somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তালাকনামা (একটি নির্মম ক্ষুদ্র গল্প)

২৬ শে মে, ২০১০ বিকাল ৫:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার পাশের টেবিলে বসেন শাকিল। সিনিয়র অফিসার। সুশিক্ষিত, স্মার্ট, টগবগে এক যুবক। সে ফরেন রেমিট্যান্স এবং ক্লিয়ারিং সামাল দেয়। গল্প প্রিয় মানুষ। কাজের যত ঝামেলাই থাকুক না কেন, তাঁর মুখে হাসি এবং গল্প লেগেই থাকে। গুমরা মুখের ক্লায়েন্টরাও না হেসে পারেন না। আর আমি এমনিতেই নাচুনে বুড়ি! হাসির খোরাক পেলে, হাসি থামায় কে? বসদের অনেক ধমক খেতে হয়েছে হাসির জন্য। জীবনের নানা বাঁকে চরম প্রতিকূলতা, অফিসে ক্লায়েন্টদের অহেতুক বড়লোকি মার্কা ফুটানি, মেধাবী (?) বসদের গাল-মন্দ আর বউ-বাচ্চাদের গ্লানি টানতে টানতে অনেক কিছুই ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আজো হাসিটা ছাড়তে পারিনি।

ব্যাংকিং জীবনের আট বছর না পেরোতেই নিজেকে এক অসামাজিক প্রাণী হিসেবে আবিষ্কার করলাম। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন তো অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। ব্যাক্তিগত জীবনের সুখ-দুখের কবর রচনা করতে হয়েছে প্রথম বছরেই। তখন আমি হেড অফিসে। বেচারী বউকে ঢাকা এনেছি মাত্র কয়েক দিন। ঢাকা এসেই কুপোকাত, জ্বরে কাহিল। অপর দিকে সন্তান সম্ভাবা। সকাল বেলা অফিসে আসার সময় ছলছল চোখে বলল, আজ না গেলে হয় না। বউকে কি করে বুঝাই, আমি যে কত অহসায় এক গোলাম! শান্তনা দিয়ে বললাম, দেখি আগামী কাল ছুটি নিতে পারি কিনা।

এক সিনিয়র ভাই, বসের কাছে গিয়ে বললেন, 'স্যার আমার স্ত্রীকে আদ্দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সম্ভবত সিজার করতে হবে। আমার এক দিনের ছুটি প্রয়োজন।' মহামহিম স্যার বললেন, সিজার হবে আপনার স্ত্রীর, আপনার ছুটি লাগবে কেন? কি করে ছুটি কাটানো যায় শধু সেই ধান্দায় থাকেন আপনারা। আপনাদের এ দিন জ্বর, সে দিন কাশি, আজ এ মরেছে তো কাল ও মরেছে। ছুটির জন্য যত মিথ্যা অজুহাত। কই আমার তো কত আত্মীয় মারাগেছে। গেলাম না তো কোনো দিন? এমনকি আমার শশুরের মুতু্যর খবর পেয়েও যেতে পারি নি। ব্যাংকের জরুরী কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আর আপনারা দু'দিন পর পর ছুটি কাটানোর ছুতানাতা খুঁজেন। সিনিয়র ভাই বিনয়ের সাথে বললেন, স্যার, আমার অসুখ-বিসুখ হলে কখনো ছুটি চাই না এমন কি আত্মীয় স্বজন মারা গেলেও না। কিন্তু ...। কোন কিন্তু ফিন্তু চলবে না। যান। সিনিয়র ভাইয়ের এ ঘটনাটি মনে পড়ায় আর ছুটি চাইনি।

আজ আমাদের শাখায় ক্লায়েন্ট গ্যাদারিং নেই বললেই চলে। সাধারণতঃ এমন দিনে দ্রুত ক্লিন ক্যাশ মিলিয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাংক ত্যাগ করা যায় বলে শাকিল থাকে ফুরফুরে মেজাজে। কিন্তু আজ ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে তার গৌরি বর্ণের উজ্জল চেহারা! আমি শাকিলের সিনিয়র হলেও কাছা কাছি বসতে বসতে মনের দিক থেকেও অনেকটা কাছাকাছি হয়েগেছি। ডাক দিয়ে বললাম, কি শাকিল মন খারাপ নাকি? হ্যাঁ শিশির ভাই, কিছুটা। হেসে বললাম, কিছুটা কই, আপনার চেহারা দেখলে তো মনে হয় এইমাত্র বউ মারাগেছে! আরে ভাই, ও মরলে তো ভালই হতো!

