সেদিন বাড়িতে এসে এক বিপত্তি ! এত সকালে আমাকে দেখে সকলেই খুব অবাক হলেন। সরাসরি স্কুল থেকে আসছি বা অন্য কোথাও ছিলাম কিনা - এমন হাজারো প্রশ্নের মধ্যে আমাকে পড়তে হলো। তাৎক্ষণিক ভাবে আমি বেশ সমস্যায় পরলাম বৈকি। কারণ এমন অসময়ে গৃহে আগমনে এরূপ বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে ; এমন আশঙ্কা আমার মনের মধ্যে একবারও হয়নি। একজন মহিলা সহকর্মীর বাবা অসুস্থ ; তাকে সঙ্গ দিতে সুদূর স্কুল থেকে কলকাতা পর্যন্ত আসা - বলাটা নিরাপদ নয় বিবেচনা করে ওনাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে নিরুত্তর থাকলাম । মা আমার এই হঠাৎ আগমনের কোন সদুত্তর না পেয়ে বেশ বিরক্ত প্রকাশ করলেন,
- তোমরা এখন অনেক বড় হয়ে গেছো। বাইরে থাকো, কাজেই ইচ্ছা মত চলাফেরা করবে - এটাই তো স্বাভাবিক। ঠিকই তো ,এখন তোমাদের কাজে বাবা -মা নাক গলাবে কেন ? আর তোমরাই বা সেটা মানবে কেন ?
আমি আপন মনে অপ্রয়োজনীয় হাবিজাবি কাজ দেখিয়ে নিজেকে মহান ব্যস্ত প্রমাণ করতে লাগলাম । কিছু পরে বাবা পুরনো চব্বিশ ইঞ্চি হাম্বার সাইকেলটা নিয়ে বাজারে গেলেন। চোখ না তুললেও বুঝলাম আমার এই নির্লিপ্ততা ওনাকেও বেশ চিন্তিত করে তুলেছে। মনে মনে এমন অসময়ে বাড়ি এসে নিজের বোকামির জন্য ধিক্কার দিতে লাগলাম। কিন্তু তখন যে সবকিছু আমার হাতের বাইরে চলে গেছে ।
সেদিন ওই সময় বোন বাড়ীতে ছিল না, টিউশনিতে গেছিল । পরে বাড়ি এসে আমাকে দেখে ভীষণ আনন্দ প্রকাশ করলো। আমিও আকার-ইঙ্গিতে শুকনো মুখে ওর অনুভূতির জবাব দিলাম। ও ব্যাগপত্র রেখে রান্নাঘরে চলে গেল। মায়ের সঙ্গে কি কথা হয়েছিল জানিনা , তবে কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে সেই একই প্রশ্ন,
- তুই রাতে কোথায় ছিলি দাদা ? কি লুকাচ্ছিস আমাদেরকে? কেন লুকাচ্ছিস? জানিস মা- বাবা খুব রাগ করেছেন আজ তোর উপরে । মা তো আশঙ্কা করছেন যে তুই হয়তো কোনো বড় ধরনের বিপদে পড়েছিস বা পড়তে চলেছিস। সেরকম হলে আমাদের না জানালে তুই কি নিজেকে সেভ করতে পারবি?
আমি বোবার মত বোনের কথাগুলি শুনলাম কিন্তু মুখে কিছু বললাম না । তবে ওর মুখে মায়ের আশঙ্কার কথা শুনে মনে মনে শিউরে উঠলাম । ছোট থেকে শুনে আসছি সন্তানের সাফল্য ব্যর্থতা নাকি মায়েরা তৃতীয় নয়নে দেখতে পায় । শেফালীম্যাডামকে নিয়ে আমার মনে যে পরিবর্তন, তাকে আঁচ করেই মা এমন আশঙ্কা করছেন কিনা ; মনে মনে আমিও বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পরলাম।
শেফালীম্যাডামকে ধর্মতলায় বিদায় জানানোর সময় কথা হয়েছিল যে যত দ্রুত সম্ভব আমরা আবার হসপিটালে ওনার বাবার কাছে পৌঁছে যাব। কিন্তু আমি এক্ষুনি যে বিপদে পড়েছি তা থেকে আজ আর গোটা দিনে স্কুলে ফিরে যাওয়ার কথা মুখে আনতে সাহস পেলাম না। দুপুরে খাওয়ার প্লেটে পেল্লাই সাইজের সরিষা - ভেটকির একটি বড় মাথা, সঙ্গে একটি গাদা দেখে মনে মনে পুলকিত হলাম । মায়ের হাতের খাবার অনেকদিন পরে পেয়ে মন ভরে উঠলো । সাধারণত আমি এক পিস মাছ খাই । কিন্তু আজ দু পিস মাছ দেখেও মাকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না । আশঙ্কার চোরা স্রোত প্রবাহিত হওয়ায় সেদিন খাবারে কোন স্বাদ না পেলেও মুখ বুজে দু -পিস মাছ খেয়ে নিলাম। মাও খুব খুশি হলেন পাশে বসিয়ে আমাকে খাওয়াতে পেরে। যদিও বুঝতে দিলাম না যে মাছের শেষ অংশটুকু খেতে আমার যথেষ্ট সমস্যা হয়েছিল। খেতে খেতে মা জানতে চাইলেন ,
-তুমি দুদিন থাকবে তো বাড়িতে?
