ইতিহাসের কিছু ভিন্নতা যা ঐতিহাসিকরা সাধারণত তুলে ধরেন না নানাবিধ কারণে ৷ সেই অন্য চোখে দেখা পৃথিবীর কিছু ব্যতিক্রমী ও ভুলে যাওয়া ইতিহাসের পাতা মেলে ধরলাম পাঠকের চোখের আয়নায় ৷
বিশ্বের কতিপয় বিখ্যাত নারী জলদস্যু
ইলিরিয়ার দস্যুরাণী টিইউটা
কথিত আছে যে দানবীয় রোমান বীরদের খুব কমই কেউ পরাজিত করতে পারতেন, এ স্বল্প মল্লবীরদের অন্যতম একজন ছিল ইলিরিয়ার দস্যুরাণী টিইউটা ৷ স্বামীর মৃত্যুর পর আরডিয়েই রাজত্বে টিইউটা খ্রিঃপূর্ব ২৩১ সাল থেকে বসবাস করতে থাকেন ৷ পার্শবর্তী শত্রদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য দেশীয় জলদস্যুদের প্রতি সমর্থন দেন টিইউটা ৷
এই দস্যুরাণীর সহায়তায় ইলিরিয়ানরা ডাইরাচিয়াম ও ফোনিচ শহর দখল করে নেয় আর সে রোম ও গ্রীসের ব্যবসায়ীদের গুদামগুলো আক্রমণ করেন ৷ এরমধ্যে টিইউটা কর্তৃক আটককৃত দুই রোম প্রতিনিধির মধ্যে একজন হত্যা ও অপরজনকে জিম্মি রাখা হয় ৷ খ্রিঃপূর্ব ২২৯ সাল এ দস্যুরাণী ও ইলিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রোম ৷ ২০,০০০জন সৈন্য ও ২০০টি নৌবহর নিয়ে রোমানরা টিইউটাকে আত্মসমার্পণে বাধ্য করার জন্য পাঠায় খ্রিঃপূর্ব ২২৭ সালে ৷ তবু সে যুদ্ধ করে যায় পরে রোমানরা আর তাকে সমুদ্রে যেতে দেয় নাই ৷ পরের ঘটনা বিস্তারিত এখানে ৷
সাইয়্যেদা আল হোরা
সাইয়্যেদা আল হুরার জন্ম ১৪৮৫ সালে ৷ তৎকালীণ গ্রানাডা সাম্রাজ্যের প্রসিদ্ধ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এ নারী ও তার পরিবারকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয় খ্রিস্টানদের ১৪৯২ সালে স্পেন অধিগ্রহণ করার ফলে ৷ তার পরিবার আশ্রয় নেয় মরোক্কর চাওয়েনে ৷ ১৫১৫ সালে তার ব্যবসায়ী স্বামীর মৃত্যুর পর সাইয়্যেদা টেটোয়ান প্রদেশের গভর্ণর হন ৷ এ পদে থাকতেই পরিচয় হয় তৎকালীন মরোক্কর রাজা আহমেদ আল-ওয়াটাছির সাথে পরে তাদের পরিণয় হয় ৷ বিশাল সম্পদ হস্তগত হওয়ায় তার ক্ষোভ পরে খ্রিস্টানদের উপর যারা তাকে ক্রমাগতভাবে মাতৃভূমি থেকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল ৷
আলজেরিয়ার বারবারোসাদের সাথে পরিচয় হওয়ার পরই সে ধীরে ধীরে এ জলদস্যতে পরিণত হয় ৷ এভাবে সে চেয়েছিল খ্রিস্টানদের জাহাজ লুট করে করে একদিন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করবে ৷ খ্রিস্টানদের চোখে ভুমধ্যসাগরের ক্ষমতাবান জলদস্য রাণী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ৷ স্পেনীশ ও পূর্তগীজ কোন জাহাজ জলদস্য দ্বারা লুট হলে তিনি মধ্যস্থাকারীরূপে অবতীর্ণ হতেন ফলে প্রচুর সম্পদশালী হতে থাকেন ৷ ১৫৪২ সালে নিজের মেয়ের জামাই কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন ৷ তার শেষ পরিণতি আজও অজ্ঞাত ৷
