বিশ্বাস করুন রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস (শুদ্ধ = আস-শামস), আল-ক্বামার তথা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য লেখছি না। লেখছি একজন ভূক্তভোগী হিসেবে। লেখছি প্রতিকারের আশায় যদিও সহসা প্রতিকারের ক্ষীণতম আলোটুকুও সুড়ঙ্গপথের শেষ মাথায় দেখছি না যেমনটি বিগত সেনাসমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা দেখতে পেতেন! বর্তমান হালচাল দেখে মনে হচ্ছে আমরা যারা 'পাবলিক' তারা আবার উপদেষ্টাদের সুড়ঙ্গ পথের আলোর খেলা দেখতে পাবো। রঙ্গরসের খেলার বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে কতই না সৌভাগ্যবান আমরা! তিউনিসিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া, মিশরের সাহসী যুবকদের মতো এই রঙ্গরসের খেলা বন্ধ করার সাহসী যুবকদের জন্ম এখনো কি আমাদের দেশে হয় নি? পরিবর্তনের আরব জাগরণ আমাদের যুবকদের মনে কি দোলা দেয় না?
বিগত কয়েকবছর যাবৎ রেলের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ কারণে প্রতিবারই প্রতিজ্ঞা করি আর রেলে নয় কিন্তু প্রয়োজনের সময় যখন সড়ক পথের বেহাল-করুন দশা আর হাই ভোলটেজের ভাড়ার কথা মনে পড়ে তখন বেলাজের মতো ছুটে যাই রেল স্টেশনে। যারা রেলে যাতায়াত করেন তারা নিশ্চয় জানেন গত কয়বছরে রেলের সেবা তলানিতে ঠেকেছে। মুমূর্ষু অবস্থায় খোঁড়িয়ে খোঁড়িয়ে চলছে রেল। হাজারো বিড়ম্বনা রেলে, তারপরও আমার মতো গরীবেরা ছুটে চলেন রেল স্টেশনে। কয়েক মাস আগে আমাদের এক প্রিয় বাম নেতা বললেন, গরীবের যানবাহন রেলকে বাঁচাতে হবে এবং তিনি নিজে রেল বাঁচানোর কিছুটা মহড়াও দিয়েছেন! রেলের ধনী যাত্রীরা মন খারাপ করবেন না আমরা ধরে নিবো আপনারা রেলের সৌখিন যাত্রী। গরীবের যান বলেই তো রেলের এই গরীবী হালত।
আগামী তিনদিনের ছুটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে সিলেটে কাটাবো বলে টিকিট কাটতে যাই গত ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কমলাপুর স্টেশনে। প্রায় দেড় ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে যখন কাউন্টারে বললাম, ২২ তারিখ সকালে সিলেটের ৫টা টিকিট দেন। ভেতর থেকে নিরাবেগ উত্তর সিট নেই। নেই মানে? নেই মানে সিট শেষ। বিফল মনে ফিরে এলাম। ভাবলাম যার সিট এতো আগেই শেষ হয়ে যায় তার এই মরণ দশা! এক বন্ধুকে ফোনে বলতেই সে বললো, সিটের ব্যবস্থা করা যাবে তবে কালো বিড়ালের দুধ-ভাতের জন্য কিছু অতিরিক্ত টাকা লাগবে। আর কতো কাল এই অশুভ কালো বিড়ালেরা আম-জনতার রক্ত চুষে খাবে? বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরেই এই অশুভ কালো বিড়ালেরা ভয়ঙ্কররূপে সক্রিয়। এদের মাথায় ডান্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেয়ার মতো সাহসী বীর বাঙ্গালী কি আর একজনও অবশিষ্ট নেই চির সবুজের বাংলাদেশে?
বাসায় গিয়ে বিবি সাহেবার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম সিলেটে না গিয়ে কিশোরগঞ্জে আমার বাবার বাড়ীতে যাবো। তাই পর দিন সন্ধ্যায় কমলাপুর স্টেশনের ১০ নং কাউন্টারে লাইনে দাড়িয়ে প্রায় এক ঘন্টা পর একজন রেল যাত্রীর সবচেয়ে বড় চাওয়া-পাওয়া 'সিট'সহ টিকিট পাই। লাইনে দাড়িয়ে সিট পেলে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। তবে ফেরৎ টাকার হিসাব মিলিয়ে দেখলাম কিছু টাকা কম! বুঝতে পেরে লাইনে দাড়ানো একজন যাত্রী বললেন, ভাই কিছু হয়েছে? বললাম, না তেমন কিছু না। কিছু টাকা কম দিয়েছে। অরেকজন বললেন, সিট পেয়েছেন? বললাম, জ্বী। তার সোজা উত্তর সিট দিলে ওরা পনের বিশ টাকা রেখে দেয় এটাই এখানকার নিয়ম! মনে মনে বললাম, সেটা তো আমিও জানি কিন্তু এতো দিন তো আলোচনা করে, বলে-কয়ে নিতো কিন্তু এখন তো দেখতেছি বলা কওয়া ছাড়াই নিয়ে নিচ্ছে! ইতিমধ্যে একজন হন্তদন্ত হয়ে কাউন্টারে গিয়ে বললেন, ভাই আমাকে তো সত্তর টাকা কম দিয়েছেন।
আমার আগের ব্যক্তিটি তার কণ্ঠকে মোলায়েম করে এমনভাবে অনুনয় বিনয় করছেন একটি সিটের জন্য যা দেখে মনে হচ্ছে তিনি টিকিট বিক্রেতার কাছে ভিক্ষা চাচ্ছেন। ভদ্রলোক হয়তো বুঝতে পারেন নি দেবতা কিসে তুষ্ঠ। তাই তিনি কণ্ঠ দিয়ে টিকিট বিক্রেতা স্যারের মন গলাতে চাইছেন। তিন চার দিন আগে টিকিট কাটতে গেলেও সিট নেই বলে যারা উত্তর দেয় তারাই আবার 'এক্সট্রা' বা 'উপরি' পেলে ট্রেন ছাড়ার আগমুহূর্তেও সিট দিতে পারেন কী আর্শ্চয্য ক্ষমতা তাদের! এমন ক্ষমতাধর বিষধর স্যার আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় সকল চেয়ারেই বসে আছেন। যাদের ক্ষমতার বিষে আমাদের ত্রাহী মধুসুদন অবস্থা। এ অবস্থা থেকে উদ্ধারের মতো হিম্মতওয়ালা সন্তান কি আমরা এখনো জন্ম দেই নি? ষোল কোটি মানুষের দেশে এমন একজন মা কি নেই যিনি একটি মাত্র সন্তান জন্ম দিতে পারেন, যে সন্তানটি এদের টুটি চেপে ধরবে?
