যদিও আমি জন্মসূত্রে মুসলিম তবুও আমাকে দ্বিতীয়বারের মত আস্তিক হতে হয়েছে। এই ব্যাপারে আমার নিজের অভিজ্ঞতা আর মতামত সবার সাথে শেয়ার করতে যাচ্ছি এই পোস্টে।
ব্লগে বেশ কিছু নাস্তিক যারা আগে মুসলিম ছিল তাদের অভিজ্ঞতা পড়লাম কিভাবে তারা নাস্তিক হয়েছে। শুরুর দিকের ঘটনাগুলোয় আমার সাথে তাদের অনেক মিল আছে। সেগুলো বলেই শুরু করছি।
ছোট বেলা থেকেই বাবা মার কল্যাণে ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছুই শিখলাম, সব কিছু এতই গভীরভাবে বিশাস করতাম যে ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করার কোন চিন্তাই মাথায় আসতনা। ছোট বেলা থেকেই নামাজ পড়া রোজা রাখা সহ ধর্মীয় পুস্তিকাদি পড়া খুব আগ্রহের সাথেই করতাম। নিয়মিত কোরান পড়তাম, আরবী বাংলা দুই ভাষাতেই কোরান খতম দিয়েছি। নিজের ঈমানের উপর কখনই কোন সন্দেহ ছিলনা। আশ পাশের আর দশটা ছেলের চাইতে আমার ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান আর ইবাদতের পরিমাণ অনেক বেশী ছিল যা নিয়ে আমার মা বাবার গর্বের সীমা ছিলনা।
আস্তে আস্তে বড় হয়ে গেলাম। আমার চিন্তা ভাবনা আর জানার পরিধি আরও বিস্তৃত হল। ইসলামকে আঘাত করার জন্য নাস্তিকেরা যে তথ্যগুলো পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে সেগুলোও জানতে পারলাম। প্রথম প্রথম খুব অবাক লাগত যে এইসব তথ্যের কথা আমি আগে জানতামনা। মনে মনে খুব কষ্ট পেতাম। এসব ব্যাপার এড়িয়ে চলার কথা ভেবেছিলাম ঈমান চলে যাবে এই ভয়ে। কিন্তু একসময় ভাবলাম ইসলাম যদি সত্যিই হয় তাহলে এর মাঝে লুকোচুরির কিছু থাকা উচিৎ নয়। যাদের জ্ঞান অর্জন করার সামর্থ, ইচ্ছা বা সুযোগ নেই তাদের কাছে লুকোচুরির ব্যাপার থাকতে পারে কিন্তু আমার কাছে নয়। তারপর আরও জানার চেষ্টা করতে থাকলাম। মুসলিমদের তরফ থেকে নাস্তিকদের যুক্তি যখন খন্ডন করা হত সেগুলো পড়ে খুবই আনন্দিত হতাম। কিন্তু জ্ঞান অর্জনের জন্য আমার নেয়া স্ট্র্যাটেজি ভুল ছিল। কেন ভুল ছিল তা পরে আলোচনা করছি। আস্তে আস্তে অবিশ্বাস আমাকে গ্রাস করা শুরু করল। জীবনে প্রথম বারের মত মনে হল, সত্যিইতো সবকিছুর পিছনে একজন স্রষ্টা আছে এমনতো নাও হতে পারে, ইসলাম তো সত্য নাও হতে পারে। আস্তে আস্তে অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হল। সব কিছু খুলে আর বলছিনা তবে এটুকুই বলি যে আমার ঈমান খুব ঠুনকো ছিলনা যে সহজেই ভেঙ্গে যাবে। আমি নিজেই বুঝতে পারিনাই যে ঠিক কি কারনে আমি বিশ্বাস হারিয়েছিলাম।
তবে মা বাবা কে এসব কিছুই বললাম না। ভয়ে যে বলিনি তা নয় বরং উনারা শুনলে খুবই কষ্ট পাবেন তাই বলিনি, দুই ভাই এর মাঝে আমিই বেশী ইবাদত করতামতো তাই। দোযখের ভয় আমার বিশ্বাস ফেরাতে পারেনি, তবে এই অবিশ্বাস আমাকে এক ফোঁটা শান্তিও দিতে পারেনি। মা নামাজের কথা জিজ্ঞেস করলে মিথ্যা বলতাম যে পড়েছি। এই মিথ্যাটা বলার পর আমি এতটুকু অনুতপ্ত হতাম না যা আমাকে ভীষণ অবাক করেছিল। না, নাস্তিকতা আমার নীতিবোধ কেড়ে নিতে পারেনি তবে তখন নীতিবোধকে