গ্যাস-বিদ্যুত-পানির তীব্র সংকট আর দুঃসহ যানজটের কারণে মন বসছিল না ঢাকায় হালে দফায় দফায় বাসা ভাড়া বৃদ্ধি, ক্ষণে ক্ষণে যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি, লাফিয়ে লাফিয়ে চাউল-ডাউল-তেলের মুল্য বৃদ্ধি, দৌড়ে দৌড়ে মাছ-মাংস আর তরি তরকারির মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমার মতো ছা-পোষা কেরাণীদের জন্য ঢাকার জীবন হয়ে উঠে মহাসঙ্কটময় তথাপি তল্পিতল্পা গোটাবো তারও জো নেই। কারণ গ্রামে তো রিজিকের ব্যবস্থা নেই! এ দিকে গরীবের ঘোড়া রোগের মতো ভালো স্কুলে বাচ্চা-কাচ্চা পড়ানোর সাধ ঢাকা ছাড়তে বাদ সাধে।
আমরা সীমিত আয়ের মানুষগুলো কেমন যেন ‘নারী’র মতো হয়েগেছি। নারীর যেমন ‘বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না’ তেমনি আমরা ‘সকল কিছু’র মূল্যবৃদ্ধির চাপে ফেটে যাচ্ছি তারপরও মুখ খুলছি না মানে প্রতিবাদ করছি না। সবাই কেমন যেন মুখে কুলুপ এঁটে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছি! কীসের ভয়ে আমরা এমন চুপসে গেলাম? কেন গুটি কয়েক লোকের পাপের বোঝা আমরা এভাবে বয়ে বেড়াচ্ছি? যারা লুটপাট করে আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে কেন আমরা তাদের ঘাড় মটকে দিচ্ছি না?
মাস দু’য়েক আগে বাড়ীওয়ালী খালা বললেন, ‘বাবা, বিদ্যুতের দাম তো বেড়েছে তাই সামনের মাস থেকে বিদ্যুত বিল আলাদা দিবা।’ বিদ্যুত বিল ইনক্লুডিং থেকে এক্সক্লুডিং হয়েগেল! অথচ ‘সকল কিছু’র মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বাসা ভাড়া বাড়িয়েছে বেশী দিন হয় নি। কয়েকদিন হলো বাড়ীওয়ালী খালা আবার এসে বললেন, ‘বাবা সরকার নাকি গ্যাসের দাম এক হাজার টাকা করবে। যদি তাই হয় তাহলে তোমরা গ্যাসের বিল আলাদা দিবা।’ এ কথা শুনে আমার মাথায় যেন বজ্রপাত আছড়ে পড়লো! বাসা ভাড়া ঠিক রেখে গ্যাস বিলও ইনক্লুডিং থেকে এক্সক্লুডিং হয়ে যাবে!
গত দু’তিন বছরে মূল্যবুদ্ধি হয় নি এমন জিনিষ তালাশ করা আহমকি ছাড়া আর কিছুই নয় কিন্তু বৃদ্ধি পায় নি শুধু আমার বেতন। আশায় ছিলাম ২০১২ সালের জানুয়ারীতে বেতন বাড়বে কিন্তু সে আশায়ও গুড়েবালি! এদিকে বয়সটাও ওগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ফলে ‘সকল কিছু’র মূল্যবৃদ্ধির চাপ আর দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে পারছি না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম চলে যাবো মফস্বলে। এ সিদ্ধান্তে আমার ক্লাস ফোর এবং থ্রীতে পড়ুয়া দু'ছেলে খুশী হলেও রাজধানীর একটি ভালো স্কুলে সিক্সে পড়ুয়া মেয়েটি খুশী হয় নি।
সে তার মাকে অনুনয়-বিনয় করে বললো, ‘মা বাবাকে বলো, ছোট একটি বাসা নিতে। আর ‘বাজার’ করবা কম কম। আমরা খাবোও কম কম! কতো কষ্ট করে এ স্কুলে চান্স পেয়েছি। স্কুলে কতো বন্ধু। সবাই মেধাবী। গ্রামের স্কুলে পড়ে কি আমি ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারবো? প্লিজ মা, বাবাকে বলো, বাবা যেন ঢাকাতেই থেকে যায়!’ মেয়ের এ আবেদন আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেলেও আমি অক্ষম! কারণ নিকট ভবিষ্যতে বেতন বাড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে আর দাঁতে দাঁত চেপে ‘সকল কিছু’র মূল্যবৃদ্ধির চাপ সহ্য করার মতো স্ট্যামিনাও নেই! সুতরাং ‘আলবিদা’ প্রিয় ঢাকা!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১২ সকাল ১০:০৩