ভারত-পাকিস্তানের সামরিক নিরাপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা বিষয়ে লেখাটির প্রথম পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। দ্বিতীয় পর্বের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী বুধবার পর্যন্ত। লেখাটি শেষ হবে তিন পর্বে। লেখার শেষে কয়েকটি লিংকও দেয়া হয়েছে।
নতুন মেরুকরণের দিকে এগুচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলের প্রধান শক্তি ভারতের সঙ্গে বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উষ্ণতাই এ মেরুকরণের সূচনা ঘটাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন তাদের বিশস্ত মিত্র পাকিস্তানের ওপর ভর করে এ অঞ্চলে কর্মকা পরিচালনা করলেও সম্প্রতি তারা ভারতের সঙ্গেও কার্যকর একটা ঐক্যে পৌঁছানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারত তার জন্মলগ্ন থেকেই মার্কিনবিরোধী ব্লকের অংশ। কিন্তু ’৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিনের সঙ্গে মিত্রতার একটা প্রচ্ছন্ন নীতি তারা গ্রহণ করে। যা গত কয়েক বছরে চরমভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এটা বেশ দ্রুততার সঙ্গে পরিণতির দিকে এগুচ্ছে। এদিকে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক অগ্রগতি এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। দক্ষিণ এশিয়ার পৌঁনে দু’শ কোটি জনসংখ্যা চীনের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করছে। ইতোমধ্যে তারা এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রগতিও ঘটিয়েছে। চীনা পণ্যে ছেয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ বাজার। চীন তার পুঁজির নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটা খুবই স্বাভাবিক। আবার এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতও তার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সবকিছুকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে চীন ও ভারত উভয়েই। বিশ্ব পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অবস্থায় বসে থাকতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে চীন ও ভারতের মধ্যে ভারতকেই সে বু হিসেবে কাছে পেতে চাইছে। দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপরিসীম। সে তার ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের এক তোলাও ছেড়ে দিতে চাইছে না। নতুন কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-পাকিস্তান সংযোগ
যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় বিশেষত এই অঞ্চলে ভারতকে কেন্দ্র ধরেই কাজ করছে দীর্ঘদিন। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরানের বিরুদ্ধে ভারতকে দেখতে চায়। চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চায় ভারতকে। ভারতকে তাই সামরিক আর অর্থনৈতিক সবদিক থেকে তার বলীয়ান করা দরকার। আবার অন্যদিকে প্রয়োজনে ভারতকে সামাল দেয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর নানাভাবে আছর করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দেশ ভারতের শাসক শ্রেণীর মধ্যে এখন সুপারপাওয়ার হবার সাধ তৈরি হয়েছে। শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ভারতে। অথচ সেই দেশের অবস্থান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনীর স্থানে। সেই দেশ পারমাণবিক শক্তি ধারণ করে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করে সেই দেশ প্রবেশ করেছে ‘পারমাণবিক ক্লাবে’র মধ্যে। পাকিস্তানও এইদিক থেকে পিছিয়ে নেই। দারিদ্র্য আর সংঘাতক্লিষ্ট এই আরেক দেশ যেখানে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সেনাবাহিনীর বাস। এই চতুর্থ ও ষষ্ঠ বৃহত্তম সেনাবাহিনী কী করে? তারা বছরের পর বছর নতুন নতুন অস্ত্র কিনে বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্য চাঙ্গা রাখে।
ভারতের অস্ত্রশস্ত্র অর্ধেকই সেকেলে
ভারতের প্রতিরক্ষার অস্ত্র ও সাজসরঞ্জামের অর্ধেকই সেকেলে ও মেয়াদোত্তীর্ণ। মাত্র ১৫ শতাংশ যুগোপযোগী। ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগের কনসালটেন্সি ফার্ম কেপিএমজি এবং ‘কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি’র এক প্রতিবেদনে অতিসম্প্রতি এ কথা বলা হয়। এতে বলা হয়, এ চিত্র জঙ্গি তৎপরতা ও সহিংসতাপূর্ণ এ অঞ্চলে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির ঘাটতিকেই স্পষ্ট করে তুলেছে। মুম্বাই ২০০৮ সালে সন্ত্রাসী হামলায় ১৬৬ জন নিহতের পর গত বছর নয়াদিল্লি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ-সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন করে। মুম্বাই হামলা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ফাঁকফোকর স্পষ্ট করে তুলেছিল। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি মুম্বাই হামলার পর দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নতির দিকে জোর-মনোযোগ দেয়ার কথা বলেন। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুগোপযোগী সরঞ্জাম তৈরি করার জন্য সরকারের সাহায্য করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। সরকার জানিয়েছে, তারা পাকিস্তান এবং চীনের সম্ভাব্য হুমকি থেকে সুরক্ষায় সোভিয়েত আমলের অস্ত্রগুলোর আধুনিকায়ন করবে। ত্রম্নটিপূর্ণ হয়ে পড়ায় ১৯৯০ সাল থেকে ভারত প্রায় ২০০টি রাশিয়ার নির্মিত মিগ জঙ্গিবিমান ব্যবহার করতে পারছে না। ভারত চাইছে তাদের বিমানবাহিনীর শক্তি আরো বাড়াতে। ২০২০ সালের মধ্যে তারা বিমানবাহিনীকে ৩৪ স্কোয়াড্রন (৬১২টি জঙ্গি বিমান) থেকে ৪২ স্কোয়াড্রনে (৭৫৬টি জঙ্গি বিমান) উন্নীত করতে চাইছে। সেই সঙ্গে সামরিক বাহিনীরও জরুরি কিছু নতুন অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। ১৯৮৬ সালে হাউইৎজার কামান কেনার পর সামরিক বাহিনীর জন্য আর কোনো বড় অস্ত্র কেনেনি ভারত। