মেহেদী হাসান পলাশ :
গত ৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তি আইন-২০০৬’র সংশোধনী বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তি আইন-২০১৩ পাস হয়েছে। ডিজটাল বাংলাদেশ শ্লোগানের জোয়ারে ভেসে চলা বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত একটি সময় উপোযোগী ও কার্যকর আইন প্রণয়ণের দাবি তথ্য প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টদের বহুদিনের। তাদের এ দাবি আলোচ্য আইনে কতটা পূরণ সেটা গভীর বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে এ আইনের চার নম্বর ধারায় বলা হয়েছে বাংলাদেশের বাইরে থেকে ভেতরে, ভেতরে থেকে বাইরে কোনো অপরাধ করলে তিনি বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশে অপরাধ করলে যেরূপ দ-যোগ্য হতেন এ ক্ষেত্রেও একইরূপ বিবেচিত হবেন। এ আইনে স্যোশাল মিডিয়ায় কোনো ব্যক্তির নামে ফেক আইডি খুলে পরিচালনা করা আমলযোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডেকে পাঠাতে পারে আদালত। অপরাধ প্রমাণিত হলে তার কারাদ- ও অর্থদ- উভয়ই হতে পারে। আইনে অভিযুক্ত হলেই অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃপক্ষকে সব গোপন তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। এমনকি পাসওয়ার্ড ও কম্পিউটারে সংরক্ষিত ব্যক্তিগত তথ্যাদিও এর মধ্যে পড়ে। সরকার কোনো তথ্য চাইলে তথ্য দিতে ব্যর্থ হলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। সোস্যাল মিডিয়াতে কেউ মিথ্যা, অশ্লীল ও মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করলে, উষ্কানীমূলক, জননিরাপত্তা বিঘœকারী, ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাতকারী কোনো অপরাধ করলে কারাদ- ও অর্থদ- বা উভয়ই হতে পারে। ২০০৬ সালের আইন অনুসারে কারাদ-ের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর আর অর্থদ-ের পরিমাণ অনধিক এক কোটি টাকা। সংশোধিত আইনে এই কারাদ-ের মেয়াদ বাড়িয়ে ১৪ বছর করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন-২০১৩, ১৯ আগস্ট মন্ত্রীসভায় অনমোদিত হয়। ২০০৬ সালের মূল আইনে অধ্যাদেশের মাধ্যমে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছিল তার সবগুলোই এখানে রাখা হয়েছে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী তথ্য-প্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধে পুলিশ চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারবে এবং এসব অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধ জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। আগের আইনে এসব অপরাধ জামিনযোগ্য ছিল। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ সংসদে বিলটি উত্থাপন করে পাস করার প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে এটি পাস হয়। মন্ত্রী বলেন, তথ্য প্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৩ জারির মাধ্যমে ২০০৬ সালের মূল আইনে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছিল তা আইনে রূপ দেয়ার জন্য এই বিল আনা হয়েছে। বিলে শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বনিম্ন সাত বছর এবং সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদ-ের বিধান করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনী আইনে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সর্বোচ্চ ১০ বছর শাস্তির বিধান ছিল। আগের আইনে মামলা করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। সংশোধিত আইনে অপরাধ আমলে নিয়েই পুলিশ মামলা করতে পারবে। মূল আইনের ৫৪ ধারায় অপরাধ হিসেবে কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির অনিষ্ট সাধন, ৫৬ ধারায় কম্পিউটার সিস্টেমের হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ, ৫৭ ধারায় ইলেক্ট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও ৬১ ধারায় সংরক্ষিত সিস্টেমে প্রবেশ সংক্রান্ত অপরাধের দ- পরিবর্তন করে ‘অনধিক ১০ বছর কারাদ-ের’ স্থলে ‘অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদ-’ শব্দাবলী প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মূল আইনের ৭৬ ধারায় সংশোধনী এনে উক্ত ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ ধারায় বর্ণিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য (কগনিজেবল) অর্থাৎ এসব অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ কোন ধরনের পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবে এবং এসব অপরাধকে অ-জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এই ধারার অনুচ্ছেদ (২) প্রতিস্থাপন করে বলা হয়েছে, ‘(ক) ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬১ এ উল্লেখিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য (কগনিজেবল) ও অ-জামিনযোগ্য হইবে এবং (খ) ৫৫, ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬২, ৬৩, ৬৪ ও ৬৫ এ উল্লেখিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য (নন-কগনিজেবল) ও জামিনযোগ্য হইবে।
