবনের পরিপূর্ণ চিত্রায়ণে জনপ্রিয় এক নাগরিক কবি হয়ে উঠেন শামসুর রাহমান। অন্যদিকে, আল মাহমুদ চিরায়ত গ্রাম বাংলার বনেদি চিত্রায়ণ ও শব্দ চয়নের মাধ্যমে সংখ্যগরিষ্ট জনগোষ্টির কাছে হয়ে উঠেন জনপ্রিয়।
এক সময় পরিপূর্ণ শক্তিমত্তা ও সমান জনপ্রিয়তায় বাংলা সাহিত্যের শাসন করেছিলেন এ দুই বন্ধু কবি। তাদের দু’জনের এক সাহিত্য আড্ডার স্মৃতিচারণ করে কবি মোহাম্মদ সাদিক বলেন, কবি শামসুর রহমানের ৫০তম জন্মবার্ষিকী পালনের আয়োজন করেছিল কুমিল্লা সাহিত্য পরিষদ। সেখানে শামসুর রাহমানের সাথে আল মাহমুদ-সহ ঢাকার একঝাঁক কবি-সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। কবিতা বিষয়ক বাহাসের অংশ নিলেন এ দুই শীর্ষ কবি। প্রথমে শামসুর রহমান বললেন, আল মাহমুদ শুনলেন। তারপর আল মাহমুদ বললেন শামসুর রাহমান শুনলেন। অতঃপর দু’জনই একসাথে বলতে শুরু করলেন ...। এক পর্যায়ে শামসুর রাহমান থেমে গেলও আল মাহমুদ অনবরত বলেই চললেন। অবশেষে উত্তেজনার শীর্ষে উঠে আল মাহমুদ হাঁক দিয়ে বললেন ‘কই একটা দামী সিগারেট দাওতো’। চিন্তাভাবনা এবং রাজনৈতিক দর্শনের দিক দিয়ে দু’জন দু’ভূবনের বাসিন্দা হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তারা ছিলেন পরস্পর বন্ধু। আর এ ভিন্নতা এবং তাদের একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের সূত্র ধরে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদীরা সুযোগ পেলেই দু’জনের সামনে টেনে ধরতো বিদ্বেষের কালো পর্দা। এখনো থেমে নেই এই স্ববিরোধীদের নির্লজ্জতা। দু’জনের সান্নিধ্যে থেকে বেড়ে ওঠা কবি মোহাম্মদ সাদিক দু’জনের কবিতার প্রতি সমান সম্মান জানিয়ে বললেন কবিতার বিষয় উপকরণের দিক থেকে কবি আল মাহমুদই তার প্রিয় কবি।
বাঁশি বাজে দূরে, মোহনীয় সুরে :
ব্যস্ততা, ত্রস্ততার মাঝেও কিছুক্ষণ পর পর মোবাইলটি বেজে উঠছিলো মোহাম্মদ সাদিকের। কখনো ‘মেম সাহেব’ থেকে। কখনো বা অন্য কারো। এবার ফোন ধরতেই শোনা গেলো বাঁশির সুর। বাঁশির সুরে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেলেন কবি মোহাম্মদ সাদিকও। অপর প্রান্ত থেকে বাঁশির মোহনীয় সুর শুনিয়ে লন্ডনের অন্যতম সুন্দরপুরী লেইক ডিস্ট্রিকে বেরিয়ে যেতে অনুরোধ জানাচ্ছেন কবি টিএম কায়সার। তখন টিএম কায়সারের পাশে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক লুৎফুর রহমান। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হয়েছিলো পরদিন সেখানে যাওয়ার কিন্তু দূরত্ব ও সময়ের স্বল্পতাকে জয় করে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি তার।
‘এসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল’ :
সবার হাসিখুশি মুখাবয়ব আর মনোযোগ দেখে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, কবি মোহাম্মদ সাদিকের সাথে এটি ছিলো এক চৎমকার সন্ধ্যা। পরক্ষণেই প্রশ্ন জাগে- এসব আড্ডা, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করে কী লাভ? বিশেষ করে বিশ্বময় ক্রেডিট ক্র্যাঞ্চের এই দুঃসময়ে। তাছাড়া পারিপার্শ্বিক আরো কতোকিছুতো আছেই। এসবকে উড়িয়ে দিয়ে মোহাম্মদ সাদিক আশাবাদী হয়ে বলেন ‘এসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল’। তার প্রিয় কবি জীবনানন্দের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘খেয়া নৌকাগুলো ভীড়েছে তীরের খুব কাছে/ এসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল/ এসিরিয়া ধুলো আজ/ বেবিলন ছাই হয়ে আছে।’ শুধু তাই নয়, তার মতে - জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার মেন্যুফেস্টু। কাব্যসুকৃতির উদাহরণ দিতে কবি ফররুখ আহমদের কবিতার উদাহরণ তোলে ধরেন ‘পূবের আকাশে সূর্য উঠেছে দরবেশের হাসির মতো’।
