ফুলের কাজ করা পর্দাটা জানালার ফ্রেম থেকে খুলে আনতে আনতে সোনিয়া দেখে, একটা মাকড়সা জাল বুনে রেখেছে ফ্রেমের পুব কোণে। তার হাত থেমে যায়। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি বাসায় কখনো ঝুল জমতে দেয় নি সে। অথচ পর্দার পেছনেই মাকড়সা সংসার পেতেছে।
এই বাসাটার নাম চড়ুইসংসার। সোনিয়া চড়ুয়িনী সেজে এখানে ঘাটি গড়েছিলো অনেকদিন ধরে। কিন্তু মানুষ তাদের ঘরের পাশে মুক্ত চড়ুইসংসার মানতে চায় না। ঈগলের বুকের ভেতর, শেয়ালের পেটের ভেতর ঘুমাতে অভ্যস্ত মানুষেরা তাই চড়ুইসংসার উচ্ছেদে আড়মোড়া ভাঙে। এবং সহসা সহজে উচ্ছেদ হয়ে যায়।
সোনিয়া জানালার পর্দা খুলতে গিয়ে মাকড়সার ঝুল দেখে বিষন্ন হয়ে উঠে। এত চেষ্টা এত সচেতনতার পরেও ঝুল! তার এক জীবনের সব নীড়ে কোনো না কোনো ভাবে মাকড়সারা জাল বুনে।
সেই কবে হাওয়াযৌবনে কিছু খড় কিছু কুটো জড়ো করছিলো সে, তমাল শাখায় হাওয়ানগরীতে। কিন্তু নগরীতে তখন রোদের তীব্র উত্তাপ ছিলো। তীব্র তাপে খড়কুটোতে আগুন ধরে আর তমালের ডালগুলো সব ঢাকা পড়ে যায় মাকড়সার জালে। সেই জালে সোনিয়ার পলকা চড়ুই ডানা আহত হয়ে গোত্তা খেয়ে পড়েছে মাটিতে।
তারপর রোদ কমে। হাওয়া জমে। শিশির জমে মাকড়সার ঝুলন্ত জালে। বাড়ে শীত। সোনিয়ার চড়ুইপনা নিস্তেজ হয়ে আসে। বাড়ে শীত। বাড়ে তার নির্লিপ্তি। তুষারপাত।
তবে তাই হোক, সোনিয়া ভাবে, এত তুষারে রক্তের উত্তাপ কম থাকুক তবুও কোনো মাকড়সা যেনো না আসতে পারে জাল বিস্তারে।
সতর্ক সোনিয়া তার চড়ুয়িনীবুকের উত্তাপে আগলে রাখে তুষারপাত। কোনো মাকড়সা যেনো নাগাল না পায়। সময় যায়। সুন্দর পরিপাটি তুষারঘরে চড়ুইপাখি ডিম পাড়ে, ডিমে তা ডেয়, ফুটফুটে বাচ্চা বের হয়। সোনিয়া সেই বাচ্চাকে বুকের উত্তাপে বড় করে।
দীর্ঘকাল তুষাররক্ষণ কিংবা চড়ুইশিশুর সাথে বন্টনের কারণেই হবে হয়ত, সোনিয়া দেখে তুষার গলে যাচ্ছে। গলতে গলতে একদিন তার চোখের সামনে একটা মাকড়সা দুলতে থাকে। সোনিয়া কেঁপে উঠে। জাল বুনছে মাকড়সাটা। গলে যাচ্ছে তুষারের স্তর, অন্য রুপে। এই রুপের পরিচয় সোনিয়ার জানা নেই।
সোনিয়ার চোখের সামনেই সব তুষার গলে যায়, ঢাকা পড়ে যায় মাকড়সার জালে। মত্ত স্রোতে ভাসে তার চড়ুইঘর। শিশুটিকে আঁকড়ে ধরে সেও ভাসে। ভাসতে ভাসতে একদিন এই প্রস্তরনগরে। নিয়তির সূত্র মেনে সেও ঢুকে নাগরিক মিছিলে। কোনো এক দালানের ঘুলঘুলিতে মাথা গুঁজে। চড়ুইপাখির ডানায় ভর করে না আর বিকেলের রোদ। সকালের হাওয়া কিংবা দুপুরের উদাসভাব। কেবল মধ্যরাতে বুকের খুব গহীনে সুনসান বাতাস বয়।
এরকম এক মধ্যরাতে বেজে উঠে সুরের সিম্ফনি। সোনিয়ার পালকের ভেতর পুলক জাগে। মধ্যরাতে মুগ্ধ কে এসেছে! ভোরের বাতাসে কে ছড়াল এত আবীর!
আবীরের স্পর্শে বিকেলের আকাশ কবিতার মত লাগে। দুপুরের রোদে হাজার গান বেজে উঠে। গল্পে ভরে উঠে চড়ুইসংসার। মাতাল ডানা ঝাপটায় আহত চড়ুয়িনী।
আবীরমাখা আকাশকবিতাতেই মুগ্ধ সোনিয়া ভুল করে। কবিতাপাঠে ভুল হয়ে যায়। প্রিয় কবিতার খাতা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলতে চায়। আবার কবিতাতেই চুমু খায়।
ভুল হতে থাকে দৈনন্দিনতায়। আবীরের রঙ কমে যেতে থাকে। ভীত সোনিয়া মাকড়সার জাল ভাঙে। ভাঙতে গিয়েই জালসূত্র ভুল করে। আগলে রাখতে চায় ডানার নিরাপত্তায়। ডানার তাপে এক আকাশ আবীর তেপান্তরে ছড়িয়ে যায়। তেপান্তর মুক্ত হাওয়ার পূজারি। আগলে, হোক না সে স্নেহের ভালোবাসার, তার দম আটকে আসে। সোনিয়া প্রেম বোঝে, মুক্তপ্রেমের নির্মাণ বোঝে না। স্নেহের আগল বোঝে কিন্তু এর বিবমিষা বোঝে না। মুক্ত হাওয়ার মত প্রেমের রুপ জানে না।
আবীর রঙ হারায়। তেপান্তরে জল মরে যায়। চড়ুইসংসারে আলো কমে আসে। মুক্ত আকাশে মুক্ত রঙকেলির নাম আবীরখেলা, তারে মুঠোয় জড়ালে রঙহীন ধূলিময়। খোলা বাতাসের ভেতর মুক্ত প্রান্তরেই সাজে সজীব তেপান্তর। তারে বাধতে গেলেই ঊষর ভূমি।
সোনিয়া ভুল করে সূত্রপাঠে। চড়ুইসংসারে অন্ধকার নামে। সারারাত কোথাও কোনো সুর আর বাজে না। কেবল একলা জেগে থাকে চড়ুয়িনী চোখ।