-না মা , আমার বাড়ি পড়ার ড্রেসপত্র একদম কমে গেছে। ভয়ানক সমস্যা হচ্ছিল হোস্টেলে। গতকাল স্কুলের একটি গাড়ি কলকাতায় কাজে এসেছিল । আমি ঐ গাড়ীতে করে এসেছিলাম। কিন্তু গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়াতে ড্রাইভারকে ফেলে আর আমি আসতে পারেনি । যে কারণে গ্যারেজে রাত কাটাতে বাধ্য হই । সকালে ড্রাইভার চলে যেতেই আমিও বাড়ি চলে এলাম ।
-তাহলে তো তুমি বলতেই পারতে যে রাতে ড্রাইভারের সাথে গ্যারেজে ছিলে।
- হ্যাঁ , মা আমার একটু ভুল হয়ে গেছে । আসলে গ্যারেজে ছিলাম বলে তোমাদের জানাতে চাইছিলাম না ।
-এটা আর আমাদের না জানানোর কি আছে ।
-আসলে রাতের গ্যারেজে যে রাজ্যের যত নোংরা লোকদের আসা যাওয়া হয় এই জন্য ।
এবার অবশ্য মায়ের মুখ বেশ উজ্জ্বল হলো। বোন পাশে ছিল সেও আমার কথার প্রতিধ্বনি করে বলল,
-দাদা! তুই রাতে তাহলে গ্যারেজে ছিলি ?
-হ্যাঁ! বলতেই ,
- গ্যারেজের লোকেরা রাতে সব ড্রিংক করে । তুইও ওসব খাস নি তো?
-ধুস! পাগলী কোথাকার! যা তা বলছিস। তবে তোর অনুমান সঠিক। তোর দাদা অবশ্য ওসব কখন ছুঁয়েও দেখেনি ; আর নিশ্চিত থাকতে পারিস কোনও দিন দেখবেও না।
এবার মা বলে উঠলেন,
-কি যে বাবা সব সময় ভয় হয়! কখন যে কি বিপদ আসে মনের মধ্যে সবসময় কুডাক ডাকে। আগে তুমি বাড়িতে ছিলে, এত চিন্তা হতো না। কিন্তু এখন চোখের আড়ালে থাকো। সারাক্ষণ একটা দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে ।
একটা সত্যকে গোপন করতে আর একটা মিথ্যাকে আশ্রয় নেওয়াতে আমার মনের মধ্যে এক চোরা স্রোত প্রবাহিত হতে লাগল । ইতিপূর্বে কখনোও বাবা-মাকে মিথ্যা কথা বলিনি। কিন্তু আজ যে কুহেলিকার কারনে মা-বাবাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করতে মিথ্যার আশ্রয় নিলাম তা আমাকে বিদ্ধ করলো । ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেদিন সারা দিন ও রাত এক অসহনীয় অবস্থা পার করে পরেরদিন সকালে যখন স্কুলে রওয়ানা দেব বলে তৈরি হচ্ছি অমনি মা এসে বললেন,
-তোমার বাবার বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ।
-সেকি!
বলেই সঙ্গে সঙ্গে আমি বাবার ঘরে ছুটে গেলাম। দেখলাম বেশ অস্বস্তির মধ্যেও উনি প্রতিদিনকার মত যোগাসন করে চলেছেন।
-আপনি এত শ্বাস কষ্টের মধ্যেও ব্যায়াম করছেন ?
-হ্যাঁ ,একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ঠিকই ; তবে তুমি ওসব ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে । তুমি এখনো রেডি হওনি ? যেতে হবে তো, দেরি করছো কেন?
