আমার প্রথম বন্ধু, ইহুদী!
**********************
দেশ ছেড়ে আসার আগে আগে আমাকে দুটো বিরাট উপদেশ দেওয়া হল।
নাহ, কথাটি বোধ হয় একেবারে ঠিক না । আসলে একটি উপদেশ, অন্যটি উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। মজার ব্যাপার হল দুটির বিষয় কিন্তু অভিন্ন, বক্তব্য ঠিক বিপরীত। একটু খোলাসা করে বলি-
উপদেশটি আমার আম্মার কাছ থেকে। দেশ ছাড়ার আগের দুই সপ্তাহ রাজ্যের জিনিস রান্না করে রাখেন তিনি। যাবার আগে যেন সবই খাই। কিন্তু আমার ঠিক ওভাবে খাওয়া হয়ে ওঠে না। প্রতি রাতই অনেক দেরি করে ফিরি। কেনা- কাটা, ডাক্তার দেখানো, সহকর্মী-বন্ধুদের থেকে বিদায়, ইত্যাদি করতে করতেই ‘আমার বেলা যে যায় সাঁজ বেলাতে’। হয়তো অনেক রাতে বাড়ি ফিরছি। ফেরার পথে যেসব রেস্টুরেন্টের খাওয়া মিস করবো ভাবি, হুট করে সেসব দোকানে ঢুকে যাই। পেট পুড়ে খেয়ে ঢেঁকুর তোলার সময় আম্মার রান্নার কথা মনেও থাকে না। কিন্তু বাসায় ফেরার পর পড়ে যাই বিপদে। যখন দেখি তিনি আমার জন্য খাবার গরম করছেন, আমি ঠিক না করতে পারতাম না। তাঁর সামনে বসে ভাতের ঢেলা ডলতে ডলতে কথা বলতাম। যেন অনেকক্ষণ এভাবে বসে থাকলে আমার আবার খিদে পাবে। আর আমি পাতের খাবারটুকু ফিনিশ করে ফেলবো। সামনে বসে আম্মা আমার খাওয়া দেখতেন। একদিন বললেন, বিদেশ তো যাচ্ছিস, একটা কথা মনে রাখিস।
- কি কথা?
- ওখানে গিয়ে আর যে কারো সাথেই মিশিস না কেন, সাবধান ইহুদীদের সাথে যেন আবার মিশিস না।
- আচ্ছা মিশবো না। কিন্তু কেন?
- এদের বিশ্বাস করতে নেই। দেখিস না, সারা দুনিয়াতে ওরা কিভাবে মুসলমান মেরে চলছে? আমাদের ধর্মেও তো এদের সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে।
- কিন্তু আম্মা, এখন পৃথিবীতে যত মুসলমান মারা হচ্ছে তা তো মুসলমানরাই মারছে। আর তাছাড়া আমাদের ধর্মের আদলটা কিন্তু ওদের থেকে খুব আলাদা কিছু না। অনেক দিক দিয়ে মিলও আছে। ওদের ধর্মের অনেক কিছু আমরাও ধার করেছি।
- অতো কথা বুঝি না, বাবা। আমার উপদেশটা মনে রাখিস।
মাতৃভক্ত বায়েজিদ বোস্তামীর মতো আমি বললাম, আচ্ছা মনে থাকবে। যদিও আম্মাকে দেওয়া কোন কথাই আমি ইহ-জনমে রাখিনি। এবারও তাই হল। সে কথা একটু পরে বলছি।
সে রাতে নিয়াজ ভাই ফোন করলেন, চলে তো যাবেনই। ছাদে আসেন। এমন পূর্ণিমা ওখানে কি পাবেন? আসেন আসেন। দুজনে মিলে চা খাই আর জ্যোৎস্না দেখি।
নিয়াজ ভাই একজন নগর-পরিকল্পনাবিদ এবং আমাদের ছয়তলায় থাকেন। চা খেতে খেতে আমাদের অনেক কথা হয়। সিগারেটের ধোঁয়া উপরে ছাড়তে ছাড়তে নিয়াজ ভাই বলেন, কদিন ধরেই আপনাকে নিয়ে আমার একটা উপলব্ধি হচ্ছে। রোজ ভাবি বলবো, কিন্তু ভুলে যাই।
- কি উপলব্ধি?
