‘মোরা এক বৃন্তে দুটি ফুল হিন্দু মুসলমান’। কবিতায় এই লাইনটি যতটুকু সত্যি বাস্তবে এই কথাটুকু ততটাই মিথ্যা। ফুল দুটি এক বৃন্তে থাকার কারনে শোভা বর্ধিত হয়েছে বলে আপাত মনে হলেও বাস্তবে তাদের সহবাস্তানে কারনেই ঠুকাঠুকি লেগেই আছে। অথচ হবার কথা ছিল উল্টো। কোন দেশে মসজিদ ভেংগেছে, ভাংগ আমার দেশের মন্দির। মিষ্টার এন্ড মিসেস আয়ার দেখলে মনে হয় আমাদের জন্মই হয়েছে জাতিগত দাংগা করবার জন্য। রাং দে বাসন্তির একটি ডায়ালগ প্রায়ই আমার মনে পড়ে – ‘উই ফাইন্ড রিজন টু হেইট ইজ আদার, স্টার্ট ফাইটিং এন্ড কিলিং ইজ আদার’। আর বাংলাদেশে রাজনীতিতে সম্প্রদায়িকতা'ত একটি বিরাট ফ্যাক্টর। দেখছিলাম একটি কালজয়ি লেবানিস চলচিত্র – ‘হয়ার উই গো নাউ’।
রোমোট একটি গ্রাম। একটি মাত্র ব্রীজের মাধ্যমে এই গ্রামে প্রবেশ করা যায়। গ্রামবাসীরা কেউ খ্রীষ্টান আবার কেউ মুসলমান। শুরুতেই দেখা যায় গ্রামের মহিলারা কবরস্থানের দিকে যাচ্ছেন। কবরস্থানে একদিকে মুসলমানদের কবর অন্যদিকে খ্রীষ্টানদের। কোন এক কোন্দলে তারা তাদের স্বজনদের হারিয়েছেন। প্রত্যকের চোখেই জল। পরের দৃশ্য, গ্রামে একটি টেলিভিশন ও একটি রেডিও নিয়ে আসা হয়। খবরে জানা যায় লেবাননের কোন এক অঞ্চলে খ্রীষ্টান আর মুসলমানদের মধ্যে দাংগা হয়েছে। খবর শুনে উপস্থিত প্রামবাসীদের মধ্যে দাংগা প্রায় লেগেই যাচ্ছিল। কয়েকজন মহিলার মধ্যস্থতার কারনে থেমে যায়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে পুরুষেরা একে অপরে বিরুদ্ধে হামলা করতে প্রস্তুতি গ্রহন করে।
অন্যদিকে মহিলারা বুঝতে পারে গ্রামে এইসব খবর প্রচার হতে থাকলে ঘৃনা বাড়তেই থাকবে। তাই তারা রাতের অন্ধকারে গিয়ে টিভি এবং রেডিও নষ্ট করে দেয়। অন্যদিকে একটি বাচ্চা ছেলে রেডিও এন্টিনা ঠিক করতে গেলে চার্চের ভিতরে ক্রসটি ভেংগে যায়। দোষ পরে মুসলমানদের ঘাড়ে। প্রায় মারামারি লেগেই গিয়েছিল কোনমতে রক্ষা পায়। অন্যদিকে গ্রামের মসজিদে গরু ছাগল প্রবেশ করলে এর দায় গিয়ে পড়ে খ্রীষ্টানদের উপর। মুসলমানেরা এসে মেরীর মুর্তি ভেংগে ফেলে। এভাবেই ধীরে ধীরে গ্রামের পরিবেশ ভারী হতে থাকে। এক পর্যায়ে খ্রীষ্টানদের কপালে তিলক থেকে রক্ত পড়তে দেখে তারা মনে করে মুসলমানদের অভিশাপে এমন হয়েছে। তারা একটি পংগু মুসলমান ছেলেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। ছেলেটির মা ছেলেটিকে নিষেধ করে যেন সে তার বাবাকে গিয়ে এসব না বলে। অন্যদিকে খ্রীষ্টান পরিবারের এক ছেলে শহরে গিয়ে দাংগার কবলে পরে এবং সেখানে নিহত হয়। তার ভাই তার দেহ গ্রামে নিয়ে আসে কিন্তু সবার অলক্ষ্যে তার মা ছেলেটিকে কবর দেয় এবং প্রকৃত ঘটনা লুকাতে চেষ্টা করে। কারন প্রকৃত ঘটনা জানাজানি হলে গ্রামে মারামারি হবে এবং কেউ ন কেউ মারা যাবে।
কিন্তু কতদিন এইভাবে লুকানো যায়। গ্রামের পুরুষেরা একে অন্যকে হত্যা করতে অস্ত্রের জোগাড় করে। গোপন খবর পেয়ে নারীরা লুকানো স্থান থেকে অস্ত্র সরিয়ে ফেলে যাতে দাংগা না লাগতে পারে। শেষে একদিন সকালে প্রতিটি খ্রীষ্টান নারী মুসলমান হয়ে যায়, কোরান পড়তে শুরু করে, বোরকা, হিজাব পড়তে শুরু করে – অন্যদিকে মুসলমান নারীরা স্কার্ট পরতে শুরু করে। মেয়েরা তাদের বলে – ‘আমাদের মেরে ফেল, আমরা তোমাদের ঘরের মানুষ, কিন্তু বিধর্মি, আমাদের মেরে ফেল’। গ্রামের পুরুষেরা মেয়েদের কর্মকান্ডে তাজ্জব হয়ে যায়। শেষে তারা শহরে গিয়ে মারা যাওয়া ছেলেটিকে সবাই মিলে কবর দিতে নিয়ে যায়। কবর স্থানে গিয়ে তারা ঘুরে দাড়ায় এবং মেয়েদেরকে জিজ্ঞাসা করে এখন আমরা তাকে কোথায় কবর দিব? এই জিজ্ঞাসার মাঝে শেষ হয় চলচিত্রটি।
সহিংসতা খুবই সহজ বিষয়। আমরাও এক হিংস্র জীব। হয়ত পৃথিবির সবচেয়ে বড় হিংস্র জানোয়ারদের মধ্যে আমরা এক জীব যারা আইন আর কানুনের কারনে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু সুযোগ পেলেই, নানা উছিলায় আমাদের ভিতরকার পশু বেরিয়ে আসেতে চায়। এই পশুকে বেরিয়ে আসতে দিলে নিজেরি ক্ষতি হবে। নিজেরাই মারা যাব। তাই একে রুখতে হবে, কোন অবস্থাতেই এই আগুন বের হতে দেয়া যাবে না। এই ছিল মুল কথা। লেখক ও পরিচালক নাদিম লাবাকি অত্যন্ত যত্ন করে মুভিটি তৈরি করেছেন যেন মানব জীবনের অন্য একটি অধ্যায় আমরা দেখতে পারি। নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেছেন ক্লাউডি মুসাওব্বা ও লেবাননের প্রতিষ্টিত নায়িকা লায়লা ফুয়াদ।