মায়ের কোন হ্যান্ডব্যাগ ছিলনা।
থাকার কথাও নয়। দিনের বেশিটা সময় রান্না ঘরেই ব্যস্ত দেখতাম। বাকী সময়টা ঘরের এখানে এখানে। কাজেই হ্যান্ডব্যাগটা তার জন্য বেমানানই ছিল। কদাচিত দুরে কোথাও বেড়াতে গেলে বিশাল সাইজের ব্যগগুলাই ছিল ভরসা। এখন তার অবসর। বাবা স্মৃতি হয়ে যাওয়ার পর ছেলে মেয়েদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেই সময় কাটে। কাজেই শেষ বয়সে তার একটা হ্যান্ডব্যাগ জুটেছে। তাতে মোবাইল, খুচরো টাকাপয়সা ইত্যাদি থাকে।
জীবনে বাবার পকেট কম কাটিনি। মায়ের আলমারীর গোপন কুঠুরিতে হামলা হয়েছে নিয়মিত। কিন্তু হ্যান্ডব্যাগ দেখার সুযোগ হয়নি। আদিম চৌর্যবৃত্তির আহ্বানে তাই একদিন মায়ের হ্যান্ডব্যাগে অভিযান চালালাম। খুচরা কিছু টাকা, কয়েন, টিস্যু পেপার টুকিটাকি কিছু জিনিষপত্রের সাথে ভাজ করা দু একটা কাগজ। কৌতুহলী হয়ে খুললাম- ২২৬ রোকেয়া হল থেকে লেখা দিনু আপার চিঠি। উপরের দিকটা মলিন হয়ে গেছে। ভেতরে গুটগুটে হাতে লেখা হল জীবনের প্রথম দিককার বিভিন্ন সমস্যা আর মজার বিষয়, ডাবলিং করতে অনেক কষ্ট হয়। বিয়ের পরেই দিনু আপা দেশের বাইরে চলে গেছেন। মা হয়তো এই চিঠির প্রতিটি অক্ষর স্পর্শ করেই দিনু আপাকে খুজে পান।
হাতে লেখা চিঠির একেকটি অক্ষর এক একটি মুহুর্তকে মুর্ত করে তোলে। প্রতিটি অক্ষর যেন এক একটি প্রাণ, সেই প্রাণ মুহুর্তের মধ্যেই প্রাণ পল্লবে যে মুর্ছনা তোলে, যেন পৃথিবীর গহীন কোন প্রান্ত থেকে উঠে আসা একটুকরো সুখছবি, এক একটি চিঠি কত উচ্ছ্বাস, কত অশ্রু, কত আশা মানব নামে অস্থির এক প্রাণীকে প্রভাবিত করতো। সে সব আজ অতীত, আজ আর কারোই চিঠি লেখা হয়না, মহুর্তের মধ্যেই সেল ফোনে সকলকে ধরা যায়, প্রতিটি মুহুর্তের খোজ নেয়া যায়। তবে চিঠি যতটা আপন করে স্বজনকে কাছে টানে সে টানটা সেল ফোনে হয়না, আমাদের আবেগটা নিয়ে সেল ফোন ব্যবসা করে যায় আর তাতেই আমরা সুখ খুজি, আসলে সুখ নয়, দায়িত্ব পালন করার স্বস্তি।
সেলফোনেও চিঠি লেখা চলে, এসএমএস এর আকারে, কিন্তু তাতে প্রাণ কতটা ধরা দেয়! চিঠির প্রতিটি অক্ষরে হাত বুলিয়ে ছটফট করা সুখটাকে যতটা শুষে নেয়া যায়, এসএমএস এ কি সেটা সম্ভব? কেউ হয়তো বলবেন দুনিয়াটা এখন অনেক দ্রুত গতির, এসব সেকেলে সিস্টেম চলবে কেন? মোটেও সেকেলে সিস্টেম নয়, আসল কথা হলো আমরা পালাতে চাচ্ছি, তাই সেলফোনে সংক্ষিপ্তকারে আমাদের দায়িত্বগুলো সেরে ফেলি।