মন্ত্রীসভায় অনুমোদনের পর থেকেই এ আইন নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে পাসের পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ আইনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিরোধী দল ও মত দমনের হাতিয়ার আখ্য দিয়েছে। বিএনপি ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন ও পেশাজীবীরা এ আইনের তীব্র সমালোচনা করে। তারা একে বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী আখ্যা দিয়েছে। এ আইন লঘুপাপে গুরুদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। অনলাইনে অসত্য ও অশ্লীল কিছু প্রকাশের কারণে যদি ১৪ বছরের কারাদ- হয়, তবে খুনের শাস্তি কত বছর হবে, এমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) এবং আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) আয়োজিত ‘তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি আইন ২০০৬ ও তার সংশোধন: বাকস্বাধীনতার প্রতিবন্ধক’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে। মানবাধিকার নেত্রী হামিদা হোসেনের মতে, আইন করা হয় নাগরিকের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু এই আইনটি করা হয়েছে স্বাধীনতা হরণ করার জন্য। আইন বিশ্লেষক শাহদীন মালিক বলেছেন, আগামী বছর টিআইবি দুর্নীতির যে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে, সেখানে যদি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়, তবে এই আইন বলে টিআইবির কর্মকর্তাদের অন্তত সাত বছর করে জেল হবে। এ আইন থাকা মানে দেশকে অসভ্য বা মধ্যযুগে ঠেলে দেয়া। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এই আইনের মাধ্যমে জনগণকে ত্রাসের রাজত্বে ঠেলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্লগ সামহোয়্যার ইন ব্লগের নির্মাতা গুলশান ফেরদৌস বলেছেন, এই আইনের মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যার পথ সুগম করা হয়েছে। আইনজীবী তানজিব-উল-আলম বলেছেন, এটি একটি ‘ড্রাকনিয়ান আইন’ (অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম)। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, সংশোধিত এই আইন দিয়ে ডিজিটাল অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযোগও করা যাবে না। বরং এই আইনের সাম্প্রতিক সংশোধনীর ফলে আইনটি বাকস্বাধীনতার অবসান এবং জনসাধারণের হয়রানির একটি হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বেসিসের মহাসচিব রাসেল টি আহমেদ এই আইনের ফলে ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্ম ‘ইন্টারনেটকে জেলখানা’ মনে করবে উল্লেখ করেন। মূলত: গণজাগরণ মঞ্চ, ব্লগার রাজিব, হেফাজত প্রভৃতি প্রেক্ষাপটে ২০০৬ সালের আইনটি সংশোধন করা হলো বলে মনে করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুকে উইলিয়াম গোমেজ নামে এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে হুমকি দিলে সংশোধনের গতি বৃদ্ধি পায়। সরকার এ আইন করার সময় ভিসন-২০২১ মাথায় রেখে এ আইন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। না হলে সরকারের মেয়াদ যখন মাত্র এক মাসেরও কম তখন এমন একটি নির্বতনমূলক আইন করায় অভিজ্ঞমহল বিস্মিত হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতার পালাবদল হলে এই আইনটি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হতে পারে সে বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি। কিন্তু যুগোপোযোগী করার নামে যে সংশোধন করা হলো তা যুগোপোযোগী হয়নি মোটেই। বিশেষ করে এ আইনের সংজ্ঞায় কম্পিউটারের ব্যাখ্যা দেয়া হলেও বর্তমানে নোট, ট্যাব, আইপড, এমপিফোর, ক্যামেরা, মোবাইল, মেমরি কার্ড, ডিভিডি, হার্ডডিস্ক প্রভৃতি আইসিটি প্রোডাক্টের মধ্যে পড়ে। মোবাইলেই বর্তমানে বেশিরভাগ আইটি সেবা পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ইন্টারনেট গ্রাহক মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কিন্তু মোবাইলকে এ আইনের আওতায় সুস্পষ্ট করে আনা হয়নি।
