ভাস্কর্য ভাঙ্গা নিয়ে ঢাকা শহরের তোলপাড় থামছে না। ঠিক একই সময়ে আমার ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে এই বিতর্কে যতই কম সময় দিব ভাবছিলাম ততই যেন এই বিতর্ক না থেমে গুমরে গুমরে উঠতে চাইছে। সমাজ এতে ভাগ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে সন্দেহ নাই; আর বিতর্কের সীমাও এতে আরও বিভিন্ন আনুসাঙ্গিক দিকে ব্যপ্ত হয়ে পড়েছে। ফলে আমার অনুমান, এই বিতর্কের ব্যপ্তি এখন বিশাল এবং বিভিন্ন দিক থেকে এই বিতর্ককে এড্রেস ও মোকাবোলা আমাদের করতেই হবে।
১। এর মধ্যে দোড়গোড়ায় এসে টোকা দেয়া সবচেয়ে বড় বিপদটা নিয়ে প্রথমে শুরু করি।
আমাদের নির্বাচনটা না হলে কী হবে বা না হওয়ানোর দিকে নিতে গেলে কী করতে হবে - সরকারের লুকানোটা অংশের বিশেষ সংস্হার কারও এনিয়ে অস্হিরতা আছে, সামনে তা আরও বাড়বে। ফলে মুর্তি ভাঙ্গার মত আরও অনেক উস্কানি আরও ভয়াবহতা আমাদের দেখতে হতে পারে। এখনও পর্যন্ত কেবল কিছু মিডিয়া মোগল, আমিনীর মত খুচরা দুএকজনের সাথে নিয়ে এই ফাঁদাপাতের সঙ্গী হয়েছে, আর আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। জামাত যাকে আমরা প্রচারের সুবিধা জন্য জেনে বুঝে বা না বুঝে ইসলাম মানে জামাত এই সহজ সমীকরণ টানি সেই জামাত আমার জানা মতে নিজেকে এখনও এজেন্ডাভুক্ত করে নি। নিজের অন্য বিপদ নিয়ে তার ব্যস্ততা আছে। ভবিষ্যতে সে কী হবে সেটা এধরণের উস্কানিতে আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় তার উপরই নির্ভর করবে বলে আমার ধারণা। আপাতত আমিনীদের সফলতা এখানেই যে সে কারও এজেন্ডায় হঠাৎ করে মুর্তি ইস্যু খাড়া করতে পেরেছে ও ঐ লাইনের একটা আপাত মেরুকরণ ঘটিয়েছে। আমাদের সমাজের মুর্তি বিতর্কের একটা বিবেচক সমাধানের আগেই আমিনীদের পাতা মেরুকরণে আমরা ভাগ হয়ে যাওয়া এড়াতে পারবো কী না এটাই আজ মুখ্য প্রশ্ন। এবং তা সমূহ আত্মঘাতি বিপদেরও বটে।
২। আমাদের ভুখন্ডে সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী মুসলমান - এটাকে পছন্দ অপছন্দের বিষয় বানানোর মত বেকুবির সময় বা সুযোগ আমাদের নাই। ফলে এখানে শিল্পকলা মানে বলতে চাচ্ছি চিত্রকলা, ভাস্কর্যের রূপ (কনটেন্ট ও ফর্ম উভয় অর্থে) কী হবে? না কী কোন চিত্রকলা, ভাস্কর্যই থাকা উচিত না? না কী থাকবে তবে এর বিশেষ কোন বৈশিষ্ট থাকবে? না কী দেশকাল জনগোষ্ঠী তাদের জীবন সংগ্রাম নির্বিশেষে ইউরোপের এনলাইটমেন্ট বা রেনেসাঁটা এমনই সার্বজনীন যে ওটা বেমালুম নকল করতে পারার দক্ষতা মানে চিত্রকলা, ভাস্কর্যের সার্বজনীন রূপ, ফলে বাংলাদেশেও ওটাই একমাত্র রূপ হবে?
