জীবনপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করে ২৪ নম্বর রুট ধরে যে বাসটা ছুটে চলছে অন্ধকারের শিরায় শিরায়, সে বাসটার মাঝখানের কোনো একটা দাগ-নম্বরবিহীন সীটে বসে বসে যখন ঝিমাচ্ছে আনোয়ার, তখন তার প্রেমিকা রেহানা আন্তঃনগর ট্রেনের ২২ নম্বর কেবিনে পায়ের উপর পা তুলে হাতে ধরা আয়নায় গালের রঙের প্রলেপ ঠিক করে। কেবিনের মৃদু আলোয় রেহানা কে অনেক ফর্সা ও সুন্দর এবঙ সর্বোপরি রঙহীন মনে হয়।
মোশতাক বসে বসে রেহানাকে দেখে। রেহানা দেখে আয়না। এভাবে কয়েক মিনিট পার হয়ে যায়। ওরা টের পায় না। মোশতাকের সাথে রেহানার পরিচয়ের দৈর্ঘ্যের তুলনায় ঘনিষ্ঠতার প্রস্থ দৃষ্টিকটুভাবে বেশী হয়ে উঠতো, যদি অন্তত একজোড়া চোখ তাদের সম্পর্কের ব্যপারে আগ্রহী হতো। বদ্ধ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে ওদেরকে দেখার মত চোখঅলা কেউ নেই, যারা আছে তাদেরকে গ্রাহ্য না করলেও চলে। অগ্রাহ্যযোগ্যদের মধ্যে অন্যতম, রেহানার হাতে ধরা আয়না আর মোশতাকের হাতঘড়ি। হাতঘড়ির কাঁটা তিনটা এই মুহুর্তে একজায়গায় থেমে গেছে এবঙ ঠিক এক সেকেন্ড পরেই আলাদা হয়ে দৌড় দেয় লম্বা ও চিকন কাঁটা টা। রাত বারোটা।
আগেই বলা হয়েছিলো, রাত বারোটায় মহাসড়কের গা ঘেষে দাঁড়ানো একটা হোটেলে থামবে বাস। থেমেছে। প্রায় ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে থেকে কিছুটা হালকা বোধ করছে আনোয়ার। মনের মধ্যকার মেঘগুলো কেটে যেতে শুরু করেছে। ক্ষুধা নেই। আছে তৃষ্ণা। অপ্রকৃতার্থে তৃষ্ণা মেটানোর আশায় এককাপ চা নিয়ে মুখের ভেতর দুধলিকারে সিগারেটের ধোঁয়া ডুবিয়ে ভিজিয়ে পান করে সে আরো তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে। প্রবল অপ্রতিরোধ্য তৃষ্ণায় আনোয়ারের চোখে সমস্ত অন্ধকার তরল হয়ে ধরা দেয়। সে পান করতে থাকে পাগলের মত। বিশ্বচরাচরের সব আলো নিভে গিয়ে অন্ধকারের তারল্য বাড়াতে থাকে। বাড়তে বাড়তে অন্ধকার চাঁদের উঠোনে হাজির হয়। ডুবে যায় চাঁদ।
কেবিনের জানালার ঘোলা কাঁচের ভেতর দিয়ে রেহানা চাঁদের ডুবে যাওয়া দেখতে ঘাড়ে মোশতাকের নিঃশ্বাস অনুভব করে। সেই কবেই সমস্ত অস্বস্তিকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে সে। তাই খুব সহজেই নিজেকে নমনীয় হয়ে যেতে দিতে পারে, পারে মোহহীন অনুভবে এঁকে নিতে মোশতাকের হাতের কাজ, শরীরের ক্যানভাসে। মোশতাকের ঘেমে না যাওয়া পর্যন্ত নিজেকে ঘামতে দিয়ে রেহানা নেমে পড়ে। কেবিনের টয়লেটে পানি ঢেকে ধুয়ে ফেলে সব ঘাম। তারপর ফিরে এসে বসে নুয়ে পড়ে থাকা মোশতাকের মাথার পাশে। মোশতাক রেহানার ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা, কোনো কিছুই পায় না। ট্রেনের কাঠদেয়ালে মাথা রেখে রেহানা চাঁদের বেরিয়ে আসা দেখে অন্ধকার ফুঁড়ে।
চাঁদ উঠে গেছে আবার। জানালা দিয়ে চাঁদের আলোর লম্বা একটা ফালি এসে পড়ে আনোয়ারের কোলে। বাসটা আবার চলতে শুরু করেছে। কোনো সীট খালি নেই, বাসভরা যাত্রী। ঠান্ডা হাওয়া থেকে গা বাঁচাতে জানালা টেনে দেয়ায় চাঁদের আলো হয়ে গেছে ঝাপসা। জানালার কাঁচ তখন ঝাপসা আয়না। আনোয়ার সেই ঝাপসা আয়নায় মুখ দেখে। নিজের মুখ। রেহানার কিশোরী মুখ। যে মুখটাকে সে ভালোবেসেছে আকৈশোর। যৌবনে এসে যে মুখটা ধরা দিয়েছে আনোয়ারের হাতের ভেতর। সেখানে কেবল কাতর চোখ ছিলো, তৃষাভরা ঠোঁট ছিলো। আহবান ছিলো তৃষ্ণা মেটানোর। আনোয়ার প্রগাঢ় চুম্বনে চুষে নিয়েছে রেহানার সব তৃষ্ণা। আজ সন্ধ্যায়। রেস্টুরেন্টের আবদ্ধ কেবিনে। সামাজিক চোখে রেহানা তখন মোশতাকের ইচ্ছাপূরক।
ইচ্ছাপূরণ শেষে মোশতাক ঘুমিয়ে গেলে মুঠোফোনে চোখ রাখে রেহানা। ডায়াল করে ০১... ... ...।
মোশতাক ঘুমায়া পড়ছে?