তেমন গুরুত্বপূর্ণও মনে হয়নি। এটা ভেবে সীমাহীন দুঃখ পেতাম যে আমি মরে গেলে চীরদিনের মত অস্তিত্বহীন হয়ে যাব আর কোনদিন কিছুই জানতে পারবনা। জীবনেকেও মাঝে অর্থহীন মনে হয়েছিল। শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আবার আস্তিক হবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু মনে অবিশ্বাস একবার ঢুকে গেলে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা কঠিন। এর মাঝে মা বাবা হজ্ব করে এলেন। প্রচন্ড খুশি মনে হজ্বের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লাগলেন আর আমি ভয়াবহ কষ্টের সম্মুখীন হলাম। আমি জানি যে তারা মিথ্যা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আছে কিন্তু কিছু বলতেও পারছিলামনা আর নিজেও খুশি হতে পারছিলামনা যদিও কষ্ট করে খুশি হবার ভান করে যাচ্ছিলাম। নাস্তিকতার দীর্ঘ কিছু সময় আমি যে মানসিক কষ্ট ভোগ করেছি তা বর্ণনা করার মত নয়। মূল কারন লুকালেও কারও কাছে লুকাতে পারতামনা যে আমার কোন মানসিক সমস্যা হচ্ছে। বিভিন্ন জনের পরামর্শে সাইকিট্রিস্ট দেখিয়েছি এমনকি সিলভা মেথডের মেডিটেশনও করেছি। আমি জানতাম এসব কিছুই আমার সমস্যার সমাধান দিতে পারবেনা।
মনে প্রশ্ন জাগল, অন্য নাস্তিকেরাও কি আমার মত মানিসিক অশান্তিতে থাকে? ভাব সাব দেখে মনে হল যে তারা শান্তিতেই আছে। তাহলে আমার সমস্যাটা কি? ভাবলাম আমি হয়তো নাস্তিক হওয়াটাকে মেনে নিতে পারছিনা। চিন্তা করে দেখলাম এটাও ভুল। আসলে আমি চীরদিনের জন্য হারিয়ে যাব এই ব্যাপারটাই আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছিল মনে হয়। তাই এই ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম, অন্যান্য কাজে ডুবে থেকে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম, যা সত্য তা তো মেনে নিতেই হবে। পুরো শান্তি ফিরে না পেলেও কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলাম।
চিন্তা করা চালিয়ে গেলাম। আমার নাস্তিক হবার পিছনে খুব বড় কারণ খুঁজে পেলামনা। অন্য যারা নাস্তিক হয়েছে তাদের যুক্তিগুলো দেখলাম। খুবই সাধারণ। যেমন মানুষ নিজের প্রয়োজনে ধর্ম বানিয়েছে এমন প্রমান আছে, গরু হালচাষে লাগে বলে হিন্দুরা গরু খাওয়া পাপ বলে চালিয়ে দিল, এমন ধরনের আরও কিছু প্রমান আছে। আবার, আল্লাহকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো যে আল্লাহ তুমি যদি থেকেই থাকো তাহলে আমাকে শাস্তি দাওতো? কোন ফলাফল না পেয়ে বিশ্বাস হারানো। এছাড়া ইসলামের বর্তমান অবস্থা যাচাই করেও অনেকে বিশ্বাস হারায়। কেন মুসলিমদের মাঝে এত ভিন্ন মত? কেন মুসলিমরা এত মিথ্যাবাদী দূর্নীতিবাজ হতে পারে? কেন ইসলাম স্বাধীন ইচ্ছায় এত নিয়ম কানুন করে বাধা দেয়? আল্লাহ কিভাবে এত নিষ্ঠুর হতে পারেন যে গরীব দুঃখি যারা ইসলাম ভাল করে জানার সুযোগ পায়নি অথবা যারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ঘরে জন্ম নিয়েছে কিন্তু অত্যন্ত ভাল মানুষ তাদেরকে দোযখে পাঠাতে পারেন?