আমাদের দেশে প্রধান সাইবার ক্রাইম হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কোনো না কোনো নারীর পর্নো ছবি ভিডিও ইন্টারনেটে চড়িয়ে যাওয়ার খবর দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত ছাড়াও সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠী এই সাইবার ক্রাইমের সাথে যুক্ত। এর মাধ্যমে অসংখ্য নারীর জীবনের বিভীষিকা নেমে আসছে। দেশীয় পর্ণোগ্রাফির বাইরে বিদেশী পর্ণোগ্রাফি জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে সাইবার ওয়ার্ল্ডে। বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা, তরুণ সমাজের বিপথগামিতার পেছনে রয়েছে এই পর্ণগ্রাফি। কিন্তু পর্ণোগ্রাফিকে সরাসরি সাইবার ক্রাইমের আওতায় এনে এই সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। সরকার ২০১২ সালে আলাদা একটি পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন করেছে। কিন্তু সে আইনে কতটুকু পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ হয়েছে সাইবার ওয়াল্ড সম্পর্কে যাদের নূন্যতম ধারণা আছে তারা তা জানেন। কিন্তু সে আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর কারাদ-। গালি দিয়ে কারো মানহানি করলে ১৪ বছরের জেল কিন্তু কোনো মেয়ের অশ্লীল ভিডিও উৎপাদন করে তা বাজার জাত করে ঐ মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দিলে তার শাস্তি ৭ বছরের কারাদ-। একারণেই এই আইনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা হচ্ছে। তাছাড়া মানহানীর বিষয়টাও আইনে এমনভাবে রাখা হয়েছে যার রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার হতে বাধ্য। আমাদের রাজনীতিবিদরা টিভিতে, মঞ্চে এমনকি সংসদেও প্রতিপক্ষকে বেপরোয়া গালিগালাজ ও খিস্তিখেওড় করেন। দেশের কোটি কোটি মানুষ টিভিতে তা দেখে তাদের মানসম্মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তারা এ আইনের আওতায় অপরাধী হচ্ছে না। কিন্তু সেই খিস্তিখেওড়ের ভিডিও যদি কেউ স্যোশাল মিডিয়াতে আপলোড করে তবে তিনি এই আইনের আওতায় আসবেন এবং ১৪ বছরের জেলদ-ের মুখোমুখি হবেন। ই-মেইল বা ফেসবুকের মতো আইডিগুলো এখন অনেক সহজেই হ্যাক করা যায়। অন্যের আইডি হ্যাক করে কিম্বা অন্যের নামে ফেক আইডি খুলে যেকোনো মানহানীকর পোস্ট দিলে সাথে সাথে আসল ব্যক্তিটি গ্রেফতার হয়ে যাবেন। যেহেতু আইনটি জামিন অযোগ্য কাজেই তদন্ত শেষ করে সত্য বেরিয়ে আসার আগ পর্যন্ত কমপক্ষে ১২০ দিন কারাদ- ভোগ করতে হবে নিরাপরাধ ব্যক্তিটিকে। আইনটি যে কতোটা ত্রুটিপূর্ণ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেটা বুঝতে এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণ নয় টার্গেটেড অপরাধী বা নিরাপরাধী নিয়ন্ত্রণে এটি একটি হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। তথ্য প্রযুক্তি আইন পাস হয়েছে, কিন্তু পর্ণোগ্রাফির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তা উদ্বিগ্ন করেনি। স্যোশাল সাইটগুলোতে ইসলাম বিদ্বেষী পোস্ট ও সাইটের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ আইন তাদের নিয়ন্ত্রণ বা নিরত করতে পারছে না। কিন্তু এসব সাইটের কথা গণমাধ্যমগুলো লিখতে পারছে না। নাস্তিকরা ইসলাম বিরোধী প্রচারণা সবেগে চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু নাস্তিকদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো যাচ্ছে না। এ আইন আপরাধ বা অপরাধিকে ভয় দেখাচ্ছে না, ভয় দেখাচ্ছে অপরাধ যারা প্রকাশ করছে তাদের।
অপরদিকে সাইবার ক্রিমিনালরা সাধারণ ক্রিমিনাল নয়। এদের বেশিরভাগই অত্যন্ত মেধাবী। কাজেই তাদের অপরাধ সণাক্ত করা, তদন্ত করা স্বল্প শিক্ষিত পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া সাইবার অপরাধীরা প্রতিনিয়ত তাদের অপরাধের ধরন, পদ্ধতি পাল্টায় সফটওয়্যার প্রোডাক্টেও সাথে পাল্লা দিয়ে। কাজেই সাধারণ পুলিশ সদস্য দিয়ে তাদের সাথে পাল্লা দেয়া তাদের মানিটর করা, তাদের ক্রাইম ফাইন্ড আইট করা অসম্ভব। আইসিটি সেক্টর বিশ্বেও সবচেয়ে পরিবর্তনশীল সেক্টর। প্রতিদিন, প্রতিসপ্তাহে এর প্রডাক্টগুলো পরিবর্তিত হয়, আপডেট হয়, নতুন প্রডাক্ট যুক্ত হয়। কাজেই আইসিটি সেক্টরের টামর্স, প্রডাক্টের আপডেট, অপরাধের পরিবর্তনশীল ধরন সম্পর্কে প্রতিনিয়ত তদন্ত ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে আপডেট করা না গেলে এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি এ প্রযুক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট দক্ষ না হন তাহলে সাধারণ হয়রানির শিকার হবে এবং প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েবে। তাই সময়ের সময়ের দাবি একটি বিশেষায়িত এন্টি সাইবার ক্রাইম পুলিশ ব্যটালিয়ন গঠন করা। যার সদস্যরা ইলেক্ট্রিক স্বাক্ষর, ইলেক্ট্রিক ডেটা, ইলেট্রিক মেইল, ইলেক্ট্রিক রেকর্ডস, স্পাম, ম্যালওয়ার, হ্যাকিং, সফটওয়্যার প্রভৃতি সম্পর্কে আপডেট ধারণা রাখবেন। আবার শুধু পুলিশ দক্ষ হলেই চলবে না, এই আইনে বিচারকালেও সাইবারক্রাইম ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এক