হ।
এত তাড়াতাড়ি! আজ রাতে বাঁচলা তাইলে।
হা হা হা। বাঘ তার খাবার খেয়ে নিতে দেরীও করে না, ভুলও করে না। একটু আগে নিয়ে গেলো রাতের অধিকার।
আনোয়ার প্রত্যুত্তর করে না।
তোমার বাস এখন কই?
আয়নায় তোমারে দেখতেছিলাম। আয়নার ওপাশে অন্ধকার।বুঝতাছি না কই আছি।
কখনো কি বুঝতে পারছিলা?
তা ঠিক। বোঝার আগেই তো গান শেষ। আমি কেবল বাজনা শুনে গেলাম।
চাইলে নিজেই গান ধরতে পারতা। এত রাইতে আয়না দেখতে হইতো না।
এতদিন পর অনির্ধারিত তৃষ্ণামেটানোর তৃপ্তি পাইতা না তাইলে।
চিড়িয়াখানা গেছো কখনো,আনোয়ার?
হ।
বাঘ দেখছো?
হ। ক্যান জিগাইলা?
পোষা বাঘ দেইখা চোখের সুখ নিলা। কিন্তু বাঘ পোষার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারলা না।
আনোয়ার কোনো কথা বলে না।
আনোয়ার, যখন তোমারে ভাবলাম ভুলে গেছি, ঠিক তখনি চোখের সামনে নিজেরে আইনা তুমি প্রমাণ করলা, আমি ভুল ভাবছি। যখন তোমারে করুণা করতে গেলাম, বুঝাইয়া দিলা তুমি পোষ মানতে জানো। আমার সর্বনাশ করলা। আবার ভালোবাসতে হইলো তোমারে।ক্যান করলা এমন?
আমি জানি না, রেহানা। হঠাৎ মনে হইলো,মাঝে মাঝে ক্রেজি না হইলে লাইফে অনেক কিছু হারাইতে হয়। সেই হারানোর দু'এক কণা ফিরা পাওনে তুমি ব্যথা পাইলে আমি ক্ষমা চাই।
ক্ষমা করতে করতে আমি ক্লান্ত। আর কত ক্ষমা করবো? পারলে একবার বাঘ হও। কথা দিলাম, শেষবারের মত ক্ষমা করুম।
রেহানা হয়তো আরো কিছু বলে কিন্তু আনোয়ার বুঝতে পারে না। বাসটা থেমে গেছে। সামনে রেলক্রসিং। রোডব্লক পড়ে গেছে। আসছে কু ঝিক ঝিক... ...
আনোয়ার ব্যস্ত হয়ে উঠে।
তুমি কী ট্রেনে আইতাছো না?
হ!
রেলক্রসিঙে এসে পড়ে আন্তঃনগর। ২৪ নম্বর রুটের বাসের ঘোলা জানালার কাঁচ ভেদ করে ঢুকে পড়ে আগুন্তুক ট্রেনের হুইসেল ও হেডলাইটের আলো। আর বাসের থেমে থাকা আলোয় চাঁদের জোছনা কিছুটা ম্লান হয় ২২ নম্বর কেবিনের জানালায়। রেহানা কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একমুঠো অন্ধকার নিয়ে। দ্রুতগামী ট্রেনের দরজার হাতল নাগাল পায় আনোয়ার। কিন্তু ফসকে যায় পা।
রেলক্রসিঙ পেরিয়ে আবার ছুটে চলে বাস। মাঝরাতে কেউ খেয়াল করে না, মাঝখানের একটা সীট খালি পড়ে আছে।