‘ভালবাসা মরে যায়, মুগ্ধতা মরে না’:
কথা-বার্তায় প্রাণোজ্জ্বল এ কবি শুধু নিজেই বললেন না, শোনলেনও পরিপূর্ণ আগ্রহ নিয়ে। উপস্থিত আড্ডারু কবিদের কবিতা শোনে তার উপর আলোচনা করলেন আগ্রহী হয়ে। সবার অনুরোধে পড়ে শোনালেন তার কিছু নির্বাচিত কবিতা। তার স্মৃতি শক্তির প্রশংসা করতেই হয় কারণ বেশীর ভাগই স্মৃতি থেকে পড়লেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আগুনে রেখেছি হাত’ থেকে পড়ে শোনালেন বেশ ক’টি কবিতাসহ সর্বশেষ কবিতা ‘শেষ কবিতার শব্দাবলী’ যেখানে কবি তার কাব্যাকাঙক্ষা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমার জানাযা হবে কবিতার অন্তিম মিছিলে’। তাছাড়া অন্যরাও পড়লেন তার কবিতা। কবি শাহনাজ সুলতানা কালারফুল বিরানী, চটপটিসহ এটা ওটার আয়োজন করেছিলেন। সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে অথচ সেদিকে কারো তেমন ভ্র“ক্ষেপ নেই, সবাই অতিথির কথা ও কবিতা শোনায় ব্যস্ত। বলা যায় কোনকিছুই বাদ পড়লো না তার সংক্ষিপ্ত এবং সারগর্ভ কথা থেকে। তাকে নিয়ে আড্ডার আয়োজন করার জন্যে তিনি কবি ফরীদ আহমদ রেজাকে কৃতজ্ঞতা এবং বর্ণাঢ্য পরিবেশনার জন্য শাহনাজ সুলতানা-সহ উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মোহাম্মদ সাদিক সবার কবিতা শোনে তার অভিমত ব্যক্ত করে বলেন,‘আমার মনে হচ্ছে এগুলো পরিপক্ক কবিতার প্রতিনিধিত্ব করছে। কবিতার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকলেও এসব কবিতা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে। আড্ডাকে তিনি বাংলাদেশের যেকোনো আড্ডার চেয়ে অনিন্দ্য সুন্দর আখ্যায়িত করে বলেন, এই আড্ডা মিস করলে অনেককিছু মিস করতাম। তিনি এসমস্ত আড্ডায় বৃটিশ কবিদেরও সম্পৃক্ত করার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘এতে আমাদের আড্ডা আরো সমৃদ্ধ হবে। সাহিত্যের আড্ডার দরজা-জানালা সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা খুবই জরুরী। সব ভাষাভাষীদের সংমিশ্রণ করতে হবে। আর তা আপনারাই করতে পারেন। এভাবেই আমরা বিশ্ব জয় করতে পারবো। এর মাধ্যমে আরেকজন রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে থেকে বেরিয়ে আসুক।’ তিনি বিলেত প্রবাসী লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আসুন আমরা মানচিত্র বড় করি। ‘ভালবাসা মরে যায়, মুগ্ধতা মরে না’ উদ্ধৃত করে আড্ডা ভাললাগার ইঙ্গিত করে বলেন, এখানে এসে ভালোবাসা পেয়েছি, মুগ্ধতা পেয়েছি। হয়তো একদিন এই ভালবাসা মরে যাবে কিন্তু এই মুগ্ধতা মরবে না- এই বলে বক্তব্যে ইতি টানতে যাচ্ছিলেন তিনি, ঠিক তখন মুজিবুল হক মনি জানতে চাইলেন - আবার কখন আসবেন? উত্তরে বললেন, হয়তো এই বছরই আসতে পারি, হয়তো আর কখনো আসবো না। তৎক্ষণাত আহমদ ময়েজ ‘তোমাকে আসতেই হবে’ বলে গেয়ে উঠলেন, ‘যাইও না যাইও না সখারে ...’।
আড্ডা অন্যত্র :
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আড্ডার অঘোষিত সমাপ্তি টানতে হলো। কারণ আরেকদল অপেক্ষা করছেন ‘মেম সাহেব’এ। বার বার ফোন আসছে। কবি আহমদ ময়েজ এবং আমি দায়িত্ব নিলাম অতিথি কবিকে পৌঁছে দেয়ার। সেখানে পৌঁঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো। মোহাম্মদ সাদিক যেতে যেতে ভাবছিলেন হয়তো অপেক্ষা করে অনেকেই চলে গেছেন এবং সেজন্য এক ধরনের লজ্জাবোধে তাড়িত হচ্ছিলেন বার বার। কিন্তু না, টেমসের একেবারে তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ‘মেম সাহেব’র নিয়ন আলোয় ঢুকতেই দেখা গেলো সবই আছেন। কবিকে স্বাগত জানালেন ‘মেম সাহেব’র