হঠাৎ করে একদিন বুঝে ফেললাম মানুষের মৌলিক কিছু সমস্যা আছে যা সম্পর্কে তারা সবসময় সচেতন হতে পারেনা। ইউটিউবে একবার একটা মজার কুইজ দেখেছিলাম, যেখানে সাদা আর কালো ড্রেস পরা কিছু মানুষ মঞ্চে হাঁটাহাঁটি করছে আর একটা ফুটবল একে অন্যের সাথে আদান প্রদান করছে। কুইজে প্রশ্ন ছিল সাদা ড্রেস পরা মানুষগুলো কতবার বল আদান প্রদান করে? সেদিকেই নজর দেয় বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু এদিকে যে একটা কালো গরিলা হঠাৎ মঞ্চে প্রবেশ করে তা সবার চোখ এড়িয়ে যায় কারণ সবার চোখ তখন সাদা মানুষদের দিকে। ভিডিও রিপ্লে করে সবাই গরিলা দেখে অবাক হয়ে যায় যে এটা তাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। ব্লগের আস্তিক নাস্তিক সবারই এই সমস্যা আছে দেখলাম। একবার অবিশ্বাস করার পরেই সব নাস্তিক এর দৃষ্টিভংগী বায়াসড হয়ে যায়, তারা একপাক্ষিক ভাবে শুধু ইসলামের খুঁত গুলোই বের করার চেষ্টা করতে থাকে। একপাক্ষিক মানসিকতা নিয়ে মানুষ যখন কিছু খুঁজে তখন সে শুধু সেগুলোই দেখে যা সে দেখতে চায় এবং সেগুলোই শুনে যা সে শুনতে চায়, অন্য অনেক কিছুই তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় ঠিক ওই গরিলাটার মত।
এভাবেই আমি বুঝতে পারলাম যে ইসলাম সম্পর্কে জানার যেই স্ট্র্যাটেজি আমি নিয়েছিলাম তাতে ভুল ছিল। আবার সিদ্ধান্ত নিলাম নতুন করে শুরু করব। অনেস্টলি, বিন্দুমাত্র পক্ষপাত মূলক মনোভাব রাখবনা। এই আচরণের জন্যই হয়তো আল্লাহ সত্যের পথ আমার সামনে খুলে দিয়েছিলেন। নতুন ভাবে কোরান পড়া শুরু করলাম, আর সত্য চোখে ভাসতে লাগল। আমি বিশ্বাস ফিরে পেলাম। আমার সব প্রশ্ন দূর হয়ে যায়নি কিন্তু আস্তে আস্তে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাচ্ছি। এভাবে যখন সত্য জানছি তখন খেয়াল করে দেখলাম এখনকার বেশীরভাগ মুসলিম অনেক ভুল ভাবে ইসলামকে জানে আর মানে (এভাবে ভুল বলাটাও মনে হয় ঠিক হলনা, আসলে বলা উচিৎ আমার দৃষ্টিতে ভুল। আমার যুক্তি প্রত্যেকেই স্বাধীন ভাবে চিন্তা করে সঠিক না ভুল তা ঠিক করে নিক, কারও কথাতে প্রভাবিত হয়ে নয়)। আমার নিজের পূর্বের আস্তিক জীবনেও অনেক ভুল খুজে পেলাম, অথচ সেই সময় তা ভুল মনে হয়নি। ট্র্যাডিশনালি এই ভুল ইসলাম জেনেই নাস্তিকেরা ইসলামকে অস্বীকার করে।
এরা যদি একবার ভাবত যে লোকজন দেখে আমি ইসলাম শিখবনা, মানুষের ব্যাখ্যায় আমি আমি ইসলাম বুঝবনা বরং নিজের চেষ্টায় ইসলাম জেনে নিব তাহলে তারা বুঝে যেত কতটা সত্য এই ইসলাম। এরা ভাবে নবী যা যা করেছে তার সব কিছুই অন্ধভাবে অনুসরন করার নাম ইসলাম। মুসলিমরা যেহেতু ভাবে যে নবীর ভুল হওয়া সম্ভব না তাই এরাও ভাবে যে নবীর ভুল হওয়া সম্ভবনা এটা বিশ্বাস করা ইসলামের অংশ। অথচ নবীর (সঃ) কিছু ভুল নিয়ে আল্লাহ কোরানেই বেশ কয়েকবার তিরষ্কার করেছেন। মুসলিমরা ভাবে নবী (সঃ ) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, এটা মেনে নিতে তাদের সমস্যা। এটা মেনে নিতে আমার কোন সমস্যা নেই তবে যাদের এটা মেনে নিতে সমস্যা আছে তাদের