খবরে জানা গেছে, বর্তমানে মাত্র ১০ শতাংশ বিচারক কম্পিউটার জ্ঞানে পারদর্শী। কাজেই যে বিচারকগণ সাইবার ক্রাইমের বিচার করবেন তাদেরও এ বিষয়ে দক্ষ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। নয়তো আইসিটি ট্রাইব্যুনালের মতো বিচারকরাই সাইবার ক্রিমিনালদের টার্গেটে পরিণত হবেন। বর্তমান আইনে একটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল করার প্রস্তাব রয়েছে। সে অনুযায়ী সরকার সুপ্রিমকোর্টেও পরামর্শক্রমে ঢাকায় একটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। ইতোমধ্যে এই ট্রাইব্যুনালে জেলা জজ কেএম সাইফুল আমলকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু আইনি কিছু জটিলতার কারণে এতদিন ট্রাইব্যুনাল কাজ করতে পারেনি। বর্তমানে বিভিন্ন আদালতে এই আইনে বিচারাধীন মামলাগুলো এই ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হবে বলে জানা গেছে। কিন্তু দেশে যেভাবে আইসিটি প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে এরকম আরো অনেক আদালত গঠন প্রয়োজন।
বর্তমান আইনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো এ আইনটি প্রতিরক্ষামূলক, প্রতিরোধমূলক নয়। সাইবার ক্রিমিনালরা মুহূর্তেই এমন ক্ষতি করতে পারে যা আর কোনোভাবেই পোষানো সম্ভব নাও হতে পারে। তাই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি অপরাধ সংঘটনকেও বাধা দিতে হবে। যদিও প্রায় এ ধরনের লক্ষ্যে সরকার কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সিএসআইআরটি) গঠন করেছে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায় এমন সব ওয়েবসাইট শনাক্ত করবে এই টিম। এছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ওয়েব পেজ বন্ধ করে দেয়া এবং অপরাধীকে সতর্ক করা হবে। এতেও কেউ সতর্ক না হলে প্রচলিত আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা সিএসআইআরটি টিমের। সাইবার ওয়ার্ল্ডে ক্রাইমের মহামারি দেখে বাস্তবে আমরা এর কোনো সাফল্য দেখতে পাচ্ছি না। কাজেই সাইবার অপরাধ সংগঠনের আগেই তাকে থামানোর বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করতে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান আইন তথ্য-প্রযুক্তি প্রসারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বেসিস মহাসচিব যথার্থই এ আইনকে ইন্টানেটের কারাগার বলে আখ্যা দিয়েছে। গুগল, ফেসবুক, মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রাইভেসি আইন শিথিল করার জন্য আবেদন করেছে তখন বাংলাদেশে এ আইন উল্টো পথে যাত্রার শামিল। নাগরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি নাগরিক অধিকার ও নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও নিশ্চিত করতে না পারলে চলমান আইন কখনোই একটি ভালো আইন হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না।
উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (সংশোধন)-২০১৩ তে নানা ত্রুটি বিচ্যুতি রয়ে গেছে। ফলে এ আইনটি তার প্রকৃত লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। বরং অসৎ উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে এটি ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা জনগণের ওপর নিবর্তনমূলকভাবে আরোপিত হতে পারে। অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশ বা একটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে বাস্তবসম্মত ও কার্যকর তথ্য প্রযুক্তি আইনের কোন বিকল্প নেই। অন্যভাবে বলা যায়, একটি যুগোপযোগী ও কার্যকর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ছাড়া সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি অসম্ভব শুধু নয়, এ ধরনের আইনের অভাবে জাতীয় স্বার্থ¡ ও নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে থাকবে। তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দূরে সরিয়ে রেখে জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য দিয়ে সরকার বর্তমান আইনকে কার্যকর ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে নির্মোহভাবে সংশোধন করবে তা দেশবাসীর প্রত্যাশা। সেক্ষেত্রে আইসিটি সেক্টরের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করে প্রাপ্ত পরামর্শকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার করাই জাতীয় লক্ষ্য হওয়া উচিত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ও পর্নোগ্রাফীরোধ আইনসহ এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। এসব আইন যথাযথভাবে কার্যকর করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে দক্ষ জনবল তৈরিতেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
email:[email protected]