কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আবার রেগুলার দেখা পেলাম দলটির। এশার নামাজ শেষে ৫/৭ জনের ছাত্র-তাবলীগ প্রেয়ার রুমে গোল হয়ে বসে মোটাসোটা একটা বই, নাম ফাজায়েলে আমা'ল, পড়ে একজন, বাকিরা শুনে। বিস্তারিত পড়ার ধৈর্য্য নেই, তাই উল্টে-পাল্টে দেখলাম একদিন। নামাজ রোজা দাওয়াত সহ নানান দোয়া দরুদের ফজিলত, শিক্ষামূলক কাহিনী- এটাই বইটার আদ্যপান্ত। এর বাইরে সপ্তাহে একদিন তারা লাইন ধরে হলের কক্ষে কক্ষে যেতেন। আহ্বান একটাই, ওনাদের বহরে শামিল হয়ে বহুল প্রচারিত 'ফায়দা হাসিলে।'
তাবলীগকে অনিয়মিত দেখি আরেক স্থানে। মৎস্য ভবন থেকে শেরাটনের দিকে ফুটপাত ধরে হাটঁতে হাটঁতে। বছরজুড়ে কাকরাইল মসজিদ ও সংলগ্ন এলাকা গমগম। তাসবীহ, টুপি, আতর, ঢিলা কুলুখ, মেসওয়াক, ও খাবারের দ্রস্টব্য গন্ধ নাকে লাগবেই এখানে। দেশ ও বিদেশের নানান বয়সী, বিশেষত: বয়স্ক, মানুষের ভীড়। লক্ষ্য একটাই- ফায়দা হাসিল।
বছরে আরেকবার নিয়মিত তাবলীগের প্রচার-জোয়ার বয়ে যায় ইজতেমা নামক সম্মেলনের প্রাক্কালে। মোটামুটি ৫ দিনের জন্য যাবতীয় মতাদর্শের টিভি, রেডিও, পত্রিকা 'মুসলিম বিশ্বের ২য় বৃহত্তম' এ সমাবেশের বয়ানে বয়ানে মত্ত হয়ে উঠে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়াক্রান্ত রাস্তা, রেল, বাসের ছবি, হাত তুলে স্রস্টার দরবারে মোনাজাত, খালেদা-হাসিনা-এরশাদ ইত্যাদিদের সদলবলে আখেরীমোনাজাতে যোগদানের খবর। তারপর হারিয়ে যায়। নীরবে আমরা যারযার মত ঝাঁপিয়ে পড়ি আগেকার কাজে।
আপাত: এটাই তাবলীগ। সাধারনের কাছে। তবে আরেকটু গভীরে পেয়েছি অদ্ভুত কিছু বিষয়। ছাত্র-তাবলীগের মধ্যে অনেক বন্ধুকে পেয়েছি যারা ঘোরতর ছাত্রলীগ সমর্থক (!), প্রায় সবাই শিবিরের ঘোর-বিরোধি! তবে 'কলেজ-মেডিক্যাল-ভার্সিটিতে' ছদ্মবেশধারী তবলীগও আছে। শিবির, লীগ, দল, ফ্রন্টের টানাটানি থেকে বাচতে ফার্স্ট ইয়ারে কূশলী অনেকে 'তাবলীগের লেবাস' নিয়ে ফেলেন। তবে সেটাও কম কঠিন নয়। এ বয়সে দাড়ি, পান্জাবির ভাড় বহন করা কি চাট্টিখানি কথা! এ ধরনের বেশ কজনকে চিনি যারা স্নাতক শেষে দিব্যি দাড়ি ফেলে দিয়েছেন!! আহলে সুন্নাত, খারেজী, ওহাবী বা নানা ধরনের ধর্মীয় গ্রুপের অনেক মৌলভী মওলানাকে দেখেছি তবলীগের প্রতি সমালোচনা মুখর। কাউকে কাউকে এ ব্যাপারে নীরব, কেউবা পক্ষবাদী।