এনি বনি
এনি বনি বা এ্যনি নামে বেশী পরিচিত এ আইরিশ জলদস্যুর জন্ম ১৬৯৭ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যবর্তী কোন সময়ে ৷ মূল ভূখন্ডে পূনরবাসনের পর তার মা মারা যান ও বাবা ব্যবসা শুরু করেন ৷ খাবার টেবিলের ছুরি চাকরানীকে আঘাত ও জেমস বনি নামক স্বল্পকালীন জলদস্যুকে বিয়ে করায় তার বাবা তাকে তাড়িয়ে দেন ৷ পরে বাহামার নতুন ভূখন্ডে চলে যান ও সেখানে জ্যাক রাক্যাম নামে জলদস্যু ক্যাপ্টিনের সাথে পরিচয় হয় ৷ পরে তার রক্ষিতা হিসাবে একসাথে বসবাস করতে থাকেন ৷
পরে দুজন মিলে সাগরে চলে যান লুন্ঠনে ৷ লুট করা বেশীরভাগ জাহাজই ছিল ব্রিটিশদের চা পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ৷ ফলে চা ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ রাজাকে অবহিত ও সতর্ক করেন ৷ জ্যামাইকার তৎকালীন গভর্ণর ক্যাপটেন জোনাথন বারনেটের যুক্তির মায়াজালে পরে বনি ও রাক্যামকে গ্রেফতার করেন এবং রাক্যামকে মৃত্যুদণ্ড দেন ৷ পরে বনির বাবার উৎকচের বিনিময়ে বনি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বা সন্ধান অজ্ঞাত থাকে ৷
জেনি অব ক্লিসন
জেনি লুইস অব বেলিভিল নামে জন্ম নেন প্রত্যন্ত বৃটেনের এক পরিবারে ১৩০০সালে ৷ পরে ১৩৩০ সালে অলিভার অব ক্লিসন নামে এক ধনী ব্যক্তিকে বিয়ে করেন ৷ ফ্রান্স কর্তৃক ভানেসের পতন হলে তাকে আটক করে প্যারিসে নিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় রাজা ফিলিপ ৬ষ্ঠ এর আদেশে ৷ প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে জেনি ফিরে আসেন ৷ জমি বিক্রি ও ধনীদের নিকট নিজ দেহ দান করে অর্জিত অর্থ দিয়ে ৩টি যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করেন ৷ যাদের চিহ্ন ছিল কালো রঙের মাঝে লাল পাল ৷ এই কাল বহরগুলো প্রচুর ফরাসী যুদ্ধজাহাজকে পরাস্ত করে ও কিছু লোককে বাচিয়ে ফেরত পাঠানো রাজা ফিলিপ ৬ষ্ঠ এর নিকট হুমকি স্বরূপ ৷ ১৩৫০ সালে রাজার মৃত্যুর পরও তাদের আক্রমণচলতে থাকে ৷ পরে ১৩৫৬ সালে এ কাজে ইস্তফা দিয়ে নিজ মাতৃভূমিতে সুখে বসবাস করতে থাকেন ৷
চিং শি
চিং শি র জন্ম ১৭৭৫ সালে যে ১৯শতকে চীন সাগরে দাপটের সহিত দস্যিপনা করেন ৷ জন্ম নিয়ে খুব বেশী জানা গেলেও একজন বেশ্যা হিসেবে কানতন শহরে নিয়োজিত ছিলেন ৷ ১৮০১ সালে সে শহরটি জলদস্যু দ্বারা দখল হলে ক্যাপ্টিন জেন ঝি কে বিবাহ করেন ৷ জেন ঝি আরও কিছু জলদস্যু নিয়ে একটি সংঘ গড়ে তোলেন যার নাম রেড ফ্ল্যাগ ফ্লিট ৷ ১৮০৭ সালে জেন ঝির মৃত্যুর পর চিং শি পুরো সংঘের দায়িত্ব নিয়ে নেন ৷ যার মধ্যে ৩০০ নৌকা ও ৪০.০০০ জন জলদস্যু ছিল ৷ একসময় প্রচুর ব্রিটিশ সৈন্য এদের হাতে নিহত বা বন্দি হন ৷ চীন সরকারের ৬৩টি জাহাজ তাদের হাতে ধ্বংস হলে তাদের সাথে শান্তিচুক্তি করেন ১৮১০ সালে ৷
এনি ডু-লা-ভু
শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধী এনির জন্ম ১৬৫০ সালের দিকে ও তাকে ফ্রান্স থেকে টরটোগা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয় ১৬৬৫ থেকে ১৬৭৫ সালে মধ্যবর্তী সময়ে ৷ সেখানেই জলদস্যু পিয়েরেকে বিবাহ করেন, যা ১৬৮৩ সাল পর্যন্ত টিকে থাকে এক পানশালায় লরেন্স দে গ্রাফ নামক এক সঙ্গীর সাথে মল্লযুদ্ধে সে নিহত হন ৷ পরে তাকেই পুনরায় বিয়ে করেন ৷ ১৬৯৩ সালে জ্যামাইকার উপকূলে তারা মিলিত ভাবে বহু জাহাজ লুট করেন ৷ ১৬৯৪ সালে বৃটিশরা টরটোগা দ্বীপ দখল করে এনিকে তার দু’কন্যা সহ আটক করে ৷ ১৬৯৮ সালে তারা মুক্ত হয়ে লরেন্সের সাথে মিলিত হন ৷ তার ভাগ্যও অজ্ঞাত ৷
গ্রেস ও’মেলি
গ্রেস ও’মেলি র জন্ম আয়ারল্যান্ডে আনুমানিক ১৫৩০ সালের দিকে ৷ হেনরি ৮ম যখন লর্ড অব আয়ারল্যান্ড তখন তার পিতাকে ইংরেজরা ও’মেলির প্রাসাদ থেকে বিতারিত করেন ৷ পরে যুদ্ধে তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের প্রাসাদও বেদখল হয়ে যায় ৷ পরে অবশ্য নিজস্ব বাহিনী কর্তৃক পূনঃদখল করেন ৷ আইরন রিচার্ড নামে একজনকে দ্বিতীয় বিবাহ করেন ও একবৎসরের মধ্যেই তাকে তালাক দেন এবং রকফ্লিট প্রাসাদ দখল করেন ৷ এসময়েই তার পিতার দায়িত্ব হিসাবে সেখানকার উপকূলের জেলেদের থেকে কঠোর হস্তে কর আদায় করতে থাকেন ৷ অতিক্রান্ত জাহাজ হতে নিরাপত্তার নাম করে প্রচুর ধন সম্পদ আদায় করেন ৷ এছাড়াও স্কটিশ ও আইরিশ অভিযাত্যদের বসতে আক্রমণ করেন ৷ তার বিরুদ্ধে শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগও আছে ৷
এলিজাবেধ কিলিগ্র
১৫২৫ সালের পূর্বের কোন অজ্ঞাত দিনে এলিজাবেথ এর জন্ম ৷ কর্ণওয়েল প্রদেশের আরওয়েনাকের স্যার জন কিলিগ্রকে বিবাহের পর তিনি লেডি কিলিগ্র হিসাবে পরিচিত হন ৷ ১৫৪০ সালের পরে রাজা হেনরি ৮ম কর্তৃক স্যার জনের দ্বীপে নির্মিত পেনডেনিস প্রাসাদের নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয় স্যার জন কিলিগ্রকে ৷ এ ক্ষমতা বলে অতিক্রমরত সকল জাহাজ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করে প্রচুর সম্পদ লাভ করে পরে তাদের বাগানের মাটির নীচে লুকিয়ে রাখেন ৷ ১৫৫৭ সালে জনের মৃত্যুর পর সকল সম্পত্তি আয়েত্তে আনেন ৷ ১৫৮১ সালে এলিজাবেথ জ্ঞাত হলেন যে স্পেনীশ সান সাবাষ্টিয়ানের মাফরি নামক জাহাজ ফালমাউথ নামক পোতাশ্রয়ে লুকিয়ে আছে ৷ পরে তার নেতৃত্বে আক্রমণ করে সকল মালামাল জব্দ করেন ৷ এ অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয় পরে অবশ্য ১৫৮২ সালে রাণী এলিজাবেথ তাকে ক্ষমা করে মুক্ত করে দেন ৷
ক্রিস্টিনা আনা স্কাইট
জন্ম ১৬৪৩সালে ৷ পিতা সুইডেনের ডোডেরহফ প্রদেশের ভারোন বা শিল্পপতি জ্যাকব স্কাইট ৷ কিন্তু বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়েও পুত্র ভারোন গুস্তাফ স্কাইট সন্তুষ্ট ছিলেন না আর তাই ১৬৫৭ সাল থেকে দ্বৈত জীবন-যাপন করে জলদস্যুপনা শুরু করেন বালটিক সমদ্র উপকূল দিয়ে চলাচলরত জাহাজের উপর ৷ এ সময়ই ক্রিস্টিনা তার বাগদত্তা গুস্তাফ ডেরেক কে সাথে নিয়ে এ ব্যবসায়ের অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হন ৷ এ সময়ই ভাই ও বোনের মধ্যে দন্দ্বের কারণে খুব ঘনিষ্ঠ একজনকে নিজ হাতে হত্যা করে প্রমাণ দেন ব্যবসাই প্রাধান্য তার নিকট ৷ ১৬৬৩ সালে এক ডাচ জাহাজ আক্রমণ ও লুন্ঠণ করে জাহাজের সকল ব্যবসায়ী ও ক্রোদের হত্যা করে সরকারের কুনজরে পড়ে ৷ পরে সবাইকে গ্রেফতার করে ভাই ও বাগদত্তা প্রেমিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ক্রিস্টিনাকে দেশ থেকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয় ৷ পরবর্তী ইতিহাস অজ্ঞাত ৷
জ্যাকুইটি ডালায়াভ
জন্ম হাইতিতে ৷ মা হাইতিয়ান ও ফরাসী বাবার ঘরে জন্ম নেয়া এ জলদস্যু ৷ জ্যাকুইটি ডালায়াভের শৈশবকাল খুব কষ্টের ছিল ৷ ভাইয়ের জন্মের সময়ই তার মা মৃত্যুবরণ করেন আর ভাইটির জন্ম হয় মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ৷ খুব কমই জানা যায় তার অতীত সম্পর্কে ৷ বাবাকে মেরে ফেলায় এ বদরাগী সুন্দরী অল্প কিছু অর্থ ও তার ভাইকে নিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে পালিয়ে যান ৷ আর বাধ্য হন জলদস্যু হতে ৷ ১৬৬০ সালের পর সরকার গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করায় নিজের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করে আত্মগোপনে চলে যান ৷ এ সময়ে পূরুষের ছদ্মবেশে জীবনযাপন করেন ৷ তার অপর নাম মৃত রোহিতের প্রর্ত্যাবর্তন বা Back from the dead red ৷ ধারণা করা হয় এ্যালি-ডিকো-লে-ভক্ট বা Anne decu-le-vuct উপকূলে একাকী নৌকা নিয়ে হারিয়ে যান তিনি ৷
কৃতজ্ঞতাঃ
উইকিপিডিয়া
গুগল