বৃষ্টির দিনগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে মল্লিকা
পঙক্তি আসে না
ছন্দ আসে না
তোমারও আসার খবর নেই !
রিয়াকে মুঠোফোনে মেসেজ পাঠিয়ে অর্ক প্রতিত্তোরের জন্য অপেক্ষা করছে। কি-প্যাডে রিয়ার আঙুল অপেক্ষাকৃত ধীরে চলে। তাই অর্ক ধারণা করছে প্রায় আধাঘন্টা পর মোবাইল চেক করলেই চলবে। সে বায়োলজি বইটা নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। কিন্তু না। তার ধারণার বুকে চাবুক চালিয়ে টুং টুং শব্দ করে ফিরতি মেসেজ চলে এলো।
আমারও সময় কাটছেনা প্রিয়
তোমার সব পঙক্তি,
তোমার সব ছন্দ
আমাকে তোমাতে বুঁদ করে রেখেছে,
আমি যে তোমারি প্রতীক্ষায় !
অর্ক'র মুখমন্ডল মোবাইলের আলোকছটা আর রিয়ার মেসেজের অদৃশ্য মায়াবি যাদুতে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তার বাঁকানো ঠোঁটের মুচকি হাসির দ্যুতি ঘরময় বিচ্ছুরিত হতে থাকে। ঐশ্বরিক এক রিমঝিম ছন্দ তার কোমল হৃদয়ে দোলা দিয়ে গেল যেনো।
অর্ক লিখলো...
এমন আর ভালো লাগছে না মল্লিকা
তুমি এসো, তুমি এসো
বৈশাখি ঝড়ের দুপুরে,
অথবা মাঘের পিনপতন নিরবতার রাতে চুপিসারে,
তুমি এসো..... ।
রিয়া চটপট লিখে ফেললো...
আমি তো আসতে চাই প্রিয়!
কিন্তু সমাজের অদৃশ্য কিছু রীতি
কাপুরুষদের অসংলগ্ন গীতি
আমাকে ঘায়েল করছে প্রতিদিন !
আমি ব্যর্থ, আমি ব্যথিত ।
অর্কের মনটা চুপসে যায়। বাইরে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। বজ্রপাত হচ্ছে। সবাই মাতামাতি করছে- আহ! কী ঝড়, কী বৃষ্টি ! তবে তার হৃদয়ে বয়ে যাওয়া উত্তাল ঝড়ের খবর কেউ রাখছে না।
অর্ক আবার লিখলো..
এবার ঘুমিয়ে পড়ি মল্লিকা। রাত পোহালেই আমার কতশত কাজ। বাজার থেকে নিয়ে আসতে হবে বাবার পছন্দের পাবদা মাছ, সাথে তরতাজা পুঁই। কাজের বুয়ার জন্য কিনতে হবে সিঙ্গাপুরী সুপারি আর খাসিয়া পান। আমি ঘুমাই। আমি ঘুমাই এবার।
মোবাইলটা পাশে রেখে অর্ক ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাকে অবাক করে টুংটুং শব্দে আরো একটা মেসেজ হাজির।
তুমি কি জানো অর্ক, আজ থেকে ঠিক ছ'মাস আগে একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আমাকে, আজ তার মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে। কাল থেকে আমি এই পরবাসে সম্পূর্ণ একা, পুরো একা হয়েই বেঁচে থাকবো। আমার আশেপাশে কতশত মানুষের বিচরণ। কিন্তু কেউ কি আছে বলো তোমার মতন ! এবার বিদায়, আমাকে বিদায় দাও বন্ধু !
অর্কের গা ঝিমঝিম করে। শীতের সকালে বিড়ালছানা যেমন করে রৌদ্রের সাথে আলিঙ্গন করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, অর্ক সেভাবে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। একে একে রিয়ার পাঠানো গত ছ'মাসের সব মেসেজ ডিলিট করে দেয় সে !
সে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ ৪ঠা মে। ঠিক ছ'মাস আগে রিয়া যখন তার মা-বাবার একঘোয়েমি আর তার (অর্ক) মৌন সম্মতিতে বিয়ে করে সুদুর আমেরিকায় পাড়ি জমায় তখন এক ঝড়ো বিকেলে অর্ক'র হাত ধরে বলেছিল- অন্তত ছ'টা মাস আমার সাথে যোগাযোগ রেখো অর্ক। না হয় আমি যে পাগল হয়ে যাবো। নিঃশেষ হয়ে যাবো !
সে বলেছিল, তার মানে বিয়ের পরও...
রিয়া ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে বললো- প্লীজ..মাত্র ছ'টা মাস !
অর্ক শেষ ম্যাসেজটি পাঠিয়ে মোবাইলটা অফ করে দেয়। চোখদুটো কেমন জানি ভারী ভারী লাগছে তার।
কিছু বিদায়,
সে তো বিদায় নয় বন্ধু।
সে যে আজীবন বহমান মর্মজ্বালা,
যেমন বইছে সুরমা-বিবিয়ানা আর সিন্ধু !