সত্ত্বাধিকারী, সংস্কৃতিকর্মী মৃদুল কান্তি দাশ। পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পর বিশিষ্ট লেখক ড. রেণু লুৎফা কবি মোহাম্মদ সাদিকের কাছে জানতে চাইলেন, কেমন কাটলো প্রথম আড্ডা। একদিকে আড্ডার মোহময়তা অন্যদিকে এখানে আসার তাড়া এ দু’টানার মধ্যে পরিপূর্ণরূপে কোনোটাই উপভোগ করতে না পারার আক্ষেপ ব্যক্ত করলেন। অন্যান্যের মধ্যে উপসিস্থত ছিলেন- সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী, সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা, সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম, বাংলা টিভি’র ফরহাদ হোসেন এবং নুরুল আমিন শিপু।
কবি মোহাম্মদ সাদিক কিংবা একজন ‘আলোর রাখাল’র
জীবনালেখ্য :
অন্ধকারে আলো ছড়ানো কিংবা তিমিরে হারিয়ে যাওয়া কোনোকিছু লোকচক্ষুর সামনে এনে দাঁড় করান যিনি তিনিতো আলোর রাখালই হবেন। এমন যুঁথসই উপমা তাকেই মানায়। শুধু রোমান্টিক কাব্যচর্চা নয় গভীর গবেষণার মাধ্যমে অধুনালুপ্ত সিলেটী নাগরী স্ক্রিপ্টকে গ্রন্থভূক্ত করে এক অসাধারণ কর্মযজ্ঞই সম্পাদন করেছেন মোহাম্মদ সাদিক। তার এ গবেষণা কর্মের জন্য আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৫ সালে তাকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। ‘সিলেটী নাগরী : ফকিরি ধারার ফসল’ নামকরণের গবেষণা গ্রন্থের ভূমিকায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য গবেষককে ‘আলোর রাখাল’ স’োধন করে যথার্থই লিখেছেন, ‘ডক্টর মোহাম্মদ সাদিকই তো অপরিমেয় ভালবাসায় ঐতিহ্যের দীপরক্ষী হয়ে জেগে আছেন। বিরল নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ে ফকিরি ধারার ফসল নিয়ে গবেষণা করে এবং তারপর বই প্রকাশ করেছেন, অন্ধকারের শেলতীব্র আক্রমণের মধ্যেও কেউ না কেউ আলোর রাখাল হয়ে সমকাল ও আসন্নকালের সহযাত্রীদের জন্যে শুশ্রƒষার বার্তা নিয়ে আসে।’ আড্ডার অন্যতম প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ফরীদ আহমদ রেজা মোহাম্মদ সাদিকের সদ্য প্রকাশিত এই গবেষণা গ্রন্থের লন্ডনে প্রকাশনার উৎসবের প্রস্তাব ব্যক্ত করে বলেন, সিলেটী নাগরী বিষয়ে জানার জন্য প্রয়াত গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলীর পর মোহাম্মদ সাদিক-ই এখন একমাত্র নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি।
কবি মোহাম্মদ সাদিকের জন্ম ১৯৫৫ সালে। হাওর-বাওর বেষ্টিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাউল-ফকিরের চারণভূমি, প্রকৃতিবধূ সুনামগঞ্জের ধারার গাঁয়ে। সেখানেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ চুকিয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে পড়াশোনা করেন ঢাকায়। তখন থেকেই কবিতার সঙ্গে তার বসবাস। শক্তিমান এ কবির এ যাবত কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ৬টি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আগুনে রেখেছি হাত’ বেরোয় ১৯৮৫ সালে। অতঃপর ১৯৮৭ সালে ‘তৃকালের স্বরলিপি’, ১৯৯১ সালে বিস্মিত বল্লম হাতে সমুদ্রের শব্দ শুনি’, ১৯৯৭ সালে ‘কাদের সিদ্দিকীর টুপি এবং অন্যান্য’, ২০০০ সালে তুমি না থাকলেও বৃষ্টিতো থাকবে’ এবং ২০০৬ সালে বেরোয় নির্বাচিত কবিতা। এছাড়াও নাইজেরিয়ান খ্যাতিমান লেখক চিনুয়া এচিবি’র উপন্যাস ূম ীমভথণর র্ই ঋট্রণ এর বঙ্গানুবাদ ‘নেই আর নীলাকাশ’ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য মোহাম্মদ সাদিকের পিতা আলহাজ্ব মোহাম্মদ মবশ্বির আলী এবং মা মরহুমা মাসতুরা বেগম। স্ত্রী জেসমিন আরা বেগম, পুত্র মোহাম্মদ কাজিম ইবনে সাদিক ও কন্যা মাসতুরা তাসনিম সুরমাকে নিয়ে তার সংসার।