সেদিন এক সৃহৃদ বাংলা ব্লগারের সাথে কথা বলার সময় সে জানাল "আর বলেন না ব্লগ পলিটিক্স নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম"। এই কথাটি ইদানিং প্রায় শোনা যায় দেশী ব্লগারদের মধ্যে নানা ভাবে।
বাংলা ব্লগের উৎপত্তি ও স্বরুপ বিশ্লেষনে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে জর্ন বার্জার প্রথম ওয়েব্লগ শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৯৯৮ সালে আমেরিকায় ওপেন ডায়রি প্রথম ব্লগ প্লাটফর্ম হিসেবে জন্ম নেয়। পরের বছরই লাইভ জার্নাল, ডায়রিল্যান্ড ইত্যাদি চালু হয়। লক্ষণীয় যে এগুলো ছিল বর্তমান বাংলা ব্লগিং প্লাটফর্মগুলোর আদলে অর্থাৎ এদের (হয়ত কিছুটা ভিন্নভাবে) একটি এগ্রেগেটর বা প্রথম পাতা ছিল যেখানে সবার লেখা আসত। পরে এই ডিজাইনের বিবর্তন শুরু হয় এবং মনে হয় ব্লগার (ব্লগস্পট) প্লাটফর্ম থেকেই ব্লগগুলো স্বকীয়তা পাওয়া শুরু করে। পরবর্তী বছরগুলোতে প্রফেশনালরা নিজস্ব ডোমেইন ব্যবহার করা শুরু করে এবং মুভেবল টাইপ ও ওয়ার্ডপ্রেস ইত্যাদি ব্লগিং প্লাটফর্ম করে নিজেরাই একেকটি আইকন হয়ে যায়।
ইংরেজী ব্লগের বিস্ফোরন শুরু হয় ২০০৩ সালে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের সময়, ঘটনা চক্রে সে বছরই আমি ইংরেজীতে ব্লগিং শুরু করি। কিন্তু বাংলা ব্লগ তখনও ছিল দুর অস্ত। কারন বাংলা লেখার প্লাটফর্মের সমস্যা। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতার দেবাশীস ও সুকন্যা ব্লগস্পটে বাংলা ব্লগ শুরু করেন ও খুঁজে খুঁজে আগ্রহীদের আমন্ত্রণ জানান ও সাহায্য করেন শুরু করার জন্যে। আমার নিজের ইউনিকোড ও অন্যান্য বাংলা লিখন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা ছিল না। আমার কম্পিউটারে তখন লেখো নামে একটি ইউনিকোড এডিটার ইনস্টল করে ব্লগে বাংলা লেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু সেটি বেশ জটিল ছিল তাই আগানো সম্ভব হয় নি।
২০০৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রথম বাংলা ব্লগিং প্লাটফর্ম বাঁধ ভাঙ্গার আওয়াজ (সামহোয়ার ইন) আত্মপ্রকাশ করলে বাংলা ব্লগিংয়ের ক্ষেত্রে নবদিগন্ত রচিত হয়। হাসিন ও এমরান বাংলার প্লাটফর্ম সমস্যার প্রথম বাঁধাটি ভাঙ্গে এমবেডেড এডিটর ব্যবহার করে। অনেকেই বাংলা টাইপিং জ্ঞান ও বাংলা কিবোর্ড ছাড়া ফোনেটিকে সহজে লিখতে সমর্থ হয়। ২০০৬ সালে ব্লগটি ইউনিকোড হলে পূর্নতা পায়। এর সাথে সাথে কিন্তু ব্লগস্পট ও অন্যান্য প্লাটফর্মে অনেকে লেখা শুরু করে ইউনিকোডের মাধ্যমে।
সেসময় বাংলা ব্লগের লেখক সংখ্যা পাঁচশর মত থাকলেও ততদিনে পূরো ব্লগোস্ফিয়ারে বিপ্লব ঘটে গেছে। ২০০৬ এর আগস্টে ডেভিড সিফরি টেকনোরাতির (ব্লগ সার্চ ইন্জিন) এক জরীপে দেখান যে বিশ্বে পাঁচ কোটি ব্লগ রয়েছে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে ব্লগগুলো কোন ভাষায় সেই পরিসংখ্যানটি। এই বিপুল পরিমাণ ব্লগের মধ্যে মাত্র ৩৯% ইংরেজী ভাষায়। জাপানী ভাষা ৩১% নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে এবং চাইনিজ ১২%। এই ভাষা বৈচিত্র দেখায় যে মানুষ তার মাতৃভাষাতে কথোপকথনে বেশী উৎসাহী। কিন্তু বিশ্বের পঞ্চম সবচেয়ে কথিত ভাষা বাংলায় তখন ব্লগ ছিল হাতে গণা।
আমাদের জনসংখ্যার দিকে তাকালে দেখব আমাদের দেশে ইন্টারনেট পেনিট্রেশন ১% এরও কম অথচ এশিয়ার গড়পড়তা পেনিট্রেশন ১৪% (সূত্র )। আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তুলনায় আমাদের বাংলা ব্লগারদের সংখ্যা খুবই কম।
গত বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্লগের সংখ্যা এগারো কোটিতে ঠেকেছিল এবং এবছরে নিশ্চয়ই বিশ কোটির কাছাকাছি হবে। কিন্তু বাংলা ব্লগ কি সেই পরিমানে বেড়েছে?
