তখন আমি প্রচন্ড শিবির বিদ্বেষী। জামায়াত-শিবিরকে ঈমানের তাগিদে ঘৃণা করি! তাদেরকে অনেকটা কাফের তুল্য মনে করি। তবে তখনও তাদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। মাদ্রাসার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক 'হুজুরগণের' কল্যাণে আমার কিশোর মনে তাদের সম্পর্কে একটা ভয়ঙ্কর ধারণা জন্মে ছিল। এক সময় লক্ষ করলাম জামায়াত-শিবির সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধেয় হুজুরগণের জানা-শুনা আমার মতোই জিরো। তারাও নাকি তাদের শিক্ষকগণের কাছে জেনেছেন জামায়াত-শিবির ভয়ঙ্কর খতরনাক! অনেকটা 'মুরুবি্বগণ' বলেছেন টাইপের! আজ কাল একটি জামাত 'মুরুবি্বগণের' রেফারেন্সে অনেক অবান্তর কথা অবলিলায় বলে বেড়াচ্ছে!
নানান কারণে কওমী মাদ্রাসায় আর মন বসে নি। চলে এলাম আলিয়া মাদ্রাসায়। কওমীর হুজুরগণ তখন ফতোয়া দিতেন আলিয়া থেকে দাখিল পরীক্ষা দেয়া হারাম!! আবার দেখতাম কিছু মতলববাজ হুজুর গোপনে আলিয়া থেকে পরীক্ষা দিয়ে সরকারী চাকুরী করছেন! আলিয়ায় এসে পেলাম একজন জবরদস্ত আলেম যিনি কওমীর ফারেগ আবার দীর্ঘ দিন কওমীতে পড়িয়েছেন। তিনি একদিন ডেকে বললেন, তুমি নাকি শিবিরের ছেলেদের ডাকে সাড়া দিচ্ছ না। আমি বললাম, ওরা তো বাতিল! তিনি বললেন, না তোমার কথা ঠিক নয়। মনে মনে বললাম মিয়া আপনিও বাতিল!
সম্ভবত ১৯৮৯ এর প্রথম দিকে বড় ভাইয়ে জন্যে টাকা আর মায়ের দেয়া পিঠা নিয়ে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়নে লুঙ্গী, গায়ে পাঞ্জাবী, মুখে সদ্য গজানো দাড়ি! রেল স্টেশনে নেমে রিক্সা নিয়ে যাই আমীর আলী হলের গেইটে। হলের দু'তলায় মিছিল হচ্ছে। গগণ বিদারি আওয়াজ 'একটা দুইটা শিবির ধর-সকাল বিকাল নাস্তা কর'। রিক্সা থেকে নামার সাথে সাথে দুইটা ছেলে আমার বাম হাত ধরে টেনে সিড়ি দিয়ে দু'তলায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে। আমি ছাগলের মতো মেঝে পা ঠেকিয়ে নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করছি। এমন সময় একজন সিনিয়র টাইপের ছাত্র এসে ধমক দিয়ে বললেন, এই কি হয়েছে? থামো। আমাকে ছাড়িয়ে তিনি পরিচয় নিলেন। তারপর নীচ তলায় বড় ভাইয়ের রুমটা দেখিয়ে চলে গেলেন।
দরজায় কড়া নাড়ছি কিন্তু দরজা খুলছে না। এদিকে মিছিলের গমগম আওয়াজে গা ঠান্ডা হয়ে আসছে এই বুঝি মিছিল আমার কাছে এসে গেলো! ভেতরে কেউ আছে কিনা তা দেখার জন্য জানালার ফুরে চোখ দিতেই বড় ভাইয়ের সাথে চোখা-চোখি হয়ে গেলো। তিনি দ্রুত দরজা খুলে আমার হাত ধরে টান দিয়ে জলদি ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভয়ে তার মুখটা শুকিয়ে গেছে। প্রথমেই জানতে চাইলেন গেইটে কিছু হয়েছে কিনা? বললাম, দুইটা ছেলে আমাকে টেনে উপরে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। মাঠের দিক থেকে একজন এসে আমাকে ছাড়িয়ে আপনার নাম জেনে দূর থেকে রুমটা দেখিয়ে দ্রুত কেটে পড়লেন। ভাই এবং তার রুমম্যাটরা চাপা কণ্ঠে কথা বলছিল।
পরে জানতে পারি মিছিল করছিল ছাত্র মৈত্রীর ছেলেরা। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র মৈত্রীর একচ্ছত্র আধিপত্য। বর্তমানে রাজশাহীর চিড়িয়া খানায় দু'এক পিস মৈত্রী আছে কি না জানি না। কখনো সুযোগ হলে দেখে আসবো! সে সময়ের কথা মনে পড়লে এখনো গা কাটা দিয়ে উঠে। যদি ছাত্র মৈত্রীর বিপ্লবী ভাইয়েরা আমাকে শিবির মনে করে সেদিন নাস্তা করে ফেলতো তাহলে কি আজ আমি তিন যুগ ধরে এদেশে তাদের, তাদের দোসরদের, তাদের গুরুদের ভন্ডামি দেখতে পারতাম? মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে শেষমেশ নৌকায় আরোহন করে তাদের আখের গোছানোর নাটক দেখতে পারতাম?
কৌতুহল বলেন আর জানার জন্যই বলেন, এদেশের রাজনৈতিক দল এবং দলগুলোর নেতাদেরকে আশির দশক থেকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছি। সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, ওয়াদা রক্ষা করা, সহমর্মীতা, দেশ এবং জনগণের কল্যাণকামিতা, রাষ্ট্রকে শিক্ষা এবং বিত্ত বৈভবে বিশ্বের বুকে তুলে ধরার নিরন্তর প্রচেষ্টা সর্বোপরি ব্যক্তিগত চরিত্রমাধুর্যে তাদেরকেই একটু এগিয়ে দেখেছি যাদেরকে আমি কৈশোরে ঈমানের খতরনাক হিসেবে জেনেছি। আমি এদেরকে পীর-দরবেশ বলছি না। আমি বলছি এরা নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালোর মতো 'মামা'। এদেরকে যারা কথায় কথায় গালি দেন তাদেরকে দেখেছি 'মারিং কাটিং' আর দুই নম্বর কাজে এক নম্বর! এটা আমার দেখা। ৭১-৭৫ এর মতো শুনা নয়। দেশটা তো আর বেশী বড় নয় ইচ্ছে করলে আপনারাও পরখ করে দেখতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:২৬