ইংল্যান্ডে বড়দিন আর নতুন বছরে এখনও যে পরিমান গ্রিটিংস কার্ড পাঠানো হয় তার সংখ্যা নাকি মোট জনসংখ্যার দ্বিগুন, পুরো ইউরোপেও নাকি তাই। অথচ আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধাটা ওদেরই বেশি। কিন্তু ওরা ঐতিহ্যটা বিসর্জন দেয়নি। অথচ আমরা ঐতিহ্যটা সহজেই বিসর্জন দিয়ে দিলাম প্রযুক্তির ধোয়া তুলে। হ্যা, একটা সময় আমাদের এখানেও বিভিন্ন পার্বণে গ্রিটিংস কার্ড এর বেশ প্রচলন ছিল, বিশেষ করে দুই ইদ, নববর্ষ ইত্যাদি সময়ে। কিন্তু এখন এসএমএস এর বন্যার সাথে চলে ইমেইলে ই কার্ড, অথচ একসময় নতুনত্ব আনার জন্য হাতেও অনেক কার্ড তৈরি করা হতো।
কিশোর বয়সের প্রেমের প্রারম্ভিকার প্রধান উপাদান ছিল এই চিঠি। কাচা হাতে ভাবী প্রিয়তমাকে লেখা চিঠি ভুল হাতে পড়ার পর কত বালকের প্রেমরোগ অকালে ঘুচিয়া গেছিল তার ব্যাপক উপাত্ত পাওয়া যাবে। মনির খানকে যতই ক্ষ্যাত গায়ক বলিনা কেন তার ‘চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙা ভাঙা হাতে’ – গানটি খেয়াল করে দেখুন - এর ভেতর আবহমান গ্রামীন বাংলার পটভুমিতে দাম্পত্য সুখাভিমানের এক অসাধারণ আবহ ফুটে উঠেছে।কিংবা বাচ্চুর শেষ চিঠি কেন এমন চিঠি হয় – বিক্ষত চিত্তের ব্যথার একটু উপশম বললেও কম বলা হবে।অথবা মহেশ গফুরের অবস্থা জানাতে চেয়ে শরত বাবুকে মান্নাদের গাওয়া খোলা চিঠি আমাদের এখনও আপ্লুত করে।
কিশোর বয়সে অবশ্য চিঠি নিয়ে প্রেমজনিত বিড়ম্বনার পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গণেও বিড়ম্বনাও কম ছিলনা। একটি চিঠির কয়টি অংশ – এর উত্তর ভুল হলে কিন্তু সহজে পার পাওয়া সম্ভব ছিলনা। আবার যাতে ভুল না হয় সেজন্য এতদসঙ্গে না হয় জুড়েই দিলাম - ১।চিঠির ওপরের অংশ মঙ্গল সূচক শব্দ। ২।চিঠির ওপরের অংশের ডান কোনে স্থানের তারিখ । ৩।চিঠির ওপরের অংশের বাম দিকে প্রাপকের উদ্দেশে সম্বোধন। ৪।চিঠির বক্তব্য বিষয়। ৫।চিঠির শেষে ডান দিকে লেখকের স্বাক্ষর ও ঠিকানা। ৬।চিঠির শিরোনাম। আবার চিঠিতে বিরাম চিহ্নের যথার্থ প্রয়োগের অভাবটাও অনেক কিংবদন্তী বাক্যের জন্ম দিয়েছে। যেমন - এই ছিল আমার কপালে তোমার পা.....................অথবা শহরে পড়তে আসা তরুণ পুত্র কন্যাদের প্রতি উদাসীন পিতাকে টাকা পাঠানোর বিষয়ে সচেতন করতে চিঠির ভুমিকাকে কে কবে অস্বীকার করতে পারবে?
