এক,
শো শো শব্দে চলে যাচ্ছে হিমেল হাওয়া, কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা একটা অনুভূতি, তৃপ্ত চুপ করে বসে আছে। মাঝে মাঝে তারা দেখছে, অবাক কান্ড, একবার মনে হচ্ছে আকাশ ঝকঝকে, একবার মনে হচ্ছে মেঘেরা ধর্মঘট ডেকেছে।
সিগারেট টা আবার হাতেই শেষ হল, আজব রকম রোমান্টিক রাত, তৃপ্ত'র মনে দুঃখ নেই, আবার আনন্দ ও নেই। আমার মনে হয় না ও কিছু ভাবছে, কিন্তু তবুও ভুলে যাচ্ছে সিগারেটে চুমুক দিতে। আচ্ছা রাত এখন ক'টা বাজে ? আমি জানিনা, তৃপ্ত ও জানেনা, ও ঘড়ি পরেনা। একবার বলেছিল , "ঘড়ি পরলে সময় আমাকে বেঁধে ফেলে, তাই ঘড়ি পরিনা, তুমি লেখক মানুষ, তুমি ঘড়ি পরো ?" আমি কি বলবো ? মোবাইল থাকায় তো ঘড়ি পরার দরকার ই পরে না, কিন্তু তৃপ্ত কে তা বলে লাভ নেই।
যাই হোক গল্পে ফিরে আসি, তৃপ্ত বসে আছে আখাউড়া জংশনে, মাঝে মাঝে ট্রেন যায়, মাঝে মাঝে কানের কাছে মশারা গুনগুন করে। আমার মনে হয়না আমাদের উপন্যাসের নায়ক তৃপ্ত এতসব খেয়াল করছিল, সে অপেক্ষা করছে কখন একটা হাফপ্যান্ট পরা ছেলে এসে বলবে "মামা চা লাগবো নি ?" ।
শুরু হল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, আখাউড়া জংশনের একটা মজার ব্যাপার হল এখানে হরেক রকম মানুষের ভীড়, অনেক গুলো জংশন একসাথে, কত রং, কত রূপ, আরেকটা মজা হল ট্রেন কখন আসে কেউ বলতে পারেনা, তাই অপেক্ষারত মানুষ দেখে দেখে নিজের ধৈর্য্য শক্তি বাড়ানো যায় (বাংলাদেশ বলে কথা) ।
অনেকে বৃষ্টি ঠেকাতে আড়ালে গেল, অনেকে হালকা বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, ট্রেন এলে সিট পেতে হবে (কারণ বেশির ভাগই স্ট্যান্ডিং টিকিট কেটেছে সিটিং টিকিট না থাকায়, কিন্তু সবাই জানে চেয়ার গুলো ঠিকই খালি থাকবে) ।
তৃপ্ত বসে আছে, আগের যায়গায়, আগের মতই, প্রার্থনা করছে বৃষ্টিটা যেন ঝুম বৃষ্টি হয়। ওর ধারণা ঝুম বৃষ্টিতে ভিজলে কষ্ট কমে যায়, ভেজার পর নিজেকে দারুণ পবিত্র লাগে।
কিন্তু ঝুম বৃষ্টি'রা জীবনের আর সব আনন্দের মতই ফাঁকি দিচ্ছে। আসবেই না পণ করেছে। প্লাটফর্মে মারাত্মক রূপবতী এক মেয়ে ছুটে চলেছে ওয়েটিং রুমের খোঁজে, মেয়েটা রূপবতী নাকি মমতাময়ী ? বোঝা যাচ্ছে না, তার মানে মেয়েটা মা হতে চলছে, একমাত্র মা হবার সময় ই নারী অচেনা হয়ে যায়, তখন তার মাঝে পবিত্রতা ভর করে, যে পবিত্রতার কাছে সব চাহিদা হার মানে, জেগে থাকে শুধু শ্রদ্ধাবোধ।
তৃপ্ত আর বসে থাকতে পারলো না, উঠে আসলো, বড্ড চায়ের তেষ্টা পেয়েছে ওর, প্রকৃতি মানুষ কে অভ্যাস এমন একটা দিক দিয়েছে যে জন্যে প্রকৃতি নিজেও মাঝে মাঝে হাহাকারে ডুবে, এই যেমন এখন চা খাবার বদ অভ্যাসের কাছ থেকে হার মেনে তৃপ্ত প্রকৃতি কে ছেড়ে চায়ের স্টলের দিকে গেল এতে কি প্রকৃতির একটু ও খারাপ লাগেনি ?