-আপনার শরীর খারাপ দেখে আজ আর যেতে মন চাইছে না।
-অনেকদিন পরে এসছো, মন না চাইলে যেও না । কিন্তু আমার জন্য ভেবোনা বা খামোকা দেরি করো না । অনেক দূর যেতে হবে। এখনই তৈরী হয়ে নাও।
বাবা নিজে আমাকে তৈরি হতে বলাতে আমি আবার ড্রেস করতে লাগলাম । কিছুক্ষনের মধ্যে নিজেকে তৈরি করে বাবার ঘরে বিদায় জানাতে গিয়ে দেখলাম ,বাবা আর ব্যায়াম করছেন না। শ্বাসকষ্টটা বেশ বেড়ে গেছে। একটা অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করছেন। মাও অবস্থা দেখে শিউরে উঠছেন । ছল ছল চোখে মা মুখে কাপর চাপা দিয়ে একটা ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে মন একেবারেই সায় দিল না । এবার আমি জেদ করলাম,
-আপনাকে এবার আমি সোজা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
-যত্তসব! ফালতু চিন্তা ভাবনা তোমাদের। আমার কিছু হয়নি।
-সে তো দেখতে পাচ্ছি ! আপনার কিছু হয়নি! আপনার শ্বাসকষ্ট , আকার-ইঙ্গিত, অঙ্গভঙ্গিই বলে দিচ্ছে - আপনি কতটা সুস্থ আছেন। আমি আজ স্কুলে যাব না । আপনাকে এখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
অবশেষে বাবা আমাদের চাপের কাছে নতস্বীকার করে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হলেন। বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা পায়ে হেঁটে কিছুটা অটোতে, আবার কিছুটা হেঁটে আমরা শহরের এক নামকরা হার্ট স্পেশালিস্টের চেম্বার পৌঁছেছিলাম । ডাক্তারবাবু বাবার হাত ধরে পরীক্ষা করেই আমাকে বাইরে ডাকলেন । সঙ্গে সঙ্গে ইসিজি করতে বললেন। ডাক্তারের কথায় বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। আমি পাল্টা বললাম,
-সে কি করে সম্ভব ! একটু শ্বাস কষ্ট হচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু উনি তো সকালে ব্যায়াম করেছেন।
-হ্যাঁ, হার্ট অ্যাটাক অবস্থায় ব্যায়াম করাটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। আর যেন কোনদিন ব্যায়াম না করেন ।
সঙ্গে হাজারো গন্ডা বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দিলেন । ডাক্তার অবাক হলেন এরকম রোগী এভাবে হেঁটে হেঁটে চেম্বারে এসেছেন দেখে ।
বাবাকে চেম্বারে বসিয়ে রেখে ডাক্তার বাবু আমাকে পাশে ডেকে নেওয়াতে বাবাকে আর কিছু বুঝতে বাকি থাকল না। আমি ফিরে এলেই ,
-বাবু আমার কি হয়েছে?
-না না! তেমন কিছু হয়নি আপনার।
-তাহলে ডাক্তার বাবু আমার সামনে না বলে তোমাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন কেন?
-কিছু বিধি নিষেধ দিয়েছেন । কিন্তু সেগুলি আপনাকে সরাসরি বললে আপনি চিন্তা করবেন ভেবে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেছিলেন।
-ও! তুমি বলবে না বুঝতে পেরেছি । তাহলে বিধি নিষেধ গুলো কেন দিলেন?
এবার আমি জুতসই কোন উত্তর না পেয়ে, হ্যাঁ না গোছের আমতা আমতা করাতে-
-বুঝেছি,আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে । তবে হার্টের বর্তমান অবস্থা কেমন সেটা কি আমাকে বলা যাবে?
- হ্যাঁ! ইসিজি রিপোর্ট দেখে উনি বলবেন।
ইসিজি রিপোর্ট অনুযায়ী একটি ভাল্ব বসে যাওয়াতে আপাতত ডাক্তারবাবু এডমিশনের পরামর্শ না দিয়ে বরং ঔষধ দিয়ে বাড়িতে কড়া নজরদারিতে রাখার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু নার্সিংহোমের লাগোয়া চেম্বারের নতুন একটি বিপত্তি দেখা দিল। বাবা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সবকিছু আমার কাছ থেকে জেনে নেওয়াই উনি আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছেন না ,হাঁটতে পারছেন না, গায়ে কোন বল নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমি এক্কেবারে দিশাহারা হয়ে পড়লাম। চলবে.......
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-পোস্টটি ব্লগে আমার ছোট ভাই সুজন ওরফে নজসুকে উৎসর্গ করলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৪