এই চিঠি ছিল আমাদের একটা সংস্কৃতির সমৃদ্ধ অংশ, গর্ব করার মতো। এই উপমহাদেশে চিঠিকে উপজীব্য করে যে পরিমাণ সাহিত্য রচিত হয়েছে তা অন্য কোন ভাষায় বিরল। বুদ্ধদেব গুহর সবিনয় নিবেদনে ঋতি রায় আর রাজর্ষির অসাধারণ চিঠিগুলো দিয়ে যে রোমান্টিক আখ্যান সাজানো হয়েছে তা বাংলা সাহিত্যের অনন্য অর্জন নয় কি?বাংলাভাষার অন্যতম বিখ্যাত সাহিত্য-সাময়িকী ছিল ‘শনিবারের চিঠি’।১৯২৪ সালে প্রকাশিতএই সাপ্তাহিক কাগজটি ১৯৩০-৪০-এর দশকে কোলকাতাকেন্দ্রিক বাঙলা সাহিত্যের জগতে বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল। শনিবারের চিঠির ভাষা ছিল চরম ব্যঙ্গাত্বক, পিত্তি জ্বালিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল সমালোচনামূলক লেখাগুলোর মাধ্যমে। বিখ্যাত রাশিয়ার চিঠি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্র-প্রবন্ধ সংকলন। সোভিয়েত রাশিয়ার শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত মতামত ব্যক্ত হয়েছে এই গ্রন্থের চোদ্দটি পত্র-প্রবন্ধ ও চারটি প্রবন্ধে। গ্রন্থে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতা যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি উক্ত ব্যবস্থার নানা দোষত্রুটির দিকগুলি তুলে ধরে তারও সমালোচনা করেছেন কবি।
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চিঠির ভূমিকা বলে শেষ করা যাবেনা। কিছু দিন আগে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর আত্নজীবনীতে জেলখানা থেকে লেখা চিঠি পাঠককে আপ্লুত করে বারংবার।যাযাদিতে ফারুক চৌধুরির প্রিয় ফারজানা কিংবা গেদু চাচার খোলা চিঠি একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। ইন্ধিরাকে লেখা নেহেরুর প্রতিটি চিঠিতে ইন্দিরাকে রাজনৈতিক ভাবে গড়ে তোলার যে দিক নির্দেশনা ছিল তাতে চিঠিগুলো অমুল্য সম্পদের পরিণত হয়েছে। ইন্দিরাকে লেখা এই চিঠিগুলো নিয়ে নাকি দিল্লী ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিও করেছেন কেউ কেউ। আহা আমাদের তারুক কুকু কিংবা ডালিমকুমারকে যদি তাহার পিতামাতা গণ এরকম চিঠি লিখে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারতেন তাহলে হয়তো সীমাহীন দুর্নীতি থেকে কিছুটা হলেও জাতি রেহাই পেত।
আমাদের মুক্তির যুদ্ধগাথার সাহসী সৈনিকদের প্রিয়জনদের কাছে লেখা চিঠি নিয়ে একাত্তরের চিঠি সংকলনও আমাদের আরেকটি অমূল্য সম্পদ। ৮২ টি চিঠি নিয়ে এই সংকলন প্রতিনিয়ত আমাদের অপরাধী করে বীর সৈনিকদের চেতনাগুলোকে এখন বাস্তবে রুপ দিতে পারিনি বলে।
কি? চিঠি লেখা শুরু করবেন নাকি? ধরুন আপনার গুলশান-২ অফিস আর আপনার বৌ এর অফিস গুলশান -১ এ। প্রতিদিন ওকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে আপনি অফিসে যান। আর এক ছাদের নিচেতো নিত্য থাকা হয়। সব কিছুই বিনিময় হয় প্রতিনিয়ত। তারপরও একটি চিঠি লিখে তার অফিস ঠিকানায় পোস্ট করে দিন। দেখবেন কেমন হতভম্ব হয়ে যাবে। সে রাতটা যে অন্যরকম কাটবে সে বিষয়ে কিন্তু 100% গ্যারান্টি।
মহাদেব সাহার বিখ্যাত চিঠি দিও’র মাধ্যমে সমাপনী টানলাম
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ....
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! ...
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !
ছবি: গুগল মামা
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:২৪