ডাক্তারবাবু বাবার নার্ভাসনেস দেখে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডমিশনের সুপারিশ করলেন । আমি ছুটে গেলাম রিসেপশনে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্লোরবয় টলি নিয়ে চলে এলো । বাবাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে যাবতীয় ফর্মালিটিজ মেনটেন করে সেদিন অনেক বেলা করে যখন বাড়ি ফিরলাম মাকে বলতেই মা শোনা মাত্রে সংজ্ঞা হারালেন ।
অনেকক্ষণ ধরে চোখেমুখে জল দিয়ে অবশেষে মা চোখের পাতা খুললেন । প্রতিবেশী কয়েকজন অবশ্য ছুটে এসেছিলেন । সবাই মিলে ধরাধরি করে মাকে বারান্দায় একটা চৌকির উপর শুইয়ে দিয়েছিলাম । মাথার কাছে বসে মায়ের ভেজা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা এক সময় শক্ত করে আমার হাতটি চেপে ধরলেন। আমি মায়ের কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিয়ে সাহস জোগাতে লাগলাম । বোঝাতে লাগলাম
- যে বাবাকে সুস্থ করতে হলে আমাদেরকে নতুন করে সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হবে । তুমি যদি এভাবে অসুস্থ হও বা ভেঙে পড়ো তাহলে আমরা কি করে লক্ষ্যে পৌঁছাব ?
বিছানা থেকে এবার মা উঠে বসলেন।
- হ্যাঁ বাবা ! ঠিকই বলেছ । আসলে সকাল থেকে তোমাদের কোন খবর পাচ্ছিলাম না। তাই হঠাৎ করে তোমার মুখে খবরটি শুনে আর নিজেকে সামাল দিতে পারিনি ।
উপস্থিত প্রতিবেশীরাও সবাই আমার সুরে মাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন । প্রাথমিকভাবে সেদিন প্রতিবেশীদের আচরণে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম ।
প্রথম তিনদিন বাবাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। আমি সামান্য বেতনে একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করি। নার্সিংহোমের বিল হু হু করে বাড়ছিল। কাজেই একটা অজানা আশংকায় আমি ক্রমশ গুটিয়ে যেতে থাকি। প্রতিটি মুহূর্তে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে নার্সিংহোমের পাকা বিল মেটাবো কিভাবে- তা ভেবে ।
আমাদের আত্মীয় স্বজন নেহাত কম ছিল না। কিন্তু ছোট থেকেই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকায় কারও সঙ্গে তেমন হৃদ্যতা ছিলনা। পাশের পাড়ায় ছিল আমার মামার বাড়ি অথচ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকারই মত । ছোট থেকে দেখে এসেছি মামার বাড়ি হল সকলের খুব আদরের জায়গা। আমি ছোট থেকেই বন্ধুদেরকে দেখতাম তাদের মামার বাড়ির নানা রকম খাওয়া-পরার সুন্দর সুন্দর গল্প করতে । ওদের ওইসব গল্প শুনে নিজেকে খুব বিষন্ন লাগতো। একবার তো মাকে বলেই ফেলেছিলাম,
- মা! বন্ধুদের মামার বাড়ির সুন্দর সুন্দর গল্প শুনে আমারও এরকম একটি গল্প ওদের শোনাতে ভীষণ ইচ্ছা করে।
মা আমার কথা শুনে নির্লিপ্ত থাকে । মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমি আবার বলি,
-আচ্ছা মা ! আমাদের মামার বাড়িটার কোন পরিবর্তন করা যায় না?
এবার মা আমার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন ,
-বাবা-মা সন্তানের সবচেয়ে কাছের। কেন আমি বা তোমার বাবা কি তোমাদেরকে কম ভালোবাসি ? যে কারণে মামাদের নিয়ে তোমাকে এতটা ভাবতে হচ্ছে ?
