ঢাকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে সবুজের প্রগার একটা নিকুঞ্জে কয়েকটি নির্দিষ্ট বছরের জন্য আমার বসবাস। সবুজের নিকুঞ্জ বললাম এই কারণে যে, ঢাকা শহরে এত গাছপালা এখানে ছাড়া আর কোথায় নেই। ঢাকা সীসায় ভরা দূষিত শহর কিন্তু ঢাকা থেকে এই নিকুঞ্জে আপনি যখন প্রবেশ করবেন তখন মনে হবে আপনি যেন সবুজের রাজ্যে হারিয়ে গেলেন আর কে যেন আপনার সমস্ত শরীর জুড়ে ঠাণ্ডা শীতল একটা পরশ বুলিয়ে দিল। শুধু কি তাই? সম্পূর্ন ধুলাবালি মুক্ত পরিচ্ছন্ন একটা জায়গা যেখানে আসলে থেকে যেতে ইচ্ছে করে।
শুধুই কি সবুজের রাজ্য এটি?
না।
সংস্কৃতির রাজধানীও বটে। এখানে যেন সংস্কৃতিরই একটা অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। কি নেই এখানে, গান বলেন, নাটক বলেন, তর্কযুদ্ধ বলেন আর যাই বলেন না কেন, এই জায়গাটা সব দিক থেকেই প্রসিদ্ধ। প্রসিদ্ধ হবার পিছনে একটা কারণ আছে আর সেটা হল এখানকার সবাই সবার পরিচিত, সবাই সবার ভাই আর কাজ করার সময় সবাই সবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে কাজ করি।
এখানে এসেছেন আর লেক দেখেন নি সাথে বোনাস হিসেবে শীতের অতিথি পাখিও এমন লোক মনেহয় খুব কমই আছে। ঢাকার মধ্যে একমাত্র নিরাপদ জায়গা এটি যেখানে পাখিরা নিরাপদে বিচরণ করে। এখানকার আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লাল পদ্ম শোভিত লেক। লাল পদ্ম শুধু মনকেই ভরিয়ে দেয় না সাথে রোমন্থন করিয়ে দেয় অতীতের স্মৃতিগুলো।
এখানে এসেছেন কিন্তু বৃষ্টি দেখেন নি তাহলে আপনি জীবনের চরম মূহুর্তগুলির একটি মিস করেছেন। বৃষ্টির রূপ সব জায়গায় এক রকম নয় আর সব জায়গায় উপভোগ্যও নয়। কিন্তু আপনি এখানে যখন মেঘময় একটা দিনে আসবেন তখন নিজে নিজেই আক্ষেপ করে বলবেন যে, আরো আগে এখানে আসা উচিৎ ছিল। এতো গেল বৃষ্টি আসার পূর্ব মূহুর্ত। কিন্তু যখন দেখবেন যে, নীল আকাশটা ঘনকালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে আর মেঘ গুড়গুড় করে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। যে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা ছুঁয়ে যায় প্রতিটি সবুজের কোণা, মেঘমেদুরে বৃষ্টি আর সবুজ পাতা আলিঙ্গন করে একে অপরকে। বৃষ্টিতে নিজের শরীরটা আপনি যখন এলিয়ে দিবেন তখন বুঝবেন যে, কোমল এক ধরণের শীতলতা আর সেই সাথে শুভ্র ভালোলাগা আপনার ভিতরে কাজ করে যাচ্ছে। বৃষ্টির দিনে নিকুঞ্জের একটা কক্ষে একা একা বসে আপনি যখন জানালার ভিতর দিয়ে দূর দিগন্তের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন তখন জীবনের সেরা মূহুর্তটি আপনার হাতে এসে ধরা দেবে। ঘাসের উপর বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটাকে মনে হবে একেকটি হীরার বিন্দু।
নিকুঞ্জটি একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে। সকালে এক রূপ তো দুপুরে অন্য রূপ, বিকেলে ভিন্ন রূপ তো রাতে আরেক রূপ। প্রতিটি সময় যেন নিকুঞ্জটি জমজমাট থাকে। এই নিকুঞ্জে বসবাস একঝাক স্বপ্ন বিলাসী মুখের যারা প্রতিটি মুহুর্ত স্বপ্নকে ধারণ করে, তাকে লালন করে এবং ফাইনালি পালন করে।
আপনি বাংলাদেশের সেরা সেরা খাবারগুলো পাবেন এই নিকুঞ্জে। কি নেই এখানে? গ্রাম-বাংলার সেই ভর্তা-ভাজি থেকে শুরু করে ফাস্ট ফুড পর্যন্তও এখানে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রকমের ভর্তা, বিভিন্ন রকমের মাছ, বিভিন্ন রকমের মাংস, ভাত, খিচুড়ি, কোর্মা-পোলাও, বিশেষ দিনে পান্তা-ইলিশ সবই দেখা মিলবে এখানে। খাবার সময় মনে হবে আপনি নিজের মায়ের হাতের সেই সেরা রান্নাটাই খাচ্ছেন।
এখানেও বারো মাসে তের পার্বন জমে। বাংলাদেশের আকাশে যখন হঠাৎ করে কালবৈশাখীর আনাগোনা শুরু হয় তখন এখানে চলে পহেলা বৈশাখ উৎযাপনের পালা। নানা ঢং এ নানা রং এ আমরা সবাই যেন এখানে পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেই। সেদিন যেন সেই নিকুঞ্জের চেহারাটা পাল্টে যায়। খোলস ভেদ করে তার যৌবন যেন উঁকি দেয়। পহেলা ফাল্গুন, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারিতেও তার সেই রূপ যেন বিদ্যমান।
অনেক স্বপ্নবাজ এখানে ঘোরাফেরা করে। আমিও তাদের মধ্য একজন। এই নিকুঞ্জটি যেন স্বপ্ন পূরনেরই একটা আলাদিনের চেরাগ। অধ্যাপক আলী আহসান আমার পূর্ব বাংলা কবিতায় মূলত “সবুজে ভরা নিকুঞ্জ” শব্দটি ব্যবহার করেছেন এই নিকুঞ্জের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে। মূলত কবিতায় সারা বাংলাকে তিনি সবুজের নিকুঞ্জের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি কবিতায় এই নিকুঞ্জের রূপের মধ্যে দিয়ে পুরো বাংলাকে সবুজের প্রগাঢ় নিকুঞ্জ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
জানেন, সেই নিকুঞ্জ কোনটি?
“জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়”