গত দুই বছরে বাংলা ব্লগ অনেক এগিয়েছে, বেশ কয়েকটি প্লাটফর্ম হয়েছে, ইউজার বাড়ছে এবং স্বাতন্ত্র্য গড়ে উঠেছে এদের মধ্যে। অভ্রের মত ওপেনসোর্স বাংলা ইনপুট সিস্টেমের কারনে বাংলা লেখা এখন অনেক সহজ। তবে কেউ কেউ আশন্কা প্রকাশ করছেন যে হারে বাংলা ব্লগ বাড়ছে তাহলে বাংলা ব্লগের পরিণতি কি হবে ভবিষ্যতে?
যারা এই প্রশ্নটি করছেন এবং যারা বাংলা ব্লগ প্লাটফর্মগুলোর মধ্যে এইসব পলিটিক্সে ব্যস্ত তারা আসলে এর বিশাল চিত্রটি দেখতে পাচ্ছেন না। সরকার ঘোষণা দিয়েছেন প্রতিটি স্কুলে পিসি ও ইন্টারনেট দেয়া হবে। যখন এই সব স্কুলের ছেলেরা ব্লগিং করা শুরু করবে তখন আমাদের আরও গোটা কুড়ি ব্লগিং প্লাটফর্ম লাগবে।
আর কে কোথায় ব্লগিং করবে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। ব্লগিংয়ের ব্যাপারটিও বেশ সাম্প্রদায়িক এবং সামাজিক। আমরা ব্যাক্তি জীবনেও নিশ্চয়ই কিছু নির্দিষ্ট লোকের সাথে বন্ধুত্ব করি, কিছু পছন্দের পত্রিকা পড়ি। ব্লগের ক্ষেত্রেও এমনই, বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন পছন্দ থাকতে পারে। কাজেই অমুক নাক উঁচু, অমুকের মডারেশন নাই ইত্যাদি অভিযোগের তেমন ভিত্তি নেই বলেই মনে করি। সবাইকে তাদের স্বকীয়তা নিয়ে থাকতে দেয়াই উত্তম।
অনেককেই দেখি অহেতুক অন্য প্লাটফর্মের বিরুদ্ধে লেগে থাকতে, এর ওর বদনাম করতে। মনে রাখতে হবে একটি দুটি প্লাটফর্মই বাংলা ব্লগের সবকিছু নয়। বেশ কটি প্রতিশ্রুতিমুলক প্লাটফর্ম চালু হয়েছে ভবিষ্যতে আরও হবে। অনেকে হয়ত ভবিষ্যতে স্বতন্ত্র ব্লগে লিখতে পছন্দ করবে। লোকে তাদের পছ্ন্দমতই তাদের কমিউনিটি ঠিক করবে। কয়েকদিন পরে ব্লগ এগ্রেগেটর ও বেস্ট অফ ব্লগস এর মত উদ্যোগ জনপ্রিয় হবে।
বাংলা ব্লগের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। এখন দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচ লাখের মত। অদুর ভবিষ্যৎে যখন এই হার দশগুণ হবে তখন দেখবেন দেশে বাংলা কন্টেন্ট এর আকাল পড়বে। দেশের বাংলা সংবাদপত্রগুলোর অধিকাংশই ইউনিকোড না তাই গুগল সার্চ ইন্জিনে সেসব আসে না। আপনি যা এই ব্লগে লিখেছেন তার থেকে একটি বাক্য সার্চ দিয়ে দেখেন গুগলে আসে কি না। এটি আজ থেকে দশ বছর পরেও থাকবে (ব্লগ মুছে না ফেললে)। কাজেই কি অমিত শক্তি আপনার লেখায় রয়েছে কল্পনা করতে পারছেন?
কাজেই যে যে ব্লগেই লিখুন না কেন হাত খুলে লিখে যান, আপনার সুখদু:খের কথা, মজার অভিজ্ঞতা ভ্রমণ ইত্যাদি যা ভাল লাগে তাই।
গণতন্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে ব্যক্তি পছন্দ ও মতামত প্রকাশের অধিকার। একে অপরের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে এই মতামতকে জোড়ালো করে সবার কাছে ছড়িয়ে দেয়া যায় যা পরে মেজরিটিতে পরিণত হয়। ব্লগের মাধ্যমে সহজেই এটি করা সম্ভব।
বিদ্যমান ব্লগ পলিটিক্সে জড়ানোর দরকার নেই। আপনারা নিজেরাই নতুন ইতিহাস ও রাজনীতি তৈরি করুন।
গ্রাফ: সিফরি'জ এলার্টসের সৌজন্যে