আমি মনে করি, এসব প্রশ্নই আজকের বির্তকের কেন্দ্রীয় বিষয়। একে মোকাবোলা করার সাহস ও সক্ষমতার উপর নির্ভর করছে আমরা কতদূর রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সঙ্কট অতিক্রম করে যেতে পারবো। তবে দুঃখের বিযয় মুখ্য প্রশ্নটা কী তাই আমরা এখনও সকলে স্পষ্ট নই।
৩। একজন রংমিষ্ত্রি আর চিত্রশিল্পীর মধ্যের ফারাকটা কোথায়? অথবা যদি প্রশ্ন করি মৃণাল হক কী রাজমিস্ত্রি? মানে চারুকলা ইন্সটিটিউট কী মৃণালকে উন্নত মানের রাজমিস্ত্রি বানিয়েছে? রাজমিস্ত্রি খাড়া দেওয়াল বানাতে পারে কেবল, কংক্রিটের মানুষের আকার দেবার মত খুটিনাটি শেপ আনতে পারে না। মৃণাল খুবই সুন্দর হুবহু কংক্রিটে মানুষের আকার দিতে পারে। আবার এমনকি ধরা যাক, এ্যাসথেটিক নাকি সৌন্দর্যতত্ত্ব বলে কী জানি জ্ঞান আছে তাতেও মৃণালের কাজ শিল্পোত্তীর্ণ। (আজকাল অনেকে সৌন্দর্যতত্ত্বের যুক্তিতে মৃণালের অথবা শামীম শিকদারের মুর্তি ভাঙ্গতে বলছে। আবার অনেকে বলছে মৃণাল বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে সরকারি কোষাগার খালি করে কাজ বাগিয়ে অ-শিল্পীক কান্ডকারখানা করেছে তাই ভাস্কর্য স্হাপনের সরকারি নীতিমালা আগে বানাতে হবে। সার কথায় যুক্তির গোড়াটা সৌন্দর্যতত্ত্বের উপর দাড়িয়ে আছে। তাই এখানে এখনকার মত পাঠককে ধরে নিতে বলছি মৃণালের কাজ শিল্পোত্তীর্ণ।) অতএব কথাটা দাড়ালো এই কাল্পনিক মৃণালের সৌন্দর্যতত্ত্ব জ্ঞান আছে ফলে তাকে এবার সৌন্দর্যতাত্ত্বিক রাজমিস্ত্রি বলব নাকি ভাস্কর্যশিল্পী বলব! আমরা কি রাজমিস্ত্রি, না সৌন্দর্যতাত্ত্বিক রাজমিস্ত্রি, না আসলেই ভাস্কর্যশিল্পী চাচ্ছি।
এতক্ষণ যা আলাপ করলাম তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক চারুকলা ইন্সটিটিউটের পাঠ্য সিলেবাসে বোধহয় এইসব টেকনিক শিখার কর্তব্যই কেবল নির্ধারিত করা আছে। আমার ধারণা, কোন চারুকলা ইন্সটিটিউট এই সিলেবাস ধার্য করে ভাস্কর্যশিল্পী বানাতে পারবে না। কারণ চারুকলা মানে কৃৎকৌশলগত টেকনিক না। কী আঁকবে বা গড়বে ছবি বা মুর্তি যাই হোক, তার বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) এবং কী রূপে(ফর্মে), বিষয়কে হাজির করবে ওটাই প্রধান বিষয়। ফর্ম বলতে, তেল না জল রং অথবা কংক্রিট না মেটাল সেই মাধ্যম বুঝাচ্ছি না। বিষয় ও রূপ ভাস্করের মনে ঠিকঠাক দানা বাধার পর তাঁর সৌন্দর্যতাত্ত্বিক রাজমিস্ত্রির টেকনিক জ্ঞানের দরকার হবে।
আবার, বিষয় ও রূপ টা পেতে গেলে, অর্থাৎ যাকে বা যা নিয়ে সে শিল্পচর্চা করবে তা কেমন তা ধরতে গেলে ইতিহাস দর্শনের খবর, বিশেষত যে মাটি দেশকাল সংস্কৃতিতে তাঁর অবস্হান তার খবর নিতে হবে।
এই খবর যার নাই সে ভাস্কর নয় রাজমিস্ত্রি, চিত্রশিল্পী নয় রংমিস্ত্রি হতে পারে। হাতযশ থাকলে বড়জোড় সৌন্দর্যতাত্ত্বিক রাজমিস্ত্রি অথবা রংমিস্ত্রি হতেও পারে। শিল্পকলার লোক নয়।
কাশ্মিরী শাল আমরা সবাই চিনি। গায়ে পরতে দেখেছি, পরেছি, পরি। পশম বুনে তৈরী করার পর ওতে পাড় লাগানো হয়। লক্ষ্য করিনি হয়তো কিন্তু আমরা দেখব পাড়ে সুতার কাজে মনে হবে এক ধরণের লতাপাতা। শিল্পের ভাষায় যাকে মোটিফ বলে ওটার প্রতি লক্ষ্য করতে বলছি আমি। ভালো করে লক্ষ্য করলে তবেই দেখব ঐ লতাপাতা মানুষের চেনাজানা প্রকৃতিতে দেখা যায় এমন কোন কিছুর সাথে এর মিল নেই। কেন?