- আমার কেন জানি মনে হয় অ্যামেরিকায় আপনার তেমন কোন বন্ধু হবে না।
- তাই নাকি? এ তো বিপদের কথা। কোথায় পড়ে থাকবো, কিন্তু বন্ধুই যদি না পাই তাহলে তো মহা ফ্যাসাদ!
- যদিও বা হয় তবে সে হবে একজন ইহুদী।
আমি চমকে উঠলাম। আজই না আম্মা ঠিক উল্টো উপদেশ দিলেন! আমি পরিবেশ হালকা করার জন্য বলি, কি যে বলেন না। আমি যাচ্ছি সাউথ ক্যারলাইনায়। ওখানে তো সব আফ্রিকান-অ্যামেরিকান। আমি ঐ লোকদের কোথায় পাবো? শুনেছি ইহুদীরা নাকি সব সাদা হয়।
- তা বলতে পারি না। আমার মনে হল, তাই বললাম। এটা আমার পোয়েটিক সোল বলছে। যুক্তি দেখাতে পারবো না।
অরেঞ্জবার্গের দুরুমের বাসা ভাড়া নেয়া হল। সামনে প্রকাণ্ড একটা মাঠ। সেটি আসলে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের খোলা অংশ। এক পাক দিলেই এক কিলোমিটার ( তখনো মাইলের হিসেবে অভ্যস্ত হইনি) শেষ। আমাদের বাসার মতোই আরও চার-পাঁচটা টুইন-শেয়ারিং টাউন হোম এপার্টমেন্ট রয়েছে কম্পাউন্ডে। বউ-বাচ্চা কেউ সারাদিন বাসায় থাকে না । আমার কাজ হল সকাল-বিকাল সে মাঠের চারদিকে চক্কর দেওয়া। কিন্তু সে কাজ কতো আর করা যায়। বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম। একদিন তাই স্ত্রী-কে না জানিয়ে মেয়েদের সাথে একটা ষড়যন্ত্র করে বসলাম। প্রতি শুক্রবার রাত যেন চাঁদ রাত। বাচ্চারা এসে স্কুল ব্যাগ ছুড়ে ফেলে। জুতো-জামা পড়ে থাকে যত্রতত্র। ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সও বের করে না। খাওয়া-ঘুমানোর কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কোন বাড়ির কাজ নেই। দুদিনের স্বাধীনতায় তাই তাদের অপার আনন্দ। সেই রকম কোন এক শুক্রবার সন্ধ্যায় আমি তাদের ঘরে গিয়ে ঘোষণা করি, আমি তোমাদের জন্য একটা জিনিস অর্ডার দিয়েছি। কিন্তু শর্ত হল তোমাদের মাকে ওটা বলা যাবে না। তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই।
- কি অর্ডার দিয়েছ?
- একটা এলসিডি টেলিভিশন।
বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার দিলো, হুড়রে। উল্লাস ধ্বনি এতটাই জোরে হল যে নিচ থেকে তাদের মা দৌড়ে এসে জানতে চায়, কি হল? চিৎকার করলে কেন?
শর্তমতে এই কথা তাকে বলা যাবে না।তাই বড় মেয়ে বলল, কিছু না এমনি।
সে সত্য ঐ রাতে গোপন থাকলেও পরদিন সকালেই তা ফাঁস হয়ে গেলো। খুব সকালে ক্লাসে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি। এখানে এসে মধ্যবয়সে আবার পড়াশোনা শুরু করেছি। হঠাৎ দরজায় টোকা। এতো সকালে আবার কে এলো! এখানে তো কেউ বিশেষ আসে না! দরজা খুলে দেখি বাড়িওয়ালা। চমকে উঠে জানতে চাই, কি ব্যাপার?