আগে শুনতাম রেলের সময়জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ রসিকতা করে বলতো, ভাই নয়টার গাড়ী কয়টায় যাবে? কাল রাতে লাইনে দাড়িয়ে শুনলাম আরো চরম রসিকতা। একজন যাত্রী এলেন তার টিকিট বিক্রি করতে আরেকজন ক্রয় করতে এগিয়ে গেলেন, দেখলেন এটা আজকের টিকিট। ক্রেতা বললেন, ভাই আমি কালকে যাবো। বিক্রেতা বললেন, ভাই আজকের গাড়ীই কালকে যাবে আপনি এই টিকিট দিয়ে যেতে পারবেন! একথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। লাইনের স্বত্ব ঠিক রেখে একটু এগিয়ে বললাম, ভাই আজকের গাড়ী কালকে যাবে এর মানে কি? ভদ্র লোক পরম আনন্দের সাথে বললেন, ভাই দ্রুতযান ট্রেনটি একটু পর কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ার কথা কিন্তু সেটি এখনো কমলাপুরেই আসে নি। কাল সকাল আটটায় নাকি আসবে এবং ঘন্টা দুয়েক জিরিয়ে তার পর আবার যাত্রা করবে! হায়রে ডিজিটাল!
আমাদের এলাকায় একটি কথা প্রচলিত আছে 'আগে হাগতো বাইরে এখন হাগে ঘরে'। মাননীয় প্রথম রেল মন্ত্রী সেনগুপ্ত শপথ নেয়ার পর দ্বীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, আর কিছু হউক আর না হউক রেল সময় মতো আসবে এবং সময় মতো যাবে। মন্ত্রীর এ ঘোষণার পর রেলের অবস্থা ঘরে হাগার মতো। আর কালো বিড়াল, মন্ত্রী যাকে খুজে বের করার হুঙ্কার দিয়েছিলেন, সে তো এখন আরো মহা খুশী। দুধ-ভাত আগের চেয়েও বেশী। কারণ সেনগুপ্ত তো আর কিপটে না যে কালো বিড়ালগুলোকে না খেয়ে মরতে দিবেন! তাছাড়া দুধ-ভাতের প্রতি কার লোভ না আছে? রেলের দুধ-ভাতের মজাই আলাদা। মন্ত্রী যে 'প্লেট' নিয়ে বসে পড়বেন না তারই বা নিশ্চয়তা কি? তবে আমার জানামতে মন্ত্রীমশায়ের সুনামগঞ্জের দিরাই আর শালবনের গাজীপুরে যে ধন-সম্পদ আছে তাতে তো আগামী চৌদ্দপুরুষ শুয়ে-বসে খেলেও দিন গুজরান হয়ে যাবে তাদের। রেলের দুধ-ভাত দেখে মাননীয় মন্ত্রীর জিবের ডগায় তরল পানি না আনাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
যদ্দুর মনে পড়ে খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে সংসদে সরকারদলীয় কেউ একজন কোরানের আয়াত উদ্ধৃতি করে বললেন, 'ওয়াতু ইজ্জু মান তাশাউ' অর্থাৎ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন। এ বক্তব্যের জবাবে বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন, 'ওয়াতু জিল্লু মান তাশাউ' অর্থাৎ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপমান করেন। যদিও তিনি আল্লাহর এ কথার উপর বিশ্বাস রাখেন না। তবে তিনি বিশ্বাস রাখুন আর নাই রাখুন এবার মনে হয় 'জিল্লু' বা অসম্মান তাকে ধরার জন্য ওৎপেতে বসে আছে। তার ভাষায় 'বাঘে ধরলে ছাড়ে কিন্তু হাসিনা ধরলে ছাড়ে না।' সেই লৌহ কঠিন হাসিনা সবে মাত্র তাকে নিধিরাম সর্দার বানিয়েছেন। কয়দিন পরই তিনি বুঝতে পারবেন আসলে হাসিনা তাকে কোন দাওয়াই দিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যার্থ মন্ত্রীরা পাদুকা সংবর্ধনা পাচ্ছে। এমনকি আমাদের পাশের দেশে পাদুকার পাশাপাশি চড়-থাপ্পরও পাচ্ছে। রেলের ময়মনসিংহ অঞ্চলের কিছু যাত্রী ছাড়া আর সব অঞ্চলের যাত্রীর পায়েই পাদুকা থাকে, তবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ ক্ষেপে গেলে অন্যের পাদুকা দিয়েই কাম সেরে ফেলে! অতএব সেনগুপ্ত সাবধান।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০১