somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিল্কাপারের বৃত্তান্ত

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :







ছুটি পড়লে আমরা একটু ঘুরতে বার হই। সেবার আমরা তিন বন্ধু মিলে ডিসেম্বরের ছুটিতে উড়িষ্যার চিল্কা হ্রদের বরকুল্লাতে গেছিলাম । বরকুল্লাতে আমরা ওড়িশা ট্যুরিজুম ডেভলপমেন্ট করপোরেশনের হোটেলে ( ও টি ডি সি) ছিলাম। উল্লেখ্য চিল্কাতে আমরা এবার ডিসেম্বরের ছুটিতেও গেছিলাম । তবে এটা চিল্কার আরেকটি দিক, রম্ভা । এখানেও উঠেছিলাম ওটিডিসির হোটেলে । তবে পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে বরকুল্লার ওটিডিসি রম্ভার ওটিডিসির চেয়ে উৎকৃষ্ট। যাইহোক সেবারও যশবন্তপুর এক্সপ্রেস থেকে নেমে বেশ কিছুটা অটো চেপে আমাদের চিল্কার বরকুল্লাতে যেতে হয়েছিল । প্রথম দিন আমরা চিল্কার সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম ।
জীবনের প্রথম এতো বড় একটা হ্রদ দেখার সুযোগ ও তার অনুপম অনুভূতিতে সেদিন আমরা একেবারে মোহিত হয়ে গেছিলাম । দিগন্ত বিস্তৃত চিল্কার শান্ত জলরাশি আমাদের তৃষ্ণার্ত অন্তরকে ভরিয়ে দিয়েছিলে পরিপূর্ণতায় । নতুন কেনা বন্ধুর এসেলার ক্যামেরাতে পাগলের মতো সেদিন প্রচুর ফটো তুলেছিলাম । তবে আমার কাজ ছিল ক্যামেরার ব্যাগ বহন করে একের পর এক ফটো তোলার কাজে বন্ধুকে সহযোগীতা করা ।

পূর্ব নির্ধারিত দ্বিতীয় দিন সকালে সূর্য ওঠার আগে আমরা গ্রাম দর্শনে বের হই । গ্রাম দর্শনে যত বেশি না গ্রাম দর্শনের আকর্ষণ ছিল তার চেয়ে অনেকগুন বেশি আকর্ষণ ছিল জলরাশির উপর দিয়ে সূর্য উদয় দেখার। ভোরবেলা আমরা একপা -দুপা করে চারিদিকে দেখতে দেখতে ক্রমশ গ্রামের মেঠো পথ ধরে এগোতে লাগলাম । ইতিমধ্যে রক্তিম দেবের দেখাও হয়ে গেছে । আমরা ফটাফট ওনার কয়েকটি ছবি ক্যামেরাবন্দিও করেছি। কিন্তু অজানা স্থানে আরও একটু দেখার জন্য আমরা আরো এগোতে লাগলাম । ইতিমধ্যে তখন এক দেড় ঘন্টা বেলা উঠে গেছে। পরিষ্কার সূর্যালোকের উপস্থিতিতে রাস্তার উপরে চারিদিকে নর-বিষ্ঠার ছড়াছড়িতে আমাদের হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল । একটু পরে দেখলাম কাঁচা রাস্তার ঠিক উপরে বাচ্চারা পটি করছে। আর মনের শান্তিতে একে অপরকে ধূলো( ধূলা) ছুড়ে মারছে । এমন দৃশ্যে আমরা বেশ চমকিত হলাম । পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম্য রাস্তাতে যেমন গরু ছাগলের গোবর দেখলে আমরা এড়িয়ে রাস্তা চলাচল করি , ওখানে তেমনি রাস্তায় পটি দেখে আমরা সতর্কতার সঙ্গে নাক টিপে এগুতে লাগলাম।

এতক্ষণ দেখে দেখে হাঁটার ফলে একটা জিনিস আমাদের নজরে পড়েনি । তিন বন্ধুর মধ্যে প্রথমে আমার চোখে পড়ল ; দেখছি হাঁটু পর্যন্ত অদ্ভুতভাবে শাড়ি পরা একদল মহিলা প্রথমে বসে ছিল অথচ আমাদেরকে দেখে সবাই উঠে দাড়াচ্ছেন । আরও একটু অগ্রসর হতেই বুঝলাম উল্টোদিকে পাড়া থেকে আগত মহিলারা সকালে প্রাতঃ কাজ করছেন এভাবে দলবেঁধে গল্প করতে করতে । কোথাও পাঁচজন আবার কোথাওবা সংখ্যাটা আরও অধিক । সে কারণে সকাল বেলা আমাদের মত আগন্তুককে দেখে কাজে বিঘ্ন হওয়ায় উঠে দাঁড়াচ্ছেন। আবার আমরা চলে যেতেই পিছন ফিরে দেখছি যথারীতি কাজে মগ্ন হচ্ছেন । বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় কলিগকে বললাম,
-লালদা, জোরে পা চালাও ।
- কেন?
-আরে ! দেখছো না মহিলারা প্রাতঃ কাজ করছেন ।
-হ্যাঁরে ! সেটা তো আগে লক্ষ্য করিনি ।
-তবে আমি তোমার ক্যামেরার দিকে কিন্তু ওদের লক্ষ্য করতে দেখলাম । পাড়ার লোক ছুটে এলে আমাদের পিঠ কিন্তু ওরা আস্ত রাখবে না ।
- ঠিক বলেছিস । কিন্তু এখন উপায় !
-দ্রুত ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে , চলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাই ।
-কিন্তু মহিলারা যে এখনো সব কাজে ব্যস্ত । সেই রাস্তা ধরে এখনই ফেরা কি উচিত হবে ?
-তাহলে উলটো দিকের কোনো একটা পাড়াতে গিয়ে বরং আমরা কিছুটা সময় কাটিয়ে আসি ।
-চল , বরং সেটাই করি ।

ভয় পেয়ে পাড়ার কাঁচা রাস্তা ধরে নিচে নামতেই প্রথম যে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা এক্কেবারে ঝরঝরে বাংলাতে জিজ্ঞাসা করলেন
-বাবুদের দেশ কোথায় ?
- আজ্ঞে ! কলকাতায়।
- একদম কলকাতায় ? না আশপাশে ?
-আজ্ঞে ! আপনি ঠিকই ধরেছেন । আমাদের বাড়ি কলকাতাতে নয়, আশেপাশে । কারো বারাসাতে কেউবা ব্যারাকপুরের বাসিন্দা।
-তাহলে তো সে কলকাতাই বৈকি । আসলে আমি ওখানে জাহাজ কোম্পানীতে চাকরি করতাম । খিদিরপুরে বহুবছর পরিবার নিয়ে থেকেছি । ছেলে-মেয়ে সবারই বিয়ে হয়ে গেছে ওখান থেকে । গত বছর আমি অবসর নিয়েছি । সারা জীবন বাইরে কাটিয়েছি । কিন্তু শেষ বয়সে পাকাপাকিভাবে গ্রামে থাকবো বলেই চলে আসা ।
-এখানে আপনার আপনজন কে কে আছে ?
-আপনজন বলতে ভাই ,ভাইপো ,ভাইজী আর আমার স্ত্রী।
-ছেলেমেয়েরা এই বয়সে আপনাদের দুজনকে একাকী থাকতে দিল ?
-শুরুতে আপত্তি করেছিল। কিন্তু আমরা গ্রামের মানুষ ওদের মানুষ করতে বাইরে থেকেছি। পরের দিকে আর যেন পাচ্ছিলাম না । দুই ছেলে কলকাতায় থাকলেও খড়্গপুরে মেয়ে থাকে। ওরা আসে সময় পেলে ঘুরে যায় ।
-কাকু, একটি কথা বলব ?
- হ্যাঁ বাবা ! একটি কেন ,যতগুলো খুশি বল। তোমাদের সঙ্গে বাংলাতে কথা বলতে পেরে যে কি ভালো লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না।
-আপনি সিনিয়র মানুষ, দীর্ঘদিন কলকাতায় থেকেছেন । জাহাজে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেরিয়েছেন। কিন্তু কোথাও কি এমন পথে পটি করা কালচার দেখেছেন ?
-বাবা ! ওই কথা আর বোলো না ।আমাদের এই জাত আর সভ্য হবে না । জানো আমি এখানে চলে আসার পরে বাথরুম করবো বলে ঠিক করেছিলাম । বাড়ির লোক বলল তাতে প্রতিবেশীরা আমাদের খারাপ চোখে দেখবে । বলবে দুদিন কলকাতায় থেকে বাবু হয়ে গেছে । উপহাস করবে । এই বয়সে আর একাকিত্বের ভয়ে আর ওপথে পা বাড়ালাম না । সর্বোপরি যেখানে থাকি সেখানকার তো একটি রীতি আছে । কি আর করব, মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই ।
-আপনার কালচার আপনি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আজ আমরা যে এক বড় ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম আপনাদের ওপেন বাথরুমের জন্য ।
- হ্যাঁ বুঝেছি ! তোমাদের সঙ্গে ক্যামেরা থাকাতে আর তোমরা সকাল সকালে আসাতে যেটা দেখেছো, বেলা করে এলে অবশ্য সে সব কিছু টের পেতে না ।
-অনেক গল্প হল আপনার সঙ্গে কাকু। এবার আমরা আসি। ধন্যবাদ আপনাকে, বলে নমস্কার করতেই। উনিও প্রতিনমস্কার করলেন।

ইতিমধ্যে আমাদের আরো একঘন্টা সময় কেটে গেছে। খিদেও পেয়েছে বেশ । কাজেই জোরে জোরে পা চালিয়ে হোটেলের দিকে এগোতে লাগলাম । ফেরার পথে অবশ্য আর কোনো অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে আমাদের পড়তে হয়নি। কিন্তু বেশ কিছুটা আসার পরে দেখলাম সদ্য মরা দুটি গরু চিল্কার চড়ে পড়ে আছে । পাশের কয়েকটি বাচ্ছাকে সে দিকে আঙ্গুল দিয়ে ওদের ভাষায় কথা বলতে দেখলাম । আমি পরিষ্কার বাংলাতে জিজ্ঞেস করি,
-বাবু, ওখানে কি হয়েছে ?
-দ্বি- গরু মরসন্তি ।
আমরা তিন বন্ধু সদ্য শেখা উড়িষ্যার বাক্যটি ' দ্বি - গরু মরসন্তি ' বলতে বলতে হোটেলে ফিরলাম। 2006 সালের চিল্কাপারের বৃত্তান্ত আজও ওখানে টিকে আছে কিনা অথবা মোদীর ভারতের স্বচ্ছতার আলো সেখানে পৌঁছেছে কিনা সে প্রশ্নটা আমার কাছে অবশ্য অজ্ঞাত ।

বিশেষ দ্রষ্টব্য:১ -চলতি সিরিজ ' মরীচিকা' পাঠকের একটু একঘেয়েমি মনে হওয়াতে একটু স্বাদ বদল করতেই এই সাময়িক পোস্টটি দেওয়া ।

২- উপরের ছবিগুলি প্রথমটি চিল্কার ছবি । আর দ্বিতীয়টি গোপালপুর থেকে দারিংবাড়ি যাওয়ার পথে তিতলির সৌজন্যে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি গ্রামের খণ্ডচিত্র।






সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৬
৫১টি মন্তব্য ৫১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২১

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

ট্রাম্প হচ্ছে একজন আপাদমস্তক বিজনেসম্যান। কমলা হ্যা্রিস যেহেতু ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত তাই ইন্ডিয়ান ভোটার টানার জন্য সে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে জাস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্রগ্রামে যৌথবাহিনীর ওপর ইসকনের এসিড হামলা সাত পুলিশ আহত।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৪৩

এসিড নিক্ষেপে আহত পুলিশ সদস্য



চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর ইসকন সমর্থকদের হামলা ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসকন

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭


INTERNATIONAL SOCIETY FOR KRISHNA CONSCIOUSNESS যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ISKCON এর বাংলা অর্থ হল আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ। যে সংঘের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় করে তোলার মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রকৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

তুমি তাদের কাছেই যাবে তারা তোমার মূল্য বুঝবে....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৪


মৃত্যুর পূর্বে একজন পিতা তার সন্তানকে কাছে ডেকে বললেন, 'এই নাও, এই ঘড়িটা আমি তোমাকে দিলাম। আমাকে দিয়েছিলো তোমার দাদা। ঘড়িটা দুইশত বছর আগের। তবে, ঘড়িটা নেওয়ার আগে তোমাকে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×