somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইলশে গুঁড়ি

১৬ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৩:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইলিশের কেজি ১ টাকা।
নিজস্ব সংবাদদাতা: ভরা বর্ষায় এবার ব্যাপক আকারে ইলিশ ধরা পড়ার কারণে জেলেদের মধ্যে আনন্দের বান। কিন্তু বাঁধ সেধেছে হঠাত ট্রাক ধর্মঘট। ঢাকা সহ দেশের অন্যান্য স্থানে এবং কোলকাতায় পাঠানের জন্য ঝাকে ঝাকে ইলিশের ট্রলার বরিশাল ঘাটে এসে বিপাকে পড়েছে। মজুদ মাছের তুলনায় বরফের পরিমান কম হওয়ায় মাছ পচে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ১ টাকা কেজিতেও ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। বরিশালের ঘরে ঘরে ইলিশ ভাজার মৌ মৌ গন্ধ। দৈনিক ইত্তেফাক: ২৮ জুন ১৯৮৯।

দিন তারিখটা কাল্পনিক। তবে সংবাদের ভাষা এখনও চোখে জ্বল জ্বল করছে। বরিশালবাসীর কাছে ইলিশ এমনিতেই অফুরন্ত। তারপরও ইলিশের মওসুমে ট্রাক ধর্মঘটের জন্য কাতর অপেক্ষা। এতে ব্যবসায়ীদের বারটা বাজলে তাতে কি? নগরবাসী ডিমভরা ইলিশের ঝাঝে পরিতৃপ্ত জীবন উপভোগ। আহ কি যে দিন ছিল তখন! যদিও ১ টাকা দরে ইলিশ বিক্রি হওয়াটা অতিরঞ্জিত। দু’এক টাকায় হয়তো পাওয়া যেত, তবে তা প্রায় পচে, গলে যাওয়া মাছ। ১০/১৫ টাকায় ৭০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের ফ্রেশ মাছ পাওয়া যেত। আর ২০/২৫ টাকায়তো পেল্লাই সাইজের মাছ। ট্রাক ধর্মঘট উঠে গেলে আবার মাছ লাপাত্তা।

ইলিশ মাছের ভরা মৌসুমে পোর্ট রোডে ঘোরাফেরা করতাম যদি পরিচিত কেউ হঠাত পেছন থেকে ডাক দেয়, এই আশায় ;) । সে সময় ভোলা বা পটুয়াখালী/বরগুনায় বরফের কল ছিলনা বললেই চলে। ফলে মেঘনার জেলেদের বেশিরভাগই বরিশাল মোকামে মাছ বিক্রি করে বরফ নিয়ে আবার নদীতে ফিরে যেত। নিকট/দু:সম্পর্কের কারো কারো মাছের ট্রলার ছিল। এরকম কারো সাথে হঠাত দেখা হয়ে গেলে জোর করে ট্রলারে নিয়ে যেত। তারপর ট্রলারের পাটাতনের ঢাকনা খুলে বেছে বেছে সবচে’ বড় আট/দশটা মাছ ব্যাগে ভরে রিকশায় উঠিয়ে দিত। একেকটা পেল্লাই সাইজের মাছ , ২ কেজির কম নয়। রিক্সা থেকে নামানো সে আমার মতো প্যাকাটের কম্মো নয়। হাক ডাকে বাসার সবাই নেমে আসতো। তারপর কাটাকুটির মহোতসব। পাড়া পড়শি সব ভেঙে পড়তো আমাদের উঠানে। সে কি উচ্ছাস। তখন ভার্চুয়াল সামাজিক নেটওয়ার্ক না থাকলেও রিয়াল সামাজিক নেটওয়ার্ক ছিল ভয়ঙ্কর রকমের । ফলে পাড়া পড়শির মধ্যে ব্যপক বিতরণ চলতো। কিছুদিন যেতে আবার বাসায় সমপরিমান মাছের সমাগম। এবার আর বেহায়ার মতো পোর্ট রোডে যেতে হয়নি। কেউ বাসায় এসে দিয়ে গেছে। এত মাছ দিয়ে কি করা যায়। গামলা ভর্তি ভাজা মাছ, ভাজা ডিম। বড় বোন, মেজো বোন ইলিশের নানা রকম রেসিপি পরিক্ষার অবারিত সুযোগ। এতো মাছ যে, ভাজা ইলিশ মুড়ি দিয়ে খাওয়ারও বেশ প্রচলন ছিল বাসায়। মা আবার বহু কসরত করে নোনা ইলিশ প্রক্রিয়াজাত করতো। বাজার থেকে ইলিশও কেনা হতো হরহামেশা। ১৫/২০ টাকায় একটা মাঝারি ধরনের ইলিশ। ইলিশের মৌসুমে অন্য মাছের সমাগম এতই কমে যেত যে বাধ্য হয়ে প্রতিদিনই ইলিশ চালাতে হতো। শুধু দুর্গা পুজার পরবর্তী কদিন ইলিশের আকাল (আগে না পরে মনে করতে পারছিনা)।