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধে সাজসরঞ্জামের অপ্রতুলতা ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। তখনই অস্ত্রশস্ত্র আধুনিকীকরণের তাগিদ দেখা দেয়। ২০০০ সাল থেকে ভারত রাশিয়ার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র কেনা শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিকীকরণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল
ভারত বিভাগের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পুরো অঞ্চলে সমাজতন্ত্রী আন্দোলনবিরোধী ব্যুহ রচনার জন্য পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অবলম্বন। একাধিক সামরিক চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিকীকরণকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। ভারত-পাকিস্তান বিরোধ, কাশ্মীর সমস্যা এজন্য ছিল খুব ভালো উপলক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের বশ্য রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সেই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন এখনও হয়নি।
২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সমন্বিত সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে
সামরিক ক্ষেত্রে মার্কিন-ভারত সম্পর্ক নতুন মোড় নেয় এই ’৯০-এর দশকেই। যা আরো পরিণত রূপ পেয়েছে বর্তমান দশকে বিশেষত ২০০৫ সালে। এই বছর ২৮ জুন দু’দেশের মধ্যে ‘নিউ ফ্রেমওয়ার্ক ফর দ্য ইউএস-ইন্ডিয়া ডিফেন্স রিলেশনস’ নামে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বলা হয় এই চুক্তি করা হয়েছে ১৯৯৫ সালের বোঝাপড়ার সূত্র ধরে। ২০১৫ পর্যন্ত এই চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশ সামরিক ক্ষেত্রে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন সম্পর্ক বিকাশে উদ্যোগী হয়। পারমাণবিক শক্তি বিকাশেও পরস্পর যোগাযোগ ছিল। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান দু’দেশই পারমাণবিক বিস্ফোরণ চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের উপর ‘তথাকথিত’ অবরোধ আরোপ করে। ‘তথাকথিত’ বলছি এই কারণে যে, কোন অবরোধ যুক্তরাষ্ট্র আসলেই আরোপ করে এবং কোনটি তার লোকদেখানো সেটা খেয়াল করলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আসল অবরোধ বা বৈরিতা কাকে বলে তা ইরান, ইরাক, উত্তর কোরিয়া, কিউবার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মার মার কাট কাট ভূমিকা দেখলে সহজেই বোঝা যায়।
তবে ভারত ও পাকিস্তানের এই পারমাণবিক বিস্ফোরণকে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ব্ল্যাকমেইল করে এই দু’টি দেশের সাথে অধিকতর ধ্বংসাত্মক বন তৈরি করতে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে পুরোমাত্রায় ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর বিনিময়ে পাকিস্তানের উপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। আর ভারতের সঙ্গে চলে অধিকতর সামরিক নৈকট্য স্থাপনের কথাবার্তা এবং ‘যৌথ স্বার্থে’ নানা প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য তৎপরতা। এসবেরই ফল ২০০৫ সালের চুক্তি। এই চুক্তির মধ্যে প্রকাশ্যেই যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে তার মধ্যে আছেঃ
সামরিক ক্ষেত্রে পরস্পর অব্যাহত যোগাযোগ ও উন্নয়ন
গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান বৃদ্ধি
সমরাস্ত্র বাণিজ্য সম্প্রসারণ
প্রযুক্তি স্থানান্তর, সহযোগিতা, যৌথ উৎপাদন, গবেষণা ও উন্নয়ন
মিসাইল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্প্রসারণ
সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ
নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথ তৎপরতা ও সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি
যৌথ ও সমন্বিত মহড়া
বহুজাতিক কর্মসূচিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি
ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের কাছে বেশি পরমাণু অস্ত্রের মজুদ রয়েছে!
দুই মার্কিন পরমাণু বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি বলেছেন, ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের কাছে বেশি পরমাণু অস্ত্র মজুদ রয়েছে। চীনসহ এই দু’টি প্রতিবেশী দেশ নিজেদের অস্ত্রভাার সমৃদ্ধ এবং নতুন নতুন জায়গায় অস্ত্র মোতায়েন করে চলেছে। রবার্ট এস নরিস ও হান্স এম ক্রিস্টেনসেন ‘নিউক্লিয়ার নোটবুকঃ ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডেপ্লয়মেন্ট অব নিউক্লিয়ার উইপনস-২০০৯’ শীর্ষক এক নিব েবলেন, পাকিস্তানের কাছে আনুমানিক ৭০ থেকে ৯০টি পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের কাছে রয়েছে ৬০ থেকে ৮০টি। ‘বুলেটিন অব দি অ্যাটমিক সায়েন্স’-এর একটি সংখ্যায় নিবটি প্রকাশিত হয়েছে। নিব েদাবি করা হয়েছে, বেইজিং, ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি সংখ্যাগত ও গুণগতভাবে নিজেদের অস্ত্রভাার সমৃদ্ধ করে চলেছে এবং আরো নতুন নতুন জায়গায় এসব অস্ত্র মোতায়েন করছে।
ভারত
ইসরাইল
যুক্তরাষ্ট্র
ইরান
উত্তর কোরিয়া
রাশিয়া ও
পাকিস্তানের সমরশক্তি