যেমনটা দ্বিধাগ্রস্ত আমিও। ইজতেমায় লক্ষ লক্ষ মানুষ যায়। কেন যায়? হয়ত আশা করে সওয়াব হবে। এভাবে আশা করে কোনো একস্থানে লক্ষ কোটি বা তারও বেশি লোক জড়ো হলেই কি সওয়াব হবে? কি কি কাজ করতে হবে, করলে ভাল হবে, কিকি কাজ করলে গোনাহ হবে তা কি মানুষের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে? না তো, বরং পরিপূর্নভাবে আল্লাহ রাসুলদের মাধ্যমে দিয়েই দিয়েছেন। সামর্থ্যবান মুসলিম/মানুষদের জন্য হজ্জ্ব নামক বিধানতো কারো কাছেই অজানা নয়। এটার অতিরন্জনে ২য়, ৩য়, ৪র্থ সম্মেলন করে, কাল্পনিক সওয়াব আশা করা কেমন কথা? কেউ কেউ বলতে পারেন- এখানে মানুষ প্রশিক্ষন লাভ করে। আসলে কি তাই? প্রশিক্ষন কি এত সোজা? আর প্রশিক্ষনের খোদা ও তার নবীরাসুলদের প্রদর্শিত টেকনিক কিংবা রেফারেন্স বই পুস্তক কি এসব? নাকি এটা নেহায়েতই লক্ষমানুষের আরেকটি গন্তব্যহীন সম্মেলন? সওয়াব ক্ষুধার্ত বোধহীন মুসলিমদের যুক্তিহীন বিক্ষিপ্ত করুনা প্রার্থনা? মুসলিম উম্মাহ নামক একটি 'আন্তর্জাতিক ভূতের' কল্যান কামনা, যার কল্যান জর্জ বুশও কামনা করতেন! সুযোগ পেলেই যে কেউ এর কল্যান কামনা করেন। আর ইজতেমা মাঠ থেকে বাসাই ফিরেই এর পাছায় বাঁশ দেন!!!
চোর, ডাকাত, ঘুষখোর, পেশাদার খুনী অনেকেই চুলে পাক ধরলে দিব্যি তাবলীগে যোগ দিয়ে ফেলেন। ঘুরতে থাকেন এ মসজিদ থেকে ও মসজিদ। যথারীতি বয়ান দিতে থাকেন আসরের নামাজের পর। কবর, হাশর নিয়ে বয়ান করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। অদ্ভুত এক ব্যাপার- অদ্যাবদী ১টাকা ঘুষ ফেরত এসেছে, রাস্ট্রীয় কোষাগার লুট করা ১টি পয়সাও ভুল বুঝতে পেরে ফেরৎ দিয়েছেন, কারো উপর অন্যায়ের জন্য মাফ চেয়েছেন তেমনটি দেখিওনি, শুনিওনি। কিন্তু আল্লাহর কাছে রাতদিন মাফ চাইছেন, ফাজায়েলে আমাল পড়ছেন, বয়ান করছেন!
আল্লাহ কে যে, তাদেরকে মাফ করবে? আল্লাহর কি কোন অধিকার আছে আরেকজনের মেরে দেয়া টাকা মাফ করার? এটা শুনতে খারাপ লাগতে পারে যে, এ ধরনের দাগী বার্ধ্ক্যপীড়িত সন্ত্রাসীদের একটা উত্তম আখড়া কিংবা আখেরাতেও লুটে পুটে খাওয়ার একটা ভালো রাস্তা (কাল্পনিক)হিসেবে তাবলীগকে পাওয়া যায় দেদার।
মসজিদে রাত্রিনিবাস ও ধ্যানের ব্যাপারে ইসলামে কিছু নেই তা না। বরং তাবলীগের জন্মের ঢের আগে রাসুল (স) রমজানের শেষ ১০ দিন পুরুষদের জন্য মসজিদ আর মহিলাদের গৃহঅভ্যন্তরে নিবীড় ধ্যানের উপদেশ দিয়েছেন। এর বাত্যয় ঘটিয়ে দল বেঁধে বছরব্যাপী মসজিদ ভ্রমন কিছুতেই কল্যানকর কিছু হতে পারেনা। এটা স্বরচিত সুন্নত (!) বা বড় জোড় 'ইসলামি বৈরাগ্যবাদের' চর্চা হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১০ বিকাল ৪:৪৮