ইলিশ কেনার মধ্যেও কিন্তু আর্ট ছিল। বিক্রেতার ইলিশের কানকোর মধ্যে দিয়ে নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে রিং বানিয়ে দিত যাতে আঙুলে ঝুলিয়ে ইলিশ বহন করা যায়। ব্যাগের মধ্যে নিলে ইলিশের জাত থাকেনা। আর ঝুলিয়ে নিলে পাব্লিকের প্রশ্নবানে ক্রেতা জর্জরিত হলেও উপভোগ্য ছিল। ইলিশ আঙুলে ঝুলিয়ে নিয়ে যাবেন, আর দশজনে দাম জিজ্ঞাসা করবেনা এমনটা এ তল্লাটে হতে দেয়া যাবেনা। রাজার সাথে বাজী ধরে শুধু গোপাল ভাড়ই একবার কারো জিজ্ঞাসা ছাড়া বাজার থেকে ইলিশ ঝুলিয়ে রাজ প্রাসাদে আসতে পেরেছিল। শুধু নিন্মাঙ্গের পরিধেয় বস্ত্রটা মাথায় উঠাতে হয়েছিল :)

ইলিশের স্বাদ নিয়ে আমাদের মধ্যে নানামুখি বিতর্ক প্রচলিত। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক পদ্মার ইলিশের সর্বোতকৃষ্টতার পক্ষপাতি। টিটাগাংয়ের পাব্লিক আবার গোত্তা সাইজের ইলিশ পছন্দ করে। কিছু নারী আছে বিশালধারী কিন্তু কমনীয়তা কম, চিটাগাংয়ের ইলিশ ঠিক সেরকম। যমুনার ইলিশ সবচেয়ে কুশ্রী, দেখতে যেমন স্বাদেও ঠিক তেমনি। পদ্মার ইলিশ আসলেই বেস্ট। তন্বী তরুণীর মতো পেলব, কমনীয়তায় ভরপুর, আবার সৌন্দর্য্যও অতুলনীয় :P । মেঘনার ইলিশ আবার বেশী পরিমান যৌবনবতী, থলথলে, তবে স্বাদে, সৌন্দর্যে বেশ উচ্চ- মধ্যবিত্তে টাইপের। তবে এত ইলিশের মধ্যে বরিশালের কীর্তনখোলার ইলিশই সর্বোতকৃষ্ট তা ভুক্তভোগীরাই শুধু জানেন। অবশ্য এই কীর্তনখোলার ইলিশ আবার ক্লিওপেট্ট্রা, মাতা হারি বা অড্রে হেপবার্নের মতোই দুর্লভ সুন্দরী। শতাব্দিতে একবারই জন্মে। কালে ভদ্রে যখন কীর্তনখোলায় ইলিশ ধরা পড়ে, অমনিই ঝাকায় নিয়ে শহরের দিকে দে ছুট। চক বাজার দিয়ে ছোটার সময়েই ব্যবাসায়ীরা ছো মেরে অর্ধেকটা তুলে নিয়ে যায়। গুলবাগের সামনে যেতে যেতে খুব কমই অবশিষ্ট থাকেনা। (তখনকার দিনে বিবির পুকুরের পশ্চিমপার অতটা জমজমাট ছিলনা)। এই মাছ বিক্রির কিছু কেতা আছে। যার তার কাছে বিক্রি করতে মন সায় দেয়না, তা টাকা বেশি থাকলেও নয়। হোমড়া চোমড়া, শহরের গণ্যমান্যদের কাছে বিক্রি করতে পারলেই বিক্রেতার সন্তুষ্টি। আবার কালাবদর বা তেতুলিয়া নদীর ইলিশকেও অনেক সময় কীর্তনখোলার ইলিশ বলে চালিয়ে দেয়ার ধাপ্পাবাজি চলে। কীর্তন খোলার ইলিশের বৈশিষ্ট্যই অন্যরকম । আকৃতিতে খুব বড় নয়, তবে সদ্য পানির স্পর্শ ছেড়ে যাওয়া রূপালী রঙের সাথে একটি রক্তিম আভা সন্ধার সৌন্দর্যকেও ম্লান করে দেয়।

ইলিশের ভরা মৌসুমে বরিশাল নগরবাসীর রান্নাঘর এখন আর ইলিশের গন্ধে মৌ মৌ করেনা। প্রযুক্তির উন্নয়ন ইলিশ প্রক্রিয়াজতকরণেও চলে এসেছে। তাই আর এ শহরে ইলিশের অনুপস্থিতি শুধু হাহাকার বাড়ায়। নগরবাসীর সামনে দিয়েই প্যাকেটজাত হয়ে ইলিশ চলে যায় কলকাতাবাসীর সেবায়। বছর দুয়েক আগে বেহালায় এক খাবার দোকানে খাবার মেন্যু দেখে বললাম ইলিশ নেই। দোকানী জানালো দাদা ইলিশতো আপনাদের দেশের মাছ। আপনারা খেয়ে পড়ে যখন ছোট খাট দু একটি পাঠান তা আমাদের পাতে পড়ে। হোটেলে বিক্রি করার মতো সৌভাগ্য কি আমাদের আছে। মনে মনে গালি দেই ’হারামজাদা’ উল্টো গান গাচ্ছিস। আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে খাচ্ছিস আবার মশকরা করছিস। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিন্দুমাত্র দেশপ্রেম থাকলে ইলিশের জন্য শুধু ওপার বাংলা থেকে লুল ফেলেই জীবন কাটাতি।


অট. ইলিশের কথা মনে হলেই সাদেক আলী (আসল নামটা মনে নেই)র কথা মনে পড়ে, আর মনে পড়ে জাটকা মাছ নিধন বন্ধে তার বিজ্ঞাপনটি। মাছের গুষ্ঠি দেখাও ফাল, লগে আনছি কারেন্ট জাল................ঝাকে ঝাকে জাটকা, ইলিশ খামু টাটকা, ইলিশ মাছের পোনারে, টাকার খবর সোনারে। সাদেক আলীকে খুব মিস করি। না ফেরার দেশে ভালো আছে নিশ্চয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৩:১১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×