আমার সেই কৈশোরে সেদিন মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আপনজনের পরিচয়দান করাতে আনন্দের সঙ্গে বেশ লজ্জাও পেয়েছিলাম। মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই তাই মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়েছিলাম ।
যাইহোক বাবা নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়ায় প্রতিদিন ভিজিটিং আওয়ার্সে আমাদের এই সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের দেখতে আসার ঢল নেমেছিল । আমি যতটা সম্ভব শুকনো মুখেও হাসি হাসি ভাবে ওনাদের সঙ্গ দিতে লাগলাম । ওনারা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়ায় বাবার চিকিৎসা , ঔষধ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ঠিক ঠিক হচ্ছে কিনা তার খোঁজ খবর নিতেন। আরো কি কি করলে ভালো হতো বা সে সম্পর্কেও নানা রকম ফিরিস্তি দিতেও কুণ্ঠা করতেন না। আমি নিরবে ওনাদের অতি আপনজন সাজার অত্যাচার সহ্য করতে লাগলাম ।
আমার মা সারা জীবন গ্রামে কাটানোয় বা বেশি সরলতার কারনে হোক মানুষের মুখের কথাতে সব ভুলে যেতেন। নার্সিংহোমে রোগী দেখতে এসে এই সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের খোশগল্পে আমি বিব্রত বোধ করলেও মায়ের মুখের ভাষান্তরে তেমন কিছু ধরা পড়তো না । তবে বাড়ি এসে ধরিয়ে দিলে অবশ্য মা আমার কথার মান্যতা দিতেন ।
তিন দিন আইসিইউতে রাখার পরে আমি সরাসরি ডাক্তারবাবুকে আমার অসহায়ত্বের কথা জানালাম । ডাক্তারবাবু মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।
ওনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া,
-হ্যাঁ ! তুমি না বললে আমি আজি তোমার বাবাকে জেনারেল বেডে রেফার করতাম ।
উনি অবশ্য কথা রেখেছিলেন । তবে আমার মনে একটি প্রশ্ন তখন বদ্ধমূল হয়েছিল ; যে মানুষটা হেঁটে হেঁটে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছিলেন , সেই মানুষটির কি সত্যিই তিনদিন আইসিইউতে রাখার দরকার ছিল?
বাবার নার্সিংহোমের বিল মেটাবো কি করে - এসব ভেবে এক অসহনীয় দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরে তৃতীয়দিন রাতে মা -ছেলের সময় আর কিছুতেই যেন কাটছিল না । ওদিকে বাবার ক্রমশ উন্নতিতে কোথায় আমাদের আনন্দিত হওয়ার কথা ; কিন্তু দুশ্চিন্তার কালো মেঘ আমাদের চারপাশে এক দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি করল । চারিদিকে আত্মীয়-স্বজন অথচ সবাই কত অচেনা ! পেটে খিদে আছে অথচ মুখে কিছু রোচে না । রান্নাঘরে খাবার রেডি অথচ সেটা খাওয়ার ইচ্ছাটুকুও চলে গেছে । জীবনের সব চেনা ছন্দ অথচ সেগুলো এখন সব অচেনা ঠেকলো । সেদিন রাতে বোন তখন ঘুমিয়ে গেছে। মা আর আমি বসে বসে রাত পার করছি। মুখে কথা হয় একটি বা দুটি অথচ আধঘন্টা বা তারও বেশি কেবল নীরব থেকেছি । মাঝে মাঝে মা ছেলের বড় বড় দীর্ঘশ্বাস গুলি সেদিন নিস্তব্ধ গভীর রাতে যেন আমাদের অসহায়ত্বের সাক্ষ্য দিয়েছিল। এদিকে রাত ক্রমশ বাড়ছে , চোখে নেই ঘুম ; যেমন পেলাম না বাবার বিল মেটানোর সমাধানও। হঠাৎ মায়ের মুখে স্মিত হাসি ,
-বাবু! তোমার দাদি আমার দুগাছ রুপোর বাউটি ও একজোড়া পায়ের মল দিয়েছিল । আর বাড়িতে একটি পিতলের বদনা, একটি পিতলের কলসি ও দুটি কাসার থালা আছে সঙ্গে আমার নাকছাবিও - এগুলো বিক্রি করে দেখো বাবা কত হয়?
মায়ের এই সরল সমাধানে আমি একটি শুষ্ক প্রাণহীন হাসি দিয়ে বললাম,
-মা ! নার্সিংহোমের বিল বাবদ আমাদেরকে এত বেশি টাকা শোধ করতে হবে যে তোমার ঐ স্ত্রীধন দিয়ে তেমন কিছুই হবে না । আর নাকছাবি বিক্রির কথা একদম মুখে এনো না।
আমি আমার মাকে কোনদিন ওই মূল্যবান রুপার অলঙ্কার দুটি পড়তে দেখিনি। কিন্তু পুরানো ট্রাংকে রুমাল মোরা একটি পুটলির মধ্যে মাকে ওই অলংকারটিকে মাঝে মাঝে খুলে দেখতে দেখেছি। তখন বুঝতাম না মা কেন অলংকারটি খুলে মাঝে মাঝে দেখে। রুপো যে মূল্যবান একটা ধাতু তা ছোট থেকে জানতাম । কিন্তু রৌপ্যের বস্তুগত মূল্যের চেয়ে তার অন্তর্নিহিত মূল্য যে বহু গুণ বেশি সেটা বুঝেছি সেদিন, যেদিন পাড়ার ভাঙাচোরা জিনিস ক্রয় করতে আসা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মদন কটকটি খাওয়ার লোভে একটি বাউটি হস্তগত করে ফেরিওয়ালাকে দিতেই,
-বাবু ! এবাউটি কার?