কাছে গিয়ে পিঠে থাপ্পর দিয়ে বললাম, কী ব্যাপার শাকিল। বউ কি খুব ক্ষেপেগেছে নাকি? ধরা গলায় শাকিল বলল, বিয়ের পর আজ প্রায় তিন মাস হলো বাড়ি যাই না। শিশির ভাই আপনিই বলেন, বউ কী ভাববে! ওকে আসছি আসছি বলে কথা দিচ্ছি কিন্তু কথা ঠিক রাখতে পারছি না। অনেক দিন থেকেই ছুটি চাচ্ছি কিন্তু ছুটি তো দিচ্ছেনই না উল্টো স্যার আজে-বাজে বকেন। গতকাল সন্ধ্যায় স্যারের চেম্বারে গিয়ে বললাম, স্যার আমাকে কমপক্ষে তিন দিনের ছুটি দেন। স্যারকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, বৃদ্ধা মা এবং নতুন বউয়ের কথা। কিন্তু স্যার বললেন, ঢাকায় বাসা নেন, বউকে নিয়ে আসেন। ঢাকায় কেন বউকে আপাতত আনতে পারবো না তা স্যারকে বললাম, কিন্তু স্যারের এক কথা ছুটি হবে না। অবশেষে ইষৎ রেগে স্যারকে বললাম, তাহলে আমাকে একদিনের ছুটি দেন, বউকে তালাক দিয়ে আসি। এ কথা শুনে তিনি ক্ষেপে গিয়ে আমাকে এমনভাবে বকা-ঝকা করলেন যেন আমি তার খরিদ করা গোলাম! ডিসিপ্লিনারি একশনের হুসিয়ারি তো আছেই।

রাতে বউ ফোন করে জানতে চাইলো, কবে যাচ্ছি। বললাম, ছুটি পাচ্ছি না। প্রতিউত্তরে সে যা বলেছে তার সব কথা আপনাকে বলতে পারবো না শিশির ভাই। তার ধারণা ঢাকায় আমার . . . .। তা না হলে বিয়ের পর একটি যুবক এতদিন বউ ছাড়া থাকে কি করে? তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। ওর মৃদু আওয়াজে বাঁধ ভাঙ্গা কান্না আমাকে গত রাতে ঘুমাতে দেয়নি। অনেক কিছু ভেবে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আসলে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম ঐ দিন যে দিন বাবার মূতু্যর খবর পেয়ে বাড়ী যাচ্ছিলাম। তখনো বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাইনি। ম্যানেজার স্যার ফোন করে বললেন, শাকিল কখন আসছেন। কাঁপা গলায় শুধু বললাম, স্যার এখনো বাড়িতে পৌঁছাইনি। স্যার বললেন, ঠিক আছে যান, ব্রাঞ্চের অবস্থা তো জানেনই, তাড়াতাড়ি চলে আসবেন। মূলত সেই দিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আপনাদের এই সেরা ব্যাংকে আর চাকুরী করবো না।

ভেজা গলায় শাকিল বললো, শিশির ভাই, আজ সকালে স্যারের কাছে রিজাইন লেটার জমা দিয়েছি। বললাম, শাকিল একে তো এখন বিশ্ব মন্দা তার উপর আমাদের দেশে চাকরীর বাজারে স্থায়ী মন্দা তো লেগেই আছে। এ অবস্থায় চাকরীটা না ছাড়লে ভাল হতো না? শিশির ভাই, বলতে চাচ্ছিলাম না বাধ্য করলেন বলতে, একটি তালাকনামার চেয়ে রিজাইন লেটার কি ভাল নয়? রিজাইন লেটার যে বিচ্ছেদ ঘটায় তার চেয়ে একটি তালাকনামার বিচ্ছেদ কি বেশী বেদনাদায়ক নয়? শাকিলের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, সরি শাকিল।
২৩টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×