এদের ভদ্রতা রূপকথাকেও হার মানায়। প্রাথমিক ভদ্রতার পর জানতে চায়, তোমার বাসায় কি গত রাতে কোন সমস্যা হয়েছে?
আমি বলি, কই নাতো? কেন বলতো?
বাড়িওয়ালা বলে, গত রাতে নাকি অনেক হট্টগোল হয়েছে! তোমার পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা অভিযোগ করেছে। কাল রাতেই টেক্সট পেলাম ওর। কি হয়েছিলো বল তো। সে আমার একজন অত্যন্ত ভালো ভাড়াটে।
এমন ভাব যেন আমরা মন্দ ভাড়াটে। বললাম, দেখো আমি আমার মেয়েদেরকে একটা জিনিস কিনে দিবো বলেছিলাম। শুনে ওরা এতটাই খুশি হয়েছিলো যে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ফেলেছে। আমরা দুঃখিত এমন অসুবিধার জন্য।
মনে হল না লোকটি একটুও নরম হয়েছে। বলল, দেখো ঐ মহিলা একজন নার্স। আমার অনেক দিনের পুরনো ভাড়াটে। তাকে প্রায় বারো ঘণ্টা একনাগারে কাজ করতে হয়। তাই তাকে খুব সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হয়। আবার তার ইন্সম্নিয়া আছে। একবার ঘুম ভাঙলে আর কিছুতেই ঘুমোতে পারে না। আশা করি তোমরা বুঝবে বিষয়টি।
- কিন্তু ওটা তো তেমন রাতে ঘটে নি! সন্ধে বেলার ঘটনা, তাও আবার শুক্রবার।
- সে যাই হোক, এমনটি আবার হলে তোমাদেরকে বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। বাই দ্য ওয়ে, মেয়েদের জন্য কি কিনে দিবে?
ততক্ষণে আমার স্ত্রী পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কথাটি আর গোপন করা গেলো না।
বললাম, একটা টিভি।
এরপরের পরিস্থিতি বেশ ভয়াবহ। আমার স্ত্রী ক্রমেই অসস্থ হয়ে পড়লো। দুটো কারণে তার এই ব্যারাম। প্রথম কারণ, আমরা তিনজন মিলে তার কাছে কিছু একটা গোপন করেছি। কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না এটা তাকে সারপ্রাইজ করার জন্যই। কিন্তু সে সেটা বুঝতে চাইলো না। উল্টা বলতে থাকলো, বাজারের ফর্দে টান পড়েছে। জমানো টাকা তলানিতে ঠেকেছে। আর উনারা কিনছেন টিভি!
দীর্ঘ প্রবাস জীবন আমাদেরকে কিছু মনঃব্যাধি উপহার দেয়। এটাও কি তাই? কিন্তু তা কি করে হয়? আমরা তো সবে এলাম। এখনই যদি এমনটি হয় তবে দূর-ভবিষ্যতের অবস্থা কী হবে? সেকথা কল্পনা করে আমি শিউড়ে উঠি। তবে কি সে রোগ আমাকেও ধরেছে?
