পার্কের বুড়ো দেবদারু গাছটার শিকড়গুলো এঁকেবেঁকে এদিক-সেদিক মোড় নিয়েছে। কয়েকটা শিকড় যেন গাছের ডাল-পালা থেকেও বিশাল। সবচেয়ে বড় শিকড়টা বেছে নিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে পাশাপাশি বসে আছে মনোজ আর শায়লা। পার্কের বেঞ্চগুলো আজ শহরের বিত্তবান বাবা-মায়ের আদুরে কপোত-কপোতীর পরশ পেয়ে গৌরবান্বিত বোধ করছে। লাল-নীল রেষ্টুরেন্ট ছেড়ে আজ কেন তাদের পার্কে আগমন তা জানা নেই তাদের। তাই মনোজ আর শায়লা’র জায়গা হয়েছে কালের সাক্ষী হওয়া দেবদারু গাছটার ছালহীন শিকড়ে। তবে তাদের দিকে মানুষের চলাচল একটু কম হওয়ায় মনোজ একটু বেশীই পুলকিত আজ। শিকড়গুলো যেভাবে একে অপরকে ধরে লেপ্টে আছে সেভাবে কথার ফাঁকে ফাঁকে তারা দুজন জড়িয়ে থাকে নিবিড় ভাবে।
- চলো শায়লা ফুচকা খাবো।
- তোমার কাছে টাকা আছে ?
- কি যে কও শায়লা, তুমি কি জানো এই ক’দিন ধরে আমার কি রকম ইনকাম হচ্ছে।
- তাই নাকি ! তুমি কবে থেকে কাজকর্ম শুরু করেছো ?
- আহা, তুমি এসব বুঝবা না। এখন আমার সিজনাল ইনকামের সময়। সারাদিনে একটা কাজ হাতে পেলেই বহুত ইনকাম।
কথার ফাঁকে ফাঁকে শায়লা খেয়াল করে মনোজের মলিন মুখের দিকে। গালের লম্বা দাড়িগুলো জানিয়ে দিচ্ছে ক’দিন আগেই শেভ করার প্রয়োজন ছিল। হয়তো হাতে একটা কড়িও নেই। গায়ের শার্টটা গত সপ্তাহেই ধোয়ার জন্য উপযুক্ত ছিল। কিন্তু আজও তা হয়নি। জিন্স পেন্টের পায়ের গোড়ালির দিকটা স্পষ্টত নতুন পেন্ট কিনার অপারগতা জানিয়ে দিচ্ছে। তবে মনোজ বলে- এসব নাকি আজকালকার ফ্যাশন। যার পেন্টের গায়ে যত ছিদ্র, সে ততই ফ্যাশন সচেতন।
- আমাদের বিল কত হইছে ভাই ?
- একশ বিশ টাকা।
- কী কছ বেটা। এতো টাকা ক্যামনে আইলো।
- ভাই আপনিতো একাই তিন প্লেট খাইছেন আর আপু খাইছে এক প্লেট। প্রতিটার দাম ত্রিশ টাকা হইলে টোটাল কত হয় আপনিই হিসাব কইরা দেহেন।
এবার মাথা নিচু করে মনোজ। সে কখন যে তিন প্লেট খতম করেছে খেয়াল করেনি। পেন্টের পেছন থেকে মানিব্যাগটা বের করে টাকা খোঁজে সে। পরিমান মতো টাকা না পেয়ে শায়লার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাঁকায়। শায়লা জানে, পেন্টের মতোই তার মানিব্যাগের করুণ-জীর্ণ দশা। সে মিটিয়ে দেয় ফুচকার বিলটা। মনোজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কষ্টে বুক ফাটে তাঁর। বারে বারে শায়লার কাছে তাঁর এমন পরাজয় আর ভালো লাগে না। শায়লা হাত ধরে বলে- চলো যাই।
বুঝছো শায়লা, শহরের অবস্থা তেমন ভালো না। বাসা থেকে বের হওয়ার দরকার নাই। শহরে গাড়ি পোড়ানোর একটা হিড়িক পরেছে। যত গাড়ি পোড়ানো হবে ততই আন্দোলন জমে উঠবে। তোমার কোন দরকার হলে আমাকে বলবা।
- তোমাকে বলবো মানে, তুমি কী আমার স্বামী হইছো!
- হইনি, তবে কিছুদিন পরে হবো।
- তুমি স্বামী হইতে পারবা ? তোমার সেই ক্ষমতা আছে ?