-কেন! আমার মায়ের।
-তোমার মা কি তোমাকে এটা আমাকে বেঁচতে দিয়েছেন?
-না, আমি তোমার কাছ থেকে মদন খাব বলে ট্রাংক থেকে নিয়ে এসেছি।
-আমি তোমাকে এমনি এমনি কিছু মদন দেব ; তবে এই বাউটি আমি তোমার মায়ের অনুমতি ছাড়া নিতে পারব না।
-তোমার অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই। আমার বাউটি আমাকে ফেরত দাও। আমি মদন খাব না।
-না, এ জিনিস ফেরত দিতে হলে তোমার মায়ের হাতেই ফেরত দেবো।
বাস্তবে আমি তখন প্রচন্ড ভয় পেলাম । ফেরিওয়ালাকে আমি মুখ কাচুমাচু করলেও সে ব্যাটা আমার কথা শুনল না ; উপরন্তু আমাদের বাড়ির সামনে এসে জোরে জোরে ভাবি ভাবি বলে ডাকতেই মা বেরিয়ে এলেন,
-ভাবি এই বাউটিটা আপনার?
-হ্যাঁ ! এতো আমার বাউটি। তুমি কোথায় পেয়েছো?
-আপনার ছেলে আমাকে দিয়েছে মদন খাবে বলে।
-হাই আল্লাহ! তুই মদন খাবি বলে এটা বার করে নিয়ে এসেছিস?
-মা ! আর কখনো করবোনা । আমার ভুল হয়ে গেছে।
-জানিস ! কেন এটা আমার কাছে এত মূল্যবান ? আমার বিয়েতে তোর দাদি আমাকে এটা উপহার দিয়েছিল। আমি এটা না পড়ে পড়ে যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছি । আর তুই কিনা এটাকেই খুঁজে পেলি মদন খাবি বলে ?
আমি একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি ; বুঝতে পেরে প্রচন্ড জোরে কাঁদতে থাকি । পাশে ফেরিওয়ালাকাকু আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন । মায়ের মনও ততক্ষনে গলে গেছে। এবার দুজনেই আমাকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । কিছুক্ষণ পরে মা ফেরিওয়ালাকাকুকে বললেন,
- ভাই, তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব , তা বলে বোঝাতে পারবো না ।
-ভাবি থাক থাক; আর ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নেই । আমরা গরীব মানুষ সামান্য ফেরি করেই জীবিকা নির্বাহ করি। তবে ফেরিওয়ালা হওয়ায় সবাই আমাদেরকে মানুষ বলে মনে করে না। অথচ দেখুন আমরা তো কাউকে ফাঁকি দিই না তবুও সমাজের চোখে আমরা অচ্ছুৎ।
সেদিন ফেরিওয়ালাকাকু হাসতে হাসতে বিদায় নিতেই আমি মায়ের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকায় মা প্রশ্ন করেছিলেন
- অমন করে কি দেখছিস?
-মা বাউটি দুটি তোমার এত প্রিয়!
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,
-হ্যাঁ রে বাবা ! একদম তোদের দুই ভাই-বোনের মতোই প্রিয়।
আজ মায়ের সেই বাউটি বিক্রির কথা বলতেই আমার অন্তরে যেন চাবুকাঘাত করল। বিকল্প সংস্থান খোঁজার জন্য আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম।
যথারীতি চতুর্থ দিনে বাবাকে জেনারেল বেডে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেটা দেখে সেদিন বিকালে আমি স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
চলবে...
বিশেষ দ্রষ্টব্য: - আজকের পর্বটি ব্লগে আমার ছোট ভাই প্রান্তকে ( আশরাফুল আলম প্রান্তকে ) উপহার দিলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৫