দ্বিতীয় কারণটি আরও ভয়াবহ। বাড়িওয়ালা শাসিয়ে গেছে। এমন কোন শোরগোল আবার হলে বাড়ি থেকে সোজা বের করে দেবে। সেটি তার চরম অপমানে লেগেছে। সে কিছুতেই এটা নিতে পারছিল না। তার অবস্থা হিস্টিরিয়া রোগীর মতো হলো। কারণে অকারণে চমকে ওঠে। কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। অল্প কজন যাও বা বাঙালি এখানে আছে প্রায় প্রতি সপ্তাহে তাদের বাসায় দাওয়াত থাকে। সেখানে যাওয়াও বন্ধ করে দিলো। সাদা কোন লোক দেখলেই চমকে ওঠে। সঙ্কুচিত বোধ করে। বলা বাহুল্য, আমাদের ল্যান্ডলর্ড এবং পাশের এপার্টমেন্টের বাসিন্দা দুজনই শ্বেত-অ্যামেরিকান।
সে অস্বস্তি আমাদেরকেও আক্রান্ত করে বসে। সমগ্র সাদা চামড়ার লোকদের কিছুটা ভীতির চোখে দেখতে শুরু করে দিলাম। সামনাসামনি কেউ পড়ে গেলে এড়িয়ে যাই। শেষে না আবার কোন ফ্যাসাদে পড়ি। শুনেছি, দক্ষিনের এই স্টেটগুলো নাকি গোঁড়া বর্ণবাদী রেড-নেকদের আখড়া। কি মুশকিল, কোথায় এসে পড়লাম। তবে যে এতকাল শুনেছি যুক্তরাষ্ট্র সকল ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে!সেকি তাহলে বুজরুকি?
মনের দুঃখে আমি একা একা লো-ভলিউমে টিভি দেখি আর সকাল-বিকাল হাঁটি। দুবারের বদলে এখন আমি তিনবার হাঁটি। তবু আমার অস্বস্তি দূর হয় না। একদিন একটা কাণ্ড হল। সেদিনও দ্বিতীয় দফা হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতেই লক্ষ্য করলাম, একটি লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এক ঝলক দেখেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। খুব ভালো করে খেয়াল না করলেও এটা ঠিকই বুঝলাম লোকটি একজন সাদা চামড়ার অ্যামেরিকান। সুতরাং এড়িয়ে চলতে হবে। এদের বিশ্বাস নেই। শেষে আবার কিসে ফেঁসে যাই। কিন্তু এড়াতে পারলাম না। লোকটি ডেকে বসলো, হাই দেয়ার। গুড আফটার নুন।
উত্তর না দেওয়ার মতো অতটা অভদ্র আমি নই। তাই ছোট্ট উত্তর দিয়ে কথা শেষ করতে চাইলাম, আফটার নুন।
- তোমাকে আমি গত দুদিন ধরে লক্ষ্য করছি। আমি আরথার। আরথার ডবরিন। তোমাদের এখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সেমিস্টারের পরিদর্শক শিক্ষক (ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি)। তুমি হাঁটছ দেখে বেরিয়ে এলাম। আমারও হাঁটার অভ্যাস। কিন্তু একা একা হাঁটা খুবই বিরক্তিকর, কি বল। হা হা হা।
তাঁর বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত মিলিয়ে নিজের পরিচয় দেবার সময় বলি, আমার স্ত্রীও তো ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে।
কিছুক্ষণ পাশাপাশি হেঁটেই বুঝলাম, এই লোকটিকে আর যাই হোক ভয় করা যায় না। নিউ ইয়র্কের হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। লং আইল্যান্ডের বাসিন্দা। এখানে মাস চারেক থাকবেন। খণ্ডকালীন বসবাসের জন্য তাঁকে আমাদের কম্পাউন্ডের একটি বাসা দেয়া হয়েছে। ভদ্রলোকের বয়স সত্তুরের কাছাকাছি, তার মানে প্রায় আমার আব্বার বয়সী। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, ছয় ফুটের মতো লম্বা। ছিপছিপে লোকটিকে এক কথায় সুপুরুষ বলা যায়।
সন্ধ্যায় বিবিকে বললাম, আজ এক লোকের সাথে পরিচয় হল। নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে এই সেমিস্টারে ইথিক্সের ভিজিটিং প্রফেসর। আমাদের পাশেই থাকেন।
- অ।
তার শীতল ভাবটি এখনো যায় নি। একদিনের জন্যও সদ্যক্রিত টিভি দেখেনি। যেন ওটি তার চোখের বালি। বুঝলাম, এ বরফ সহজে গলবে না। ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে?’ সে চেষ্টাও আমি করি না। রিমোটে মনোযোগী হয়ে উঠি। আমাদের মধ্যকার অদৃশ্য দূরত্ব স্থির হয়ে থাকে।
আমি আর ডক্টর আরথার সকালবেলায় নিয়মিত হাঁটি। জানতে পারি, তিনি পড়ালেখা শেষ করার পর পিস কর্পের সদস্য হয়ে ১৯৬৫ সালে কেনিয়া যান। সেখানে দুই বছর কাজ করেন। সাথে ছিলেন তাঁর নববধু, লীন ডবরিন। যখন আর সব অ্যামেরিকান নবদম্পতি হাওয়াই কিম্বা কি-ওয়েস্টে হানিমুনে যায় তাঁরা তখন পাড়ি জমায় কালোদের আফ্রিকায়। কিসিই ডিসট্রিক্টের শিক্ষা বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি। বি. এ. অনার্স ক্লাসে তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল ‘অ্যামেরিকার কালো ইহুদী’। শুনে আমি কিছুটা অবাক হই, কালো ইহুদীও তাহলে আছে?