কাশ্মিরী শালের কারিগরেরা কোন চারুকলা থেকে পাশ দিয়ে আসা মৃণাল বা শামীম নয়। নেহায়েতই গরীর, স্হানীয় মাটিতে ঐতিহ্যে লালিত কারিগর। ইসলাম ঐ ঐতিহ্যে সংস্কৃতির একটা অংশ, অঙ্গও বটে যার, ভিতরে কারিগর বড় হয়েছে। ইসলাম মানে নিরাকারের উপাসনা। ফলে দাবি করে, এক আধটা সাফাত বা গুণ আরোপ করে বা কোন একটা জীব জড়ের ভিতরে সীমাবদ্ধ করে আল্লার অর্থ বুঝা যাবে না। ফলে এবস্ট্রাকশন বা বিমূর্ততা ওখানে একটা খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে কারিগর, সে কিছু আঁকতে গেলেই তা সাকার হবে বলে আঁকা বন্ধ করেনি বরং যা এঁকেছে তা বিমূর্ত, মুর্তিরূপ বের করে দিয়েছে। বিমূর্ত লতাপাতা এঁকে দিয়ে তাঁর শিল্প, তাঁর পেটের দায়ও মিটিয়েছে।
এটা ভাবা ভুল হবে সুনির্দিষ্ট কারিগর এসব ব্যাখ্যা জেনে একাজ করে, তবে সে মানে; কবে কখন থেকে এই স্ব-ভাব যা তার ঐতিহ্য হয়ে ঢুকে আছে - নিজের ঐতিহ্য বিশ্বাস বলেই তা মেনে চলে।
এখানে আমার একথা বলার নীট মানে হোল কাশ্মীরি গরীব কারিগরেরা নিরাকার আর মুর্তির বিরোধ কিভাবে বিমূর্ততায় নিরসন করেছে তা দেখার মত। আমরা ভাস্কর হতে চাইলে আমাদেরও ভাস্কর্যের কনটেন্ট ও ফর্মের, আমার মাটির ইতিহাস দর্শনের বিষয়ে জানতে হবে। এটা না জানলে ভাস্কর হবার প্রথম শর্তই পূরণ হলো না। লালন বা নবী আমার সরাসরি বিষয় হলে তো আরও সাত বার ভাবতে হবে। কারণ, নিজেদের ছবির ব্যাপারে তাঁদের সুনির্দিষ্ট দার্শনিক আপত্তি আছে। সেসবের ইতিহাস দর্শন না জেনে কোন ভাস্কর একাজ হাত দিতে পারেন না।
মোল্লা মৌলবি বা জামাতের হাতে ইসলাম বা ধর্ম ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে আমরা এক একজন মৃণাল বা শামীম হতে পারি। এনলাইটমেন্টের ঠিক রাস্তাই ধরেছি বলে নিজেকে বুঝ দিতে পারি। "আমাদের লড়াই এমন এক শক্তির সঙ্গে, যারা বোঝে না ফুল কী, সংস্কৃতি কী, গান কী, কবিতা কী"- এসব বলে নিজের মহান কাজের পক্ষে জনমতের ঢোল পিটাতে পারি। এতে বড়জোড় আমরা একএকজন সৌন্দর্যতাত্ত্বিক রাজমিস্ত্রি বা রংমিস্ত্রি হবো হয়তো। কিন্তু নিরাকার আর মুর্তির তথাকথিত বিরোধ আমাদের পিছু ছাড়বে না। বার বার দাঙ্গা বাধিয়ে আমাদের পিছু টানবে, আমাদের অস্তিত্ত্ব সঙ্কটময় করে তুলতে থাকবে।
আমি শিল্পকলার কেউ নই, তুচ্ছ একজন সাধারণ মানুষ মাত্র। দূরের মানুষ ওভারহেয়ার করে শোনার মত যতটুকু জানি, পশ্চিমে ভাস্কর্য বা শিল্পকলার মধ্যে বিমুর্ত ধারার চর্চা আছে। আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ বা শহীদ মিনার এই বিমূর্ত ধারার অন্তর্গত। এই বিমুর্ত ধারাই বাংলাদেশের ধারা হবার কথা।
ইসলাম মানে মোল্লা মৌলবি বা জামাত - এভাবে ছেড়ে দিয়ে এর কবরের উপর আমাদের শিল্পকলা দাড়াবে - এটা কখনই ঘটবে না। বরং ইসলামের সাথে একটা সক্রিয় সচেতন এনগেজমেন্ট, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে আমরা অনেক বিরোধ নিরসন করে সামনে যেতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস।