ছুটি পড়লে আমরা একটু ঘুরতে বার হই। সেবার আমরা তিন বন্ধু মিলে ডিসেম্বরের ছুটিতে উড়িষ্যার চিল্কা হ্রদের বরকুল্লাতে গেছিলাম । বরকুল্লাতে আমরা ওড়িশা ট্যুরিজুম ডেভলপমেন্ট করপোরেশনের হোটেলে ( ও টি ডি সি) ছিলাম। উল্লেখ্য চিল্কাতে আমরা এবার ডিসেম্বরের ছুটিতেও গেছিলাম । তবে এটা চিল্কার আরেকটি দিক, রম্ভা । এখানেও উঠেছিলাম ওটিডিসির হোটেলে । তবে পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে বরকুল্লার ওটিডিসি রম্ভার ওটিডিসির চেয়ে উৎকৃষ্ট। যাইহোক সেবারও যশবন্তপুর এক্সপ্রেস থেকে নেমে বেশ কিছুটা অটো চেপে আমাদের চিল্কার বরকুল্লাতে যেতে হয়েছিল । প্রথম দিন আমরা চিল্কার সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম ।
জীবনের প্রথম এতো বড় একটা হ্রদ দেখার সুযোগ ও তার অনুপম অনুভূতিতে সেদিন আমরা একেবারে মোহিত হয়ে গেছিলাম । দিগন্ত বিস্তৃত চিল্কার শান্ত জলরাশি আমাদের তৃষ্ণার্ত অন্তরকে ভরিয়ে দিয়েছিলে পরিপূর্ণতায় । নতুন কেনা বন্ধুর এসেলার ক্যামেরাতে পাগলের মতো সেদিন প্রচুর ফটো তুলেছিলাম । তবে আমার কাজ ছিল ক্যামেরার ব্যাগ বহন করে একের পর এক ফটো তোলার কাজে বন্ধুকে সহযোগীতা করা ।
পূর্ব নির্ধারিত দ্বিতীয় দিন সকালে সূর্য ওঠার আগে আমরা গ্রাম দর্শনে বের হই । গ্রাম দর্শনে যত বেশি না গ্রাম দর্শনের আকর্ষণ ছিল তার চেয়ে অনেকগুন বেশি আকর্ষণ ছিল জলরাশির উপর দিয়ে সূর্য উদয় দেখার। ভোরবেলা আমরা একপা -দুপা করে চারিদিকে দেখতে দেখতে ক্রমশ গ্রামের মেঠো পথ ধরে এগোতে লাগলাম । ইতিমধ্যে রক্তিম দেবের দেখাও হয়ে গেছে । আমরা ফটাফট ওনার কয়েকটি ছবি ক্যামেরাবন্দিও করেছি। কিন্তু অজানা স্থানে আরও একটু দেখার জন্য আমরা আরো এগোতে লাগলাম । ইতিমধ্যে তখন এক দেড় ঘন্টা বেলা উঠে গেছে। পরিষ্কার সূর্যালোকের উপস্থিতিতে রাস্তার উপরে চারিদিকে নর-বিষ্ঠার ছড়াছড়িতে আমাদের হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল । একটু পরে দেখলাম কাঁচা রাস্তার ঠিক উপরে বাচ্চারা পটি করছে। আর মনের শান্তিতে একে অপরকে ধূলো( ধূলা) ছুড়ে মারছে । এমন দৃশ্যে আমরা বেশ চমকিত হলাম । পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম্য রাস্তাতে যেমন গরু ছাগলের গোবর দেখলে আমরা এড়িয়ে রাস্তা চলাচল করি , ওখানে তেমনি রাস্তায় পটি দেখে আমরা সতর্কতার সঙ্গে নাক টিপে এগুতে লাগলাম।
এতক্ষণ দেখে দেখে হাঁটার ফলে একটা জিনিস আমাদের নজরে পড়েনি । তিন বন্ধুর মধ্যে প্রথমে আমার চোখে পড়ল ; দেখছি হাঁটু পর্যন্ত অদ্ভুতভাবে শাড়ি পরা একদল মহিলা প্রথমে বসে ছিল অথচ আমাদেরকে দেখে সবাই উঠে দাড়াচ্ছেন । আরও একটু অগ্রসর হতেই বুঝলাম উল্টোদিকে পাড়া থেকে আগত মহিলারা সকালে প্রাতঃ কাজ করছেন এভাবে দলবেঁধে গল্প করতে করতে । কোথাও পাঁচজন আবার কোথাওবা সংখ্যাটা আরও অধিক । সে কারণে সকাল বেলা আমাদের মত আগন্তুককে দেখে কাজে বিঘ্ন হওয়ায় উঠে দাঁড়াচ্ছেন। আবার আমরা চলে যেতেই পিছন ফিরে দেখছি যথারীতি কাজে মগ্ন হচ্ছেন । বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় কলিগকে বললাম,
-লালদা, জোরে পা চালাও ।
- কেন?
-আরে ! দেখছো না মহিলারা প্রাতঃ কাজ করছেন ।
-হ্যাঁরে ! সেটা তো আগে লক্ষ্য করিনি ।
-তবে আমি তোমার ক্যামেরার দিকে কিন্তু ওদের লক্ষ্য করতে দেখলাম । পাড়ার লোক ছুটে এলে আমাদের পিঠ কিন্তু ওরা আস্ত রাখবে না ।
- ঠিক বলেছিস । কিন্তু এখন উপায় !
-দ্রুত ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে , চলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাই ।
-কিন্তু মহিলারা যে এখনো সব কাজে ব্যস্ত । সেই রাস্তা ধরে এখনই ফেরা কি উচিত হবে ?
-তাহলে উলটো দিকের কোনো একটা পাড়াতে গিয়ে বরং আমরা কিছুটা সময় কাটিয়ে আসি ।
-চল , বরং সেটাই করি ।
ভয় পেয়ে পাড়ার কাঁচা রাস্তা ধরে নিচে নামতেই প্রথম যে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা এক্কেবারে ঝরঝরে বাংলাতে জিজ্ঞাসা করলেন
-বাবুদের দেশ কোথায় ?
- আজ্ঞে ! কলকাতায়।
- একদম কলকাতায় ? না আশপাশে ?
-আজ্ঞে ! আপনি ঠিকই ধরেছেন । আমাদের বাড়ি কলকাতাতে নয়, আশেপাশে । কারো বারাসাতে কেউবা ব্যারাকপুরের বাসিন্দা।
-তাহলে তো সে কলকাতাই বৈকি । আসলে আমি ওখানে জাহাজ কোম্পানীতে চাকরি করতাম । খিদিরপুরে বহুবছর পরিবার নিয়ে থেকেছি । ছেলে-মেয়ে সবারই বিয়ে হয়ে গেছে ওখান থেকে । গত বছর আমি অবসর নিয়েছি । সারা জীবন বাইরে কাটিয়েছি । কিন্তু শেষ বয়সে পাকাপাকিভাবে গ্রামে থাকবো বলেই চলে আসা ।
-এখানে আপনার আপনজন কে কে আছে ?
-আপনজন বলতে ভাই ,ভাইপো ,ভাইজী আর আমার স্ত্রী।
-ছেলেমেয়েরা এই বয়সে আপনাদের দুজনকে একাকী থাকতে দিল ?
-শুরুতে আপত্তি করেছিল। কিন্তু আমরা গ্রামের মানুষ ওদের মানুষ করতে বাইরে থেকেছি। পরের দিকে আর যেন পাচ্ছিলাম না । দুই ছেলে কলকাতায় থাকলেও খড়্গপুরে মেয়ে থাকে। ওরা আসে সময় পেলে ঘুরে যায় ।
-কাকু, একটি কথা বলব ?
- হ্যাঁ বাবা ! একটি কেন ,যতগুলো খুশি বল। তোমাদের সঙ্গে বাংলাতে কথা বলতে পেরে যে কি ভালো লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না।
-আপনি সিনিয়র মানুষ, দীর্ঘদিন কলকাতায় থেকেছেন । জাহাজে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেরিয়েছেন। কিন্তু কোথাও কি এমন পথে পটি করা কালচার দেখেছেন ?
-বাবা ! ওই কথা আর বোলো না ।আমাদের এই জাত আর সভ্য হবে না । জানো আমি এখানে চলে আসার পরে বাথরুম করবো বলে ঠিক করেছিলাম । বাড়ির লোক বলল তাতে প্রতিবেশীরা আমাদের খারাপ চোখে দেখবে । বলবে দুদিন কলকাতায় থেকে বাবু হয়ে গেছে । উপহাস করবে । এই বয়সে আর একাকিত্বের ভয়ে আর ওপথে পা বাড়ালাম না । সর্বোপরি যেখানে থাকি সেখানকার তো একটি রীতি আছে । কি আর করব, মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই ।
-আপনার কালচার আপনি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আজ আমরা যে এক বড় ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম আপনাদের ওপেন বাথরুমের জন্য ।
- হ্যাঁ বুঝেছি ! তোমাদের সঙ্গে ক্যামেরা থাকাতে আর তোমরা সকাল সকালে আসাতে যেটা দেখেছো, বেলা করে এলে অবশ্য সে সব কিছু টের পেতে না ।
-অনেক গল্প হল আপনার সঙ্গে কাকু। এবার আমরা আসি। ধন্যবাদ আপনাকে, বলে নমস্কার করতেই। উনিও প্রতিনমস্কার করলেন।
ইতিমধ্যে আমাদের আরো একঘন্টা সময় কেটে গেছে। খিদেও পেয়েছে বেশ । কাজেই জোরে জোরে পা চালিয়ে হোটেলের দিকে এগোতে লাগলাম । ফেরার পথে অবশ্য আর কোনো অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে আমাদের পড়তে হয়নি। কিন্তু বেশ কিছুটা আসার পরে দেখলাম সদ্য মরা দুটি গরু চিল্কার চড়ে পড়ে আছে । পাশের কয়েকটি বাচ্ছাকে সে দিকে আঙ্গুল দিয়ে ওদের ভাষায় কথা বলতে দেখলাম । আমি পরিষ্কার বাংলাতে জিজ্ঞেস করি,
-বাবু, ওখানে কি হয়েছে ?
-দ্বি- গরু মরসন্তি ।
আমরা তিন বন্ধু সদ্য শেখা উড়িষ্যার বাক্যটি ' দ্বি - গরু মরসন্তি ' বলতে বলতে হোটেলে ফিরলাম। 2006 সালের চিল্কাপারের বৃত্তান্ত আজও ওখানে টিকে আছে কিনা অথবা মোদীর ভারতের স্বচ্ছতার আলো সেখানে পৌঁছেছে কিনা সে প্রশ্নটা আমার কাছে অবশ্য অজ্ঞাত ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:১ -চলতি সিরিজ ' মরীচিকা' পাঠকের একটু একঘেয়েমি মনে হওয়াতে একটু স্বাদ বদল করতেই এই সাময়িক পোস্টটি দেওয়া ।
২- উপরের ছবিগুলি প্রথমটি চিল্কার ছবি । আর দ্বিতীয়টি গোপালপুর থেকে দারিংবাড়ি যাওয়ার পথে তিতলির সৌজন্যে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি গ্রামের খণ্ডচিত্র।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৬