- কী যে বলো শায়লা! আমার ক্ষমতা তুমি দেখবার চাও ? আমার টাকা-পয়সা নাই, তা ঠিক। তবে তোমাকে ভালবাসার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।
মনোজের কথা শুনে শায়লার চোখ ছলছল করে। সে জানে মনোজ তাকে কত পছন্দ করে। শায়লার প্রেমে পড়ে সে গাজার নেশা ছেড়ে দিয়েছে। শায়লার হাত ধরে সে প্রতিজ্ঞা করেছে, কিছুদিনের মধ্যে সিগারেটটাও বন্ধ করে দিবে। তাঁর মাথায় এখন একটাই নেশা, কীভাবে শায়লাকে কাছে পাবে, একটু আদর করবে। জড়িয়ে ধরবে, শিকড়ের মতো।
শীতের সন্ধায় জীর্নশীর্ন কাপড় পড়ে রাস্তার দাঁড়িয়ে আছে মনোজ। সাথে সাঙ্গপাঙ্গ কয়েকজন। শহরের কর্মব্যস্ত মানুষ বাড়ি ফিরবে এই সময়টাতে। গোধূলী বেলায় পাখিরা যেমন নীড়ে ফিরে, সেভাবে। ধর্মঘট চলছে দেশ জুড়ে। তাই তাদের মনে ভয় আর উৎকন্ঠা।
মনোজ হঠাৎ খেয়াল করে তাদের দিকে একটা বাস আসছে। নীল বাস। সাঙ্গপাঙ্গদের ইশারা দেয় সে। জিন্স পেন্টের পকেট থেকে বাম হাতে লাইটারটা বের করে। সঙ্গী একজন গ্রামের খোপা বাতির মতো বোতলটা মনোজের ডান হাতে ধরিয়ে দেয়। লাইটারটা ঠস করে জ্বালিয়ে বোতলের মুখে লাগানো সলতেটায় লাগিয়ে দেয় সে। মনোজের পা কাঁপে। সে জানে কী পরিনতিটা হবে এই বাস যাত্রীদের। কিন্তু তাঁর কিছুই করার নেই। তাঁর মানবতা দু-একটা ছাপা কাগজের কাছে নস্যি আজ। সে জানেনা তাঁর ভবিষ্যত ছূঁড়ে দেয়া বোতলের মতো এপার থেকে ওপারে গড়াগড়ি খাবে।
বাসটা কাছে আসতেই জানালার ফাঁক দিয়ে বীরের মতো ছূঁড়ে দেয় জ্বলন্ত বোতলটি। তারপর। আগুন আগুন। মর্মস্পর্শী চিৎকার। আকাশ ভারী করা চিৎকার। ঝলসানো মুখ, হাত, পা, সমস্ত শরীর। মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই। সংসার পুড়ে ছাই। ভালবাসা পুড়ে ছাই।
এত্তসব দেখার সময় নেই মনোজের। আগামীকাল শায়লাকে নিয়ে সে মন ভরে ফুচকা খাবে। বীরের মতো মানিব্যাগ বের করে বিলটা পরিশোধ করবে। শায়লা খাবে তিন প্লেট, সে খাবে এক প্লেট। চার প্লেটের দাম একশত বিশ টাকা। বাকী টাকা মায়ের শাড়ীর আচলে গিট্ট দিয়ে বেঁধে রাখবে। লাজুক মুখে মাকে বলবে, তাঁর শায়লা’র কথা।
কম্পন দেওয়া মোবাইলটায় কল আসতেই কেঁপে উঠে মনোজ। নিশ্চিত শায়লা কল দিয়েছে। আমি তাকে নিয়ে ভাবছি, ও তা বুঝে গেছে নিশ্চয়ই। একেই বলে হৃদয়ের টান।
না, শায়লার ফোন না। অপর প্রান্তে কান্নাজড়িত কন্ঠ। মনোজ ভাই, আপনি কই, শায়লা আপু পুইড়া গেছে।
- কী কছ এই সব ! কোথায় পুড়ছে, কীভাবে পুড়ছে ?
- ভাই,আমরা যে বাসটাতে আগুন দিছিলাম, শায়লা আপু ঐটাতে ছিল। উনাকে হাসপাতালে নেওয়া হইতাছে ভাই। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।
মনোজ হাসপাতালের দিকে দৌড়ায়। বজ্রপাতের মতো আগুন লেগেছে তাঁর হৃদয়ে। তাঁর স্বপ্ন এক নিমিষেই দাউদাউ করে জ্বলছে। মনোজ দৌড়ায় তাঁর স্বপ্ন বাঁচানোর আশায়।
উৎসর্গ : দগ্ধ হওয়া আমাদের কারো মা-বাবা,ভাই-বোন অথবা পরিচিতদের উদ্দেশ্যে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:০০