পরের রবিবার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। হাঁটতে না গিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করছি। দরজায় বেল। আমি তবুও উঠলাম না। হঠাৎ আমার স্ত্রী দৌড়ে এসে বলল, একটা সাদা লোক দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখি তার চোখ মুখ ভয়ে সাদা । আমি উঠে দরজা খুলে দেখি, ড. আরথার।
- তোমাকে আজ হাঁটতে না দেখে ভাবলাম একটু খোঁজ নিই।
নিউইয়র্কের এক শিক্ষক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছে- বউকে আমি এ কথা বলেছি। তবে তাঁর গায়ের রঙ সাদা কি কালো তা বলিনি। আর তাতেই ওর এই ভ্রান্তি। ড. আরথারকে ভিতরে আসতে বলে আমার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। বলি, আপনি একটু বসুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ফিরে এসে আমি তো অবাক। দেখি, আমার মেয়েরা ড. আরথারের সামনে গোল হয়ে বসেছে। তাদের মা রান্না ঘরে চা চড়িয়েছে। খাবার টেবিলে হালকা ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে। সবাই মিলে নাস্তা করার পর হাঁটতে বের হলাম। মজার ব্যাপার হল, বাচ্চাদের মাও দলে যোগ দিয়েছ। দুজনে অনেক গল্প করছে। তাদের পেছন পেছন হাঁটতে গিয়ে আমি লক্ষ্য করি, তার আর সাদা অ্যামেরিকান ভীতি কাজ করছে না।
এর পরের ক’মাস আমাদের দারুণ কাটে। প্রায় প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায়ই ড. আরথারের আমাদের বাসায় দাওয়াত থাকে। কিম্বা আমরা যাই। আমার স্ত্রী সবে রান্না করতে শিখেছে। বাঙালি রান্নার যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব চলতে থাকে তাঁর উপর। উনি সেসব খান আর বেশুমার প্রশংসা করেন। জানতে চান কি কি উপকরণ দেয়া হয়েছে তাতে। তারপর তাঁর স্ত্রীকে তা জানিয়েও দেন। লীন তখন নিউইয়র্কে। ওদিক থেকে লীন জানায় কি কি ঘটছে ওদের প্রতিবেশে। ওদের পোষা বিড়ালটি তাঁকে কেমন মিস করছে, কি হল মডার্ন ফ্যামিলির এই পর্বে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিড়ালের কথা শুনে ড. আরথারের চোখ ছলছল করে ওঠে। জানতে পারি, কেনিয়া থেকে এক মহিলা দুই মেয়ে নিয়ে তাঁদের বাসায় উঠেছে। স্বামীর নির্যাতনের ভয়ে সে আর দেশে ফিরতে চায় না। এখন তাঁদের লং আইল্যান্ডের বাসায় আশ্রিত।
