স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর মঙ্গলবার সকালে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকালও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে অনড় ছিলেন। তবে আটজনকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার বেশি পার হলেও গতকাল পর্যন্ত কাউকে আদালতে হাজির করা হয়নি। আজ সকালে আদালত যখন খুলবে তখন ওই সময় ৪৮ ঘণ্টা পার হবে। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আদালতে হাজির করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে_ গ্রেফতার হওয়া তারা কোথায়? আসলে কেউ গ্রেফতার হয়েছে, নাকি হয়নি? অনেকের বক্তব্য, আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের কেন আদালতে নেওয়া হয়নি? যদিও বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে গ্রেফতারের কথা প্রকাশ্যেই অস্বীকার করেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর
পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশ ছয়জনকে শনাক্ত করেছে। তবে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে আটজনকে মঙ্গলবার আটক করা হয়েছে।
অনেকের প্রশ্ন_ বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার নিয়ে কেন এই লুকোচুরি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের গ্রেফতার নিয়ে সমগ্র জাতিও অন্ধকারে রয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর গতকালও জাতীয় জাদুঘরে একটি অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকা ের সঙ্গে ছাত্রলীগ কোনোভাবেই জড়িত নয়। হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার হওয়া আটজনকে কেন আদালতে হাজির করা হয়নি_ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গতকাল সমকালের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মোবাইল ফোনে একাধিক দফায় যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ সমকালকে বলেন, সংবিধানে বলা আছে_ সন্দেহভাজন হিসেবে কাউকে গ্রেফতার করা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে উপস্থাপন করতে হবে। এখানে ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এটা একজন ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার। যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রেফতারের কথা বলে থাকেন, আর যদি তাদের আদালতে উপস্থাপন করা না হয়, তাহলে সেটা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এমনকি বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় গণমাধ্যমে যাদের নাম-ছবি প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত দৃশ্যমান কাউকে গ্রেফতারের কথা গতকাল পর্যন্ত পুলিশ স্বীকার করেনি। যদিও বিভিন্ন সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে নাহিদ, শাকিল ও ওবায়দুলকে আটক করে। নাহিদকে রাজধানীর আরামবাগ ও শাকিল-ওবায়দুলকে সাভারের আশুলিয়া থেকে আটক করা হয়। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশ তাদের আটকের ব্যাপারে মুখ খোলেনি।
১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রোববার সকাল পৌনে ৯টার দিকে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে ছাত্রলীগ আর বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর বিশ্বজিৎ দাসকে রড-লাঠি আর ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ ক্যাডারদের নাম-পরিচয় ইতিমধ্যেই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এমন মৃত্যুর পর সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিশ্বজিৎ হত্যায় জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এর আগে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর দাবি করেছেন, বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মন্ত্রী আরও দাবি করেন, বিশ্বজিৎ হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের কেউই ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত নন। যারা আছেন, তারা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত।
পুুলিশের ওয়ারী জোনের ডিসি মোজাম্মেল হোসেন সমকালকে বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যায় গ্রেফতার হওয়া আটজনের ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেফতারের ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অল্প সময়ের মধ্যেই সব পরিষ্কার হবে।
প্রথম হামলাকারী রাজন : প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রোববার ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে বিশ্বজিতের ওপর প্রথম ছাত্রলীগের যে কর্মী হামলা চালান তার নাম রাজন তালুকদার। বিশ্বজিৎ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাহাদুর শাহ পার্কের উল্টোদিকে ভিক্টোরিয়া ইনটেনসিভ ডেন্টাল কেয়ারের দোতলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাকে অনুসরণ করে রাজন প্রথমে দোতলায় ওঠে বিশ্বজিতের পিঠে লোহার রড ঢুকিয়ে সটকে পড়েন। এ কারণে কোনো গণমাধ্যমে তার ছবি প্রকাশ হয়নি। এরপরই নিচ থেকে ছাত্রলীগের কর্মী শাকিল, তাহসিনসহ আরও বেশ কয়েকজন কর্মী ওপরে ওঠে। তাহসিন বিশ্বজিৎকে এলোপাতাড়ি রড দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এ সময় লিমন, ইমদাদ, নাহিদসহ অভিযুক্তরা তাকে লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। এর মধ্যেই শাকিল চাপাতি দিয়ে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে জখম করে। এরপর দোতলা থেকে তিনি পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করলে হামলাকারীরা তার পিছু নেয়। ভিক্টোরিয়া ইনটেনসিভ ডেন্টাল কেয়ারের নিচতলায় বিশ্বজিৎকে দ্বিতীয় দফায় আঘাত করে তারা। এদিকে গতকাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কোনো কর্মীকে দেখা যায়নি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শরীফুল ইসলাম গতকাল কিছু সময়ের জন্য ক্যাম্পাসে আসেন। ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে এখন গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। এছাড়া বিশ্বজিৎ হত্যায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে গতকাল পর্যন্ত কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয় ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন, অভিযুক্তরা ছাত্রলীগের কর্মী নন। যদিও ঘটনার দিন অবরোধবিরোধী মিছিলে প্রথম সারিতেই বিশ্বজিতের ওপর হামলাকারীদের অনেককে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে।
নেপথ্যে যারা : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে যাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে তাদের অনেকের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এক যুগ্ম আহ্বায়কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ওই নেতা বর্তমানে যুবলীগের পদপ্রত্যাশী। এমনকি রোববার বিশ্বজিতের ওপর আক্রমণের পর অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে সাবেক ওই যুগ্ম আহ্বায়ক বৈঠক করেন। বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া ফুজি গলিতে তাদের ওই বৈঠক হয়। বিশ্বজিতের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন তার গ্রুপের সক্রিয় কর্মী ছিল। অভিযুক্ত শাকিল ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগে যোগ দেন। শুরু থেকেই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংঘর্ষের নেতৃত্ব ছিল তার হাতে। ক্যাম্পাসের আশপাশে বিভিন্ন দোকান ও ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে কয়েকবার তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করা হয়।
নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার জানান, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি শাকিল ওরফে কিবরিয়া ও তার সহযোগী ওবায়দুলকে আটক করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ দল। বুধবার সকালে আশুলিয়ার মধ্যগাজীরচট এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া মঙ্গলবার মধ্যরাতে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যতম আসামি নাহিদকে রাজধানীর আরামবাগ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় সূত্র বলছে, শাকিলের বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার সৈয়দ আতিকুর রহমান ৪ বছর আগে আশুলিয়ার মধ্যগাজীরচটে এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। তারা সেখানে বসবাস করেন না। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তবে মাঝে-মধ্যে বেড়াতে ওই বাড়িতে আসেন। নাম প্রকামে অনিচ্ছুক ওই বাড়ির এক ভাড়াটিয়া জানান, শাকিল মঙ্গলবার রাতে তার সহযোগী ওবায়দুলসহ ওই বাসায় আসে। গতকাল সকালে সাদা পোশাকে কয়েকজন লোক বাসায় হাজির হয়। পরে জানতে পারি তারা শাকিলকে গ্রেফতার করতে এসেছে। এরপর তারা শাকিল ও তার বন্ধু ওবায়দুলকে বাসা থেকে নিয়ে যায়। সূত্র বলেছে, শাকিল ও ওবায়দুলকে আটক অভিযানে এডিসি পদমর্যাদার 'ম' আদ্যক্ষরের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।View this link