ঢাকা সহ সারা দেশে অসহনীয় পর্যায়ে বেড়ে চলছে বাড়িভাড়া, অথচ আমরা বন্দী ...
রাজধানীসহ সারাদেশের শহরগুলোতে সাধারণ-অসাধারণ নির্বিশেষে মানুষজন যে বিষয়টিতে প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হন, তা হলো বাড়িভাড়া। বিশেষ করে, এ নিয়ে রাজধানীর মানুষের কষ্টের অন্ত নেই। ক্যাব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার দেড় কোটি জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই ভাড়াটে। এর মধ্যে বেশিরভাগই আবার চাকরিজীবী। এই চাকরিজীবীদের ৭০ শতাংশ আবার তাদের মাসিক বেতনের ৬০ শতাংশই ব্যয় করে বাড়িভাড়ার পেছনে। ফলে পরিবারগুলোর অধিকাংশই সারা মাস আর্থিক টানাপড়েনে ভোগেন। এ অসহায় লোকগুলোকে বাঁচানোর জন্য আইনও করেছে সরকার। কিন্তু আইনের প্রয়োগ না থাকায় বাড়িওয়ালারা বেপরোয়াভাবে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে যাচ্ছেন বাড়িভাড়া। ফলে দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাওয়া ভাড়াটিয়ারা বাড়তি ভাড়ার জোগান দিতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছেন ভয়াবহ সঙ্কটে। অথচ সরকার বিগত ২৪ বছরে বাড়িওয়ালাদের ট্যাক্স একবারও বাড়ায়নি। কিন্তু সরকার ট্যাক্স না বাড়ালেও বাড়িওয়ালারা নানা অছিলা ও উপলক্ষে বছরে কমপক্ষে দুবার বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করেন। আবার এ নিয়ে কথা বলতে গেলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক আচরণ করে থাকেন, যা অত্যন্ত গর্হিত। সব মিলিয়ে বলা যায় ঢাকার ভড়াটিয়ারা মোটেই সুখে নেই।
বাড়িভাড়া সংক্রান্ত আইন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম চালু হয় ১৯৪৩ সালে। ১৯৫৩ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এ আইনের সংশোধন করে। সর্বশেষ সংশোধনী স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আসে ১৯৯১-তে, যা বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অ্যাক্ট ১৯৯১ নামে পরিচিত। কিন্তু আমাদের দেশে কাজির গরু কেতাবে থাকলে কী হবে, বাস্তবে তার কোনো আলামত নেই। ফলে বাড়িওয়ালাদের হয়েছে পোয়াবারো। তারা বিরতিহীনভাবে ভাড়া বাড়িয়েই চলেছেন। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে কতগুলো সাজানো কারণ তোতাপাখির মতো আউড়ে যান; কর বৃদ্ধি, জিনিসপত্রের দাম বাড়া, বিদ্যুত্, গ্যাস, পানিসহ সেবাপণ্যের দাম বৃদ্ধি—এসব। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতি বছরের রাষ্ট্রীয় বাজেট। আবার ভাড়াটিয়ার বেতন বৃদ্ধি হলেও বাড়িওয়ালা মহাআনন্দে ভাড়া বাড়িয়ে দেন। নতুন বছরেও বাড়া বাড়িয়ে দেয়া বাড়িওয়ালাদের পুরনো খাসলত। ইদানীং আরেকটি উপসর্গ গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো উদিত হয়েছে—বাড়িওয়ালারা গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের জন্য আলাদা আলাদা বিল দাবি করে বসেন। অথচ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বলছে, আগের নিয়মে এখনও মোট ভাড়ার ১২ শতাংশ হারে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করা হয়—গত ২৪ বছরে একবারের জন্যও বাড়েনি। বরং একশ্রেণীর অসাধু ট্যাক্স কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক আঁতাতের ভিত্তিতে কম ভাড়া আদায়, ভাড়াটিয়া নেই, বাড়ি অসম্পূর্ণ ইত্যাদি ফাঁকফোকর দেখিয়ে হোল্ডিং ট্যাক্স ফাঁকি দেন বাড়ির মালিকরা।
আমার দেশ-এ প্রকাশিত রিপোর্টমতে, ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া আইনের আওতায় ঢাকা মহানগরীর ৯০টি ওয়ার্ডের ১০টি কর অঞ্চলের ৬৭৩টি এলাকার বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এলাকাভেদে বাড়িভাড়ার হারও ভিন্ন ভিন্ন করা হয়। তারপরও একদিনের জন্যও সঙ্কট দূর হয়নি বা সঙ্কট দূর করার জন্য যাদের এগিয়ে আসার কথা, তারাও কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে গেছে। মাঝখানে পড়ে ভাড়াটিয়ারা হয়ে পড়েছেন বাড়িওয়ালার হাতে জিম্মি। আবার প্রতিকারহীন বলে ভাড়াটিয়ারাও সংঘবদ্ধ হওয়ার বদলে বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে মিতালি রেখে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন।
বাড়িওয়ালাদের এ নিয়ন্ত্রণহীন দাপট নতুন নয়। ভোটের রাজনীতি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে পৌর-কর্পোরেশনগুলোও আইন প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনকভাবে নমনীয়তা দেখিয়ে আসছে। আবার ভাড়াটেরা সংঘবদ্ধ নন বলেও অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সব মিলিয়ে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জগিট একতরফাভাবে বাড়িওয়ালারা ভোগ করছেন। ক্ষেত্রবিশেষে বাড়িওয়ালারাও যে ভাড়াটে কর্তৃক যাতনার শিকার হননি— তাও নয়, হয়েছেন। তবে তা অতি বিচ্ছিন্ন দু-একবার মাত্র। যা হোক, আমরা জনজীবনের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত এ কায়েমি সঙ্কটের সমাধান প্রত্যাশা করব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইনকে একটু দলাই-মলাই করেও যদি প্রয়োগ করা যায় তাও ভালো। একটা কিছু না হওয়ার চেয়ে তা বরং উত্তম। রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তারপরও উদ্যোগ যাদের নেয়ার দরকার, তাদের এগিয়ে আসতে হবে।