জন্য সমাধানও আছে। মুহাম্মদ (সঃ ) যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ এবং তাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কোন কিছুই সৃষ্টি করতেননা এটা শুধু মাত্র হাদীসের ভিত্তিতে বলা হয়। কোরানে বরং বলা আছে আল্লাহ রাসুলদের মাঝে একজনকে আরেকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেননি। হাদীস সংকলনের ইতিহাস নিয়েতো নাস্তিকেরা খুব ভাল ভাবেই জানে। আর হাদীস বিশ্বাস করা ঈমানের অংগ না। যাদের এটা মানতে সমস্যা তারা সেটা ইগনোর করুক তাহলেই তো হয়। মুসলিমরা ভাবে যে অমুসলিম মাত্রই কাফির, তাই নাস্তিকেরাও সেটাই ভাবে কিন্তু কখনই কোরান যাচাই করে দেখেনা যে ঠিক কাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ কাফির শব্দটা ব্যবহার করেছেন। তারাই কাফির যারা নিশ্চিৎ ভাবে আল্লাহ ও তার নবীদের সম্পর্কে সত্যতা জেনেও তা অস্বীকার করে। আমি যেটা বুঝেছি কোরান অনুযায়ী আজকের শান্তিকামী খ্রীষ্টান বা হিন্দুরাও কাফির নয়। কাফির না থাকলে তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করারও কোন সুযোগ নেই। মুসলিমরা (এমনকি স্কলাররাও) ভাবে যে মুসলিম না হলে স্বর্গে প্রবেশ করা যাবেনা। আমি বলি নিশ্চয়ই আল্লাহ এ ব্যাপারে ভালো জানেন, তবে কোরানের কিছু আয়াতে স্পষ্ট করে বলা আছে কেউ যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করে, সৎ কাজ করে আর পরকালে বিশ্বাস করে তবে সে ইহুদীই হোক আর খ্রীষ্টানই হোক স্বর্গে যাবে। কিন্তু এর বিপরীত একটা কথাও কোরানে আছে যে কেউ স্বর্গে যেতে চাইলে তাকে ইসলাম ধর্মের হতে হবে। আরও খুঁজে দেখলাম যে ইসলাম নতুন ধর্ম নয়, কোরানে বহুবার বলা আছে যে এটা ইব্রাহীমের ধর্ম, মুহাম্মদ (সঃ ) তুমি নতুন ধর্ম প্রচার করছনা বরং ইব্রাহীমের ধর্মই প্রচার করছ। আমি জানিনা কোনটা সত্য, আল্লাহই ভাল জানেন তবে আমি জানি আল্লাহ অবিচার করবেন না। এমন অনেক উদাহরণ আমি দিতে পারি যা মুসলিমেরা ভুল জানে সেই কারনে নাস্তিকেরাও ভুল জানে। সেসব বিষয়ে আলাদা পোস্ট দেয়া যায় এখানে আর বেশী আলোচনা না করলাম।
আমার বিশ্বাস একটা দিনের জন্য কোন নাস্তিক যদি ধর্মীয় ভাবে নয় একান্ত নিজের মত করে প্রার্থনা করে বলে ‘ইশ্বর তুমি যদি থেকেই থাকো তাহলে সত্যটা আমাকে দেখাও, আমি আবারও সত্য জানার শেষ চেষ্টা ক৬রব, আমি সত্যি সত্যি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করব। তারপরও যদি সত্য না দেখি তাহলে জেনে রেখ তোমার অস্তিত্ব আমি অস্বীকার করব, সেক্ষেত্রে আমি দোষী নই’ তবে আল্লাহ অবশ্যি তাকে সত্য দেখাবেন। কিন্তু এই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীতে সত্য খুঁজার মানসিকতা কতজন নাস্তিক দেখাতে পারেন সেটাই প্রশ্ন।সবার জন্য শুভকামনা।
মানুষের জীবন যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে তার মৃত্যু সেই জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। ধর্ম ছাড়া অন্য কোন মতবাদই এত গুরুত্বপূর্ণ এই মৃত্যু কে নিয়ে কোন আলোচনা করতে পারেনা।