তৃপ্ত চায়ের স্টলে গিয়ে বললো "মামা একটা চা দেন” দোকানদার কিছু বললো না, দুধ ছাড়া চিনি কম দিয়ে একটা লিকার বানিয়ে দিল, লিকার টা আবার দুধ চায়ের কড়া লিকার, সে জানে তৃপ্ত এই সময় এভাবেই চা খায়। দোকানির নাম সোবহান, সে চেনে তৃপ্ত কে, আর জানে যে এমন ভাল ছেলে সে জীবনে দেখেনি, আর দেখবে ও না, এই ছেলেটা প্রচুর নেশা করে করে কিন্তু কখনো নিজেকে ভুলেনা, মাতাল হয়, কিন্তু কাউকে গালি দেয়না, এমন কি রাস্তার ভিখারী কেও সে আপন সুরে মামা ডাকে, সালাম দেয়, আজব ছেলে। কত মানুষ আসে আখাউড়া তে, ফেন্সিডিল এখানে সস্তা বলে, কত মানুষ দেখল সোবাহান মিয়া তার এই ২২ বছরের চায়ের দোকানে, অথচ এই ছেলেটা আলাদা। সোবহান এবার তৃপ্ত কে বললো,
-মামা বাইরে তো মেলা বিরিষ্টি, আপনের বাড়ি ঢাকায়, আইজকা ট্রেন আইব না, রেল লাইনে কি একখান সমেস্যা, ওইদিক থন আসা সব ত্রেন বন্ধ, আজ আমার সাথে থাকবেন ?
তৃপ্ত প্রতিবারের মত আবারো অবাক হল, সোবাহান সব যুক্তাক্ষর শব্দ অশুদ্ধ ভাবে বললেও ‘ট্রেন’ শব্দটা নির্ভুল উচ্চারণ করে, হয়তো এর সাথে তার জীবন সংসার বাঁধা বলেই প্রকৃতি তাকে এটা আপন মনে শিখিয়ে নিয়েছে, ও বললো, থাকবো, কিন্তু আগে বলেন,
-মামী আজ কি রেধেঁছে ?
-করল্লা ভাঁজি আর সিম ফুলকপি দিয়ে নলা মাছ,
তৃপ্ত বললো, ওকে মামা, আজ আপনার বাসায় থাকবো, কিন্তু আমাকে ডিম ভাজি করে দিতে হবে, আমি করল্লা খাই না, যেহেতু আপনারা দুই পদ তরকারি খাবেন সেহেতু আমাকেও ডিম ভেজে দিয়ে দুই পদ দিয়েই খাওয়াতে হবে।
সোবহান অভিভূত, এই অচেনা ছেলেটার ওপর কেন এত মায়া তা সে নিজেও জানেনা, সে শুধু জানে এই অপরিচিত কে স্নেহ করতে হবে, অসীম স্নেহ। মুখ বলা ভাগ্নে আজ তার বাসায় খাবে, এ যেন তার কাছে বিরাট পাওয়া। আচ্ছা এই ছেলে কি জাদু জানে ? সব কাষ্টমার ই তো মামা ডাকে, তবে কেন এর প্রতি এমন আলাদা টান ?
আমি আর কি বলবো পাঠক ? কিছু ভালবাসার ব্যাখ্যা তো সয়ং বিধাতাই জানেনা, আমি কোন ছার ?