মডার্ন ফ্যামিলি সিরিজটি উনার পছন্দ। অথচ টেলিভিশনের অভাবে দেখতে পারছেন না! তাই কি হয় নাকি? আমার স্ত্রী তাঁকে দাওয়াত দিয়ে বসে। চলতে থাকে সে শো দেখা। আমি দেখি, আমার স্ত্রীকে তিনি ওটির প্লটটি সংক্ষেপে বলছেন। তাঁর সাথে বসে বসে সেও দেখে শো-টি। টিভি বিদ্বেষ ভাবটি আর চোখে পড়ে না। এটাও বললেন, এই সিরিজের পরিবারের মতোই তাঁর পরিবার। তিন ছেলে মেয়ের বাইরেও তাঁদের আরও একটি মেয়ে আছে যাকে কিনা তাঁরা দত্তক নিয়েছেন। সে সন্তান কিন্তু কোন সাদা অ্যামেরিকান না, একজন আফ্রিকান- অ্যামেরিকান। আমি চমকে উঠি। আমার চমক তখনো শেষ হয়নি। একদিন খেতে খেতে ধর্ম নিয়ে কথা হচ্ছিলো। শুনি উনি বলছেন, ইহুদী পরিবারে জন্ম হলেও তিনি আসলে একজন হিউমেনিস্ট। মানে মানবতাবাদী। তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি ধর্ম চর্চা করেন না কিম্বা বিশ্বাস করেন না। ধর্ম চর্চা না করলেও জন্মসূত্রে তো তিনি একজন ইহুদী! এখন কি এঁর সাথে আমি সম্পর্ক ভেঙে দিবো? কই, উনাকে তো মোটেই ভয়ংকর মনে হচ্ছে না। বুঝতে পারি, আম্মাকে দেওয়া ওয়াদা শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের মাঝে এই বিষয়গুলো আর কিছুই মানে রাখে না। তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন আমাদের পরিবারের প্রথম বন্ধু, একজন ইহুদী। কাবুলিওয়ালার মতো তিনি আমার দরজায় টোকা দিয়ে বলেন, আজ হাঁটবে না? কই তোমাদের তো দেখলাম না!
ড. আরথার আমাকে হয়তো নিয়ে গেছেন কাছাকাছি কোন পিক্যান ইন্ডাস্ট্রিতে, কিম্বা আধুনিক কোন লাইব্রেরিতে। পিয়ানোতে আমার বাচ্চাদের বাজিয়ে শুনিয়েছেন সাউন্ড অফ মিউজিকের গান। আমার স্ত্রীকে শিখিয়েছেন কোন একটি অ্যামেরিকান ডিশ, অথবা হাঁটতে হাঁটতে বলেছেন আমাদের চারপাশের অসঙ্গতির গল্প। যেমন তিনি একদিন বললেন, তুমি কি দেখেছো তোমার পাশে প্রাইভেট স্কুলটিতে একটিও কালো শিশু নেই? সব সাদা অথবা এশিয়ান। প্রাইভেট স্কুলে পড়াতে কিন্তু মেলা টাকা দরকার। ভেবো না যে এরা সব সাদা বড়লোকের সন্তান। সামান্য সঙ্গতি থাকলেই সন্তানদের এরা সরকারি স্কুলে পাঠাবে না। কারণ, ওখানে তো সব কালো। বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের মজ্জায় প্রোথিত। এ থেকে মুক্তির উপায় নেই।
আমি চমকে উঠি। একজন সাদা অ্যামেরিকান বলছে এই কথা! তার উপর একজন ইহুদী! একদিন তাঁকে পাশের এপার্টমেন্টের শ্বেতাঙ্গ মহিলার কথা বললাম। পুরো গল্প শুনে তিনি বললেন, এটা রেসিজমের একটা উত্তম উদাহরণ। আর এটা আমি ইথিক্সের প্রফেসার হিসেবেই বলছি। ঐ মহিলা কিছুতেই বাড়ি ওয়ালাকে এই অভিযোগ করতে পারে না। বড়জোর সে পুলিশে খবর দিতে পারতো। কিন্তু সেটা সে করবে না। কারণ, সে ভালো করেই জানে ঐ অভিযোগ ধোপেই টিকবে না।
ইশ ড. আরথার আর কটা দিন আগে কেন এখানে এলেন না? তাহলে অমন হেনস্থা হতে হতো না। অথবা তিনিই কেন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী হলেন না?
দেখতে দেখতে তাঁর ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে এলো। তাঁর স্ত্রী লীন ডবরিন এসেছেন। ফুড ক্রিটিক লীন আশেপাশের শহরের বেশ কিছু রেস্তোরাঁয় গিয়েছেন। বিষয়টি আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। তারপর ওদের খাবারের উপর প্রতিবেদন লিখেন তিনি। সে প্রতিবেদন আবার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা কিম্বা ব্লগে প্রকাশিত হয়। চলে যাবার আগের দিন রাতে আমাদের সাথে ওঁদের ডিনার। জানা হল আরথার আর লীনের বিয়ের গল্প। সে ভারী মজার গল্প, যেন চলচ্চিত্র। সে কথা বললে এ লেখা দীর্ঘায়িতই হবে, তাই সে গল্প না হয় আরেকদিন। পরদিন খুব ভোরে চলে যাবেন বলে আর বসলেন না। জিনিসপত্র আগেই গাড়িতে ওঠানো শেষ। সকাল সাড়ে চারটায় রওনা।
সে রাতে কেন জানি আমার ঘুম আসে নি। প্রায় সারারাত এপাশ-ওপাশ করেই কাটালাম। হঠাৎ দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ভোর সাড়ে চার। ডবরিন দম্পতি কি চলে গেলো নাকি? বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখি গাড়ির দরজার সামনে ওঁরা দাঁড়িয়ে, এখনো ওঠেন নি। আমাকে দেখেই আরথার বললেন, ভাবছিলাম তোমাকে ডেকে বলে যাবো কিনা। কিন্তু অস্বস্তি কাজ করছিলো। এতো সকালে বুঝি কাউকে ডাকা ঠিক না। অথচ দেখো, তুমি ঠিকই টের পেলে। হয়তো বন্ধু বলেই এমনটা হল। তোমাদেরকে সারা জীবন মনে থাকবে। অরেঞ্জবার্গের স্মৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে থাকবে তোমরা। বিদায় বন্ধু।
অমন গরমের রাতেও আমার কেমন যেন শীত শীত লাগছিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। ঘরে এসে এই প্রথম নিজেকে নির্বান্ধব মনে হতে থাকে।
এরপর একটি ছোট্ট ঘটনা ঘটে। পাশের বাসার সেই শ্বেতাঙ্গ মহিলাটি বাসা ছেড়ে আরথারের খালি হয়ে যাওয়া বাসায় উঠে গেলো। আমাদের পাশে এলো একটি পরিবার। প্রথম দিন এসেই পরিচিত হল। সপ্তাহ খানেকের মাঝেই বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। ব্যাক ইয়ার্ডে বার-বি-কিউ করার সময় আমাদের প্রায়ই ডাকে। তখন ওঁদের রেডিও-তে গান বাজে। বার-বি-কিউ’র পোড়া মাংসের ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আমাকে এখন আর লো-ভলিউমে টিভি দেখতে হয় না। বাড়িওয়ালা আমাকে দেখলেই ইদানীং বেশ সমাদর করে। দেখা হলেই কোন কারণ ছাড়াই বলতে থাকে, ভেরি নাইস ফ্যামিলি, ভেরি ডিসেন্ট ফ্যামিলি। তাঁর এই পরিবর্তনের হেতু খুঁজে পাই না। কল্পনাপ্রবণ মনে মাঝে মাঝে ভাবি, তবে কি ড. আরথার যাবার আগে বাড়িওয়ালাকে কানে কানে কোন মন্ত্র দিয়ে গেছে? কে জানে, হবে হয়তো। ইহুদী বলে কথা!
********
অরেঞ্জবার্গ, সাউথ ক